মঘিয়া গণহত্যা (কচুয়া, বাগেরহাট)
মঘিয়া গণহত্যা (কচুয়া, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ১৫ই অক্টোবর। পাকসেনাদের দোসর রাজাকার বাহিনী এ গণহত্যা চালায়। এতে ১৫ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
মঘিয়া বাগেরহাট জেলার অন্তর্ভুক্ত কচুয়া উপজেলার একটি গ্রাম। কচুয়া সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বাজারটির নাম ভাসাবাজার। অন্যান্য দিনের মতো ঘটনার দিনও যথারীতি ভাসাবাজারে হাট বসে। এদিন হাটে লোক সমাগম ছিল প্রচুর। বিকেল ৪টার দিকে কচুয়ার সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী ভাসাবাজারে এসে ২৫-৩০ জন নিরীহ সাধারণ মানুষকে আটক করে। তারপর তাদের দুই সারিতে দাঁড় করিয়ে কচুয়ার দিকে হেঁটে যেতে নির্দেশ দেয়। মঘিয়া ধোপাবাড়ি মোড়ে পৌঁছতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। রাজাকাররা তাদের রাস্তার পাশে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। একজন রাজাকার আটককৃত সুনীল ডাকুয়াকে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে জিজ্ঞেস করে তাদের মধ্যে হরেরাম মণ্ডল কে। কয়েকজন হরেরাম মণ্ডলকে দেখিয়ে দিতেই রাজাকাররা তাকে মারতে থাকে আর বলতে থাকে, ‘জয় বাংলা বল, জয় বাংলা বল, তোর বাপরে ডাক। শেখ মুজিব তোর বাপ হয় না?’ তারপর তাকে নিয়ে যায় রাস্তার পাশে খালের নিকট।
সুনীল ডাকুয়া তার মামা হরেরাম মণ্ডলকে হত্যা করার যে বর্ণনা দেন তা লোমহর্ষক। ঐ রাজাকার একটান দিয়ে হরেরাম মণ্ডলের পরনের লুঙ্গি খুলে ফেলে। তারপর বলতে থাকে ‘এই মালাউনের বাচ্চা, মুক্তিবাহিনী তোর বাপ হয়। তলে-তলে মুক্তিবাহিনীকে খাতির করিস। হঠাৎ একজন অল্প বয়সী রাজাকার উন্মত্তের মতো চিৎকার করতে-করতে এসে বিশাল এক রাম দা দিয়ে হরেরাম মণ্ডলের পুরুষাঙ্গের ওপর কোপ দেয়। হরেরাম মণ্ডল আর্তনাদ করে কুঁকড়ে ওঠে I তারপর কাঁপতে-কাঁপতে মাটিতে পড়ে যায় এবং জবাই করা পশুর মতো দাপাদাপি করতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে রাজাকারটা উন্মাদের মতো উল্লাস করতে থাকে। চিৎকার করতে-করতে হরেরাম মণ্ডলকে পা দিয়ে চেপে ধরে। তারপর তার গলার ওপর রামদা চালায়। মুহূর্তের মধ্যে হরেরাম মণ্ডলের দেহ নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। এরপর রাজাকাররা একে-একে অন্যদেরও খালপাড়ে নিয়ে গুলি করে, রামদা দিয়ে কুপিয়ে এবং বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। অবশেষে রাজাকাররা সুনীল ডাকুয়ার ঘাড়ে গুলি এবং বুকে বেয়নেট চার্জ করে মৃত ভেবে তাকে ফেলে চলে যায়। সুনীল ডাকুয়ার পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে বুকে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। তবে তিনি বেঁচে যান। নকিব নামে এক ব্যক্তি আহত সুনীল ডাকুয়াকে তার বাড়িতে নিয়ে খড়কুটোর মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। পরে তার বাড়িতে পৌঁছে দেন।
এদিন যারা গণহত্যায় শহীদ হন, তারা ছিলেন ভাসা, সানপুকুরিয়া, আন্ধারমানিক, সিটাবাড়ি, রথখোলা এবং পাতিলাখালী গ্রামের বাসিন্দা। শহীদরা হলেন- হরেরাম মণ্ডল (পিতা গোপাল চন্দ্র মণ্ডল, ভাসা), ফণীভূষণ মণ্ডল (পিতা গোপাল চন্দ্ৰ মণ্ডল, ভাসা), শৈলেন্দ্রনাথ মণ্ডল (পিতা কুমুদ মণ্ডল, ভাসা), প্রমথ রঞ্জন মণ্ডল (পিতা পূর্ণচরণ মণ্ডল, ভাসা), হরিপদ হালদার (পিতা কালীচরণ হালদার, সানপুকুরিয়া), হরষিত হালদার (পিতা শচীন্দ্রনাথ হালদার, সানপুকুরিয়া), ঋষিকেশ মৃধা (আন্ধারমানিক), অতুলকৃষ্ণ মৃধা (পিতা অভয়চরণ মৃধা, আন্ধারমানিক), সুনীল কুমার পাইক (পিতা নগেন্দ্রনাথ পাইক, সিটাবাড়ি), বাসুদেব পাইক (পিতা মুকুন্দ পাইক, সিটাবাড়ি), অনন্তকুমার হালদার (পিতা রতিকান্ত হালদার, সানপুকুরিয়া), সুরেন্দ্রনাথ হালদার (পিতা অম্বিকাচরণ হালদার, সানপুকুরিয়া), রাধারমণ ব্যানার্জী (পিতা প্রশান্ত ব্যানার্জী, রথখোলা), নবকুমার সমদ্দার (পিতা ফণীভূষণ সমদ্দার, রথখোলা) এবং লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল (পাতিলাখালী)। গণহত্যাস্থলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [তাপস কুমার বিশ্বাস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড