You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.08 | ভূঞাপুর যুদ্ধ (ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল) - সংগ্রামের নোটবুক

ভূঞাপুর যুদ্ধ (ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল)

ভূঞাপুর যুদ্ধ (ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল) সংঘটিত হয় ৮ই অক্টোবর কাদেরিয়া বাহিনী-র কোম্পানি কমান্ডার খন্দকার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে। টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ভূঞাপুর উপজেলা সদরে পাকসেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে সংঘটিত এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভূঞাপুর হানাদারমুক্ত হয়।
১৯৭১ সালের ১১ই আগস্ট ভূঞাপুরের অন্তর্গত সিরাজকান্দি নামক স্থানে যমুনা নদীর পূর্বতীরে ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখে খন্দকার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই এসটি রাজন এবং আরএসইউ ইঞ্জিনিয়ার্স এলসি-৩ নামক পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি জাহাজ আক্রমণ ও দখল করেন। জাহাজ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। এ ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী বিমান হামলা চালিয়ে স্থল ও জলপথে ভূঞাপুরকে ঘিরে ফেলে। ১৪ই আগস্ট তারা ভূঞাপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে।
ভূঞাপুর ছিল তখন কাদেরিয়া বাহিনীর অন্যতম ঘাঁটি। এখান থেকে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কালিহাতী, ঘাটাইল, মধুপুর, গোপালপুরসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশনা দেয়া হতো। এখান থেকেই টাঙ্গাইলের অধিকাংশ ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে নৌ-পথে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে যেত এবং উচ্চতর ট্রেনিং শেষে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ প্রত্যাবর্তন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিত। এসব কারণে ভূঞাপুর থেকে পাকবাহিনীকে উৎখাত করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অতি জরুরি ছিল। তাই ২২শে সেপ্টেম্বর কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম ভারতের তুরার হিরো ট্রেনিং সেন্টারে অবস্থানকালে ভূঞাপুর দখলের পরিকল্পনা করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আব্দুল আলীম তালুকদার, আব্দুল হামিদ ভোলা, খোদা বখস মিঞা, আশরাফ হোসেন খান বাদশা, শাহজাহান মিঞা, সিরাজ উদ্দিন তালুকদার, শামছুল হক মিঞা, মাহতাব উদ্দিন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। ঐদিনই তুরা থেকে তাঁদের নিকট ভূঞাপুর যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়। অক্টোবরের ৩ তারিখ চুকাইনগর গ্রামের কাজী মতিয়ার রহমানের বাড়িতে বসে কাদের সিদ্দিকী উত্তরাঞ্চলের কোম্পানি কমান্ডারদের এক জরুরি সভায় অক্টোবরের ৮ তারিখে কোম্পানি কমান্ডার খন্দকার হাবিবুর রহমানকে ভূঞাপুর অপারেশনের নির্দেশ দেন।
ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফেরার সময় মুক্তিযোদ্ধারা পর্যাপ্ত পরিমাণ যুদ্ধসরঞ্জাম নিয়ে আসেন এবং ভূঞাপুর অভিযানে তারা সেসব ব্যবহার করেন। খন্দকার হাবিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করে তিনদিক থেকে একযোগে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। ভূঞাপুর অপারেশনে দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। কোম্পানি কমান্ডার নিজে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে, আব্দুল আলীম তালুকদার পূর্ব দিক থেকে এবং আবদুস সামাদ সামা, আবদুল হামিদ ভোলা, মোজাম্মেল হক, শামছুল হক মিঞা, রফিকুল ইসলাম, খোদা বখশ মিঞা, সিরাজ উদ্দিন তালুকদার, মাহতাব উদ্দিন প্রমুখকে নিয়ে গঠিত মর্টার গ্রুপ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক অর্থাৎ ভারই গ্রাম থেকে আক্রমণ চালাবে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। নির্দেশ ছিল মর্টার শেল না ছোড়া পর্যন্ত কেউ গুলি ছুড়বে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭ই অক্টোবর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যার-যার গ্রুপসহ নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নেন|
৮ই অক্টোবর ভোররাতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে মর্টার শেল ছোড়ার মধ্য দিয়ে আক্রমণ শুরু হয়। খন্দকার হাবিবুর রহমান উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালান। পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করেন আবদুল আলীম তালুকদারের নেতৃত্বে কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গালের কোম্পানির ২৫-৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম শেলটি হাইস্কুল হোস্টেলে স্থাপিত শত্রুবাহিনীর ক্যাম্পের সম্মুখে পাঁচ গজের মধ্যে গিয়ে পড়ে। এতে শত্রুরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধের পরিস্থিতি পুরোপুরি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে চলে আসে। যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুধাবন করে পাকিস্তানি বাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা ভূঞাপুর-এলেঙ্গা সড়ক ধরে পালিয়ে যায় এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস শহিদ হন এবং আবুল হোসেন ও আলাউদ্দিন নামে অপর দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা ১০৮ জন রাজাকারকে আটক করেন। এভাবেই ভূঞাপুর হানাদারমুক্ত হয়।
ভূঞাপুরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছাব্বিশা গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস, খায়েরপাড়ার আবদুস ছালাম, নিকরাইলের আবু সাঈদ খোকা, রাউৎবাড়ির শাহজাহান মিঞা, আব্দুল জলিল মিয়া, ভাদুরীর চরের আবদুল মজিদ মিঞা, মুক্তাগাছার আবুল হোসেন, কয়ড়ার জনাব আলী মণ্ডল, বামনহাটার আব্দুল মতিন, কাদের খান, কুকাদাইরের তারা মৃধা, সখিপুরের গোরখা, গোহাইলবাড়ীর রফিকুল ইসলাম, বাহাদীপুরের ফজলুর রহমান, শিয়ালকোলের বারী তালুকদার, আবদুল বাছেদ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড