You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ভেড়ামারা উপজেলা (কুষ্টিয়া) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ভেড়ামারা উপজেলা (কুষ্টিয়া)

ভেড়ামারা উপজেলা (কুষ্টিয়া) একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানকার মানুষ উনিশ শতকে নীল বিদ্রোহ ও ফরায়েজি আন্দোলনে অংশ নেয়। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনও এখানে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৬-দফা ও ছাত্রদের ১১-দফা আন্দলনের পক্ষে ভেড়ামারায় ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর সারাদেশের মতো ভেড়ামারার মানুষের কাছেও স্পষ্ট হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে ভেড়ামারা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এ উপজেলার একদিকে প্রমত্ত পদ্মা নদী এবং অন্যদিকে ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। পদ্মা নদী ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ভেড়ামারার মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
৭ই মার্চের পর ভেড়ামারায় স্বাধীন বাংলা পরিষদ সংগ্ৰাম গঠিত হয়। বিএলএফ-এর নেতা রশিদুল আলম আনিস ও জসিম মণ্ডল ১৭ই মার্চ পাকশিতে স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর ২৩শে মার্চ রশিদুল আলম আনিস, আজিজুর রহমান আক্কাস ও রুহুল মাস্টার ভেড়ামারায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কেবল পতাকা উত্তোলন নয়, তাঁরা বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন।
ভেড়ামারা উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের ১০ জন গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন এবং তাঁদের নেতৃত্বে এখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। গ্রুপ কমান্ডাররা হলেন- আব্দুর রাজ্জাক (নওয়াপাড়া), আব্দুর রহমান (সাতবাড়িয়া), শাহিদুল ইসলাম (ষোলদাগ), মহিউদ্দীন বানাত (সাতবাড়িয়া), মোকাদ্দেস হোসেন (দামুকদিয়া), হাফিজুর রহমান (মওলা হাফেজপুর), তোবারক হোসেন (আড়কান্দি), মোজাম্মেল হক (গোসাইপাড়া), ইউসুফ কামাল (নলুয়া) এবং লুৎফর রহমান (গোলাপনগর)। ভেড়ামারা উপজেলার বিএলএফ-এর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন রশিদুল আলম আনিস (ষোলদাগ, বাহিরচর)।
ভেড়ামারায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনীতিবিদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ছাত্র-জনতা প্রথম থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের কাছে এখানকার অনেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র- যুবকরা নিজ-নিজ এলাকায় অবস্থান নেন।
২৬শে মার্চ ভেড়ামারায় কারফিউ চলছিল। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ ও অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জহুরুল হক রাজা মিয়ার নেতৃত্বে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উভয় পাশে অবস্থান নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিহত করার উদ্যোগ নেন। হার্ডিঞ্জ ব্রিজে প্রায় ২ প্লাটুন বাঙালি ইপিআর জওয়ান ছিলেন। সুবেদার মোজাফ্ফরকে তাঁর কোম্পানিসহ ভেড়ামারা হয়ে কুষ্টিয়া শহরের উপকণ্ঠে অপেক্ষা করতে বলা হয়। জহুরুল হক রাজা মিয়ার নেতৃত্বে ভেড়ামারা রেলগেট ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের তীরবর্তী ১২ মাইল রাস্তায় বড়-বড় গাছের গুঁড়ি, কাঠের ডুম ও ইট ফেলে ব্যারিকেড দেয়া হয়। এ- সময় জনতা গগনবিদারী কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। চারদিকে ঘেরাও অবস্থায় পাকসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ১৫ই এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পাকহানাদার বাহিনী পাকশি ব্রিজ দিয়ে পদ্মা নদীর পশ্চিম পাড় হয়ে ভেড়ামারায় অনুপ্রবেশ করে। এখান থেকে তারা কুষ্টিয়া শহর পুনর্দখলের চেষ্টা করে। এজন্য পাকবাহিনী দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে একটি গ্রুপ জি কে ক্যানেল ও রেললাইন ধরে দক্ষিণ দিকে মিরপুর-পোড়াদহ হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। অপর গ্রুপটি কুষ্টিয়া-ভেড়ামারা রোড দিয়ে সরাসরি কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশ করে। তারা পথে দুপাশের ঘরবাড়ি গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়, দেখামাত্র মানুষের ওপর গুলি করে এবং বড়-বড় স্থাপনা মর্টারশেল দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়।
পাকহানাদার বাহিনী ১৫ই এপ্রিল ভেড়ামারায় অনুপ্রবেশ করে ভেড়ামারা পাইলট হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা সাধারণ মানুষের ওপর হত্যা ও নির্যাতন চালাত।
ভেড়ামারা পাইলট হাইস্কুলে পাকহানাদারদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। এখানে মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র-যুবক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে বন্দি করে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা ভেড়ামারায় নারী- পুরুষ-শিশুদের ওপর নারকীয় হত্যা ও নির্যাতন চালায়। তারা অনেক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
ঘাতকদের হাত থেকে মাজারের পীর- খাদেমরাও রেহাই পাননি। উপজেলার মোকারিমপুর ইউনিয়নের গোলাপনগর মাজার শরিফের পীর সোলাইমান শাহ চিশতি (পিতা আব্দুল হামিদ খান) ও ৬ জন খাদেমকে পাকসেনারা নামাজরত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। নিহত ৬ জন খাদেম হলেন- আব্দুল লতিফ বাবু, আমীর আলী প্রধান (পিতা ওয়াহেদ আলী প্রধান), আব্দুর রহমান প্রধান, আজিম উদ্দীন, আইয়ুব আলী ও আব্দুল ওয়াহাব। বাহিরচর ইউনিয়নের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন ষোলদাগে বিভিন্ন সময় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। এখানে পদ্মার পাড় ঘেঁষে হাজার- হাজার নিহত মানুষকে সমাহিত করা হয়। অনেক লাশ দাফনের সুযোগ হয়নি। সেসব লাশ পাকহানাদাররা পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
চণ্ডিপুর গ্রামের পণ্ডিত বাড়ির নারী-পুরুষ-শিশুরা পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৫ই এপ্রিল সন্ধায় জি কে ক্যানেল, রেললাইন ও মিরপুর থানা পার হয়ে পশ্চিমে চন্দনা নদীর তীরে এসে উপস্থিত হয়। পারাপারের নৌকা না পাওয়ায় সারারাত নদীর পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে একটি গর্তে পরিবারের ১৮ থেকে ২০ জন নারী-পুরুষ-শিশু নির্ঘুম রাত্রি যাপন করে। পরের দিন ১৬ই এপ্রিল সকালে প্রথম নৌকা ধরেই নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু পাকসেনারা তাদের অবস্থান জানতে পেরে নদীর পাড়ে চিরুনি অভিযান চালায়। তারা ঝোপঝাড় তল্লাশি করতে-করতে নদীর পাড়ে জঙ্গলে গর্তের কাছে পৌঁছায়। গর্তের ভেতরে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা ব্রাশফায়ার করে। মুহূর্তের মধ্যে ১৪টি তাজা প্রাণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে৷ মৃত্যু নিশ্চিত করে পাকসেনারা সেখান থেকে চলে যায়। চণ্ডিপুর গণহত্যায় নিহতরা হলেন— শফি উদ্দীন (পিতা ফতে আলী), মশিউর রহমান (পিতা শফি উদ্দীন), মীর রাবেয়া খাতুন (স্বামী মীর আবুল হোসেন), মীর ডায়মন্ড (পিতা মীর আবুল হোসেন), মীর (পিতা আবুল আক্তারুজ্জামান হোসেন), মীর নূতন (পিতা মীর আবুল হোসেন), মিম নীলা (পিতা আব্দুস সাত্তার), জালাল উদ্দীন (পিতা মীর ফকির আহমেদ), মীর শহিদা বেগম রুমী (পিতা মীর ফকির আহমেদ), মীর নবীন (পিতা জালাল উদ্দীন), জাহেদা খাতুন (স্বামী মো. দলিল উদ্দীন), সেলিনা খাতুন (পিতা মো. দলিল উদ্দীন), ফাতেমা খাতুন (স্বামী মো. আতিয়ার রহমান) এবং সদরুল ইসলাম (পিতা শামছুদ্দিন)। এখানে মারাত্মকভাবে আহত হন মাজেদা বেগম (স্বামী মীর জালাল উদ্দীন), আফরোজা বেগম (পিতা মো. আতিয়ার রহমান), মায়া খাতুন (পিতা শফি উদ্দীন) এবং মো. আমীর খসরু (পিতা মো. আতিয়ার রহমান)।
জুনিয়াদহ ইউনিয়নের জগসাই গ্রামে সাইদুর রহমান চেয়ারম্যানের বাড়িতে পাকসেনারা রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের সহায়তায় অনেককে হত্যা করে। পরে তাদের সমাহিত করা হয়। ভেড়ামারা পৌর এলাকার পুরাতন রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে মীর ছবির উদ্দীনের বাড়িতে পাকসেনারা গণহত্যা চালায়। বাহাদুরপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে পাকসেনারা ১ মুক্তিযোদ্ধাসহ ৫ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের সবাইকে বাহাদুরপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়। ধরমপুর ইউনিয়নের সাতবাড়িয়া গো-হাটের পাশে ও গিয়াস উদ্দীনের বাড়ি সংলগ্ন স্থানে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে গ্রামেই সমাহিত করা হয়। মোকারিমপুর ইউনিয়নের দামুকদিয়া গ্রামে পাকসেনারা স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।
ভেড়ামারা উপজেলায় পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২টি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। একটি যুদ্ধ হয় বাহিরচর ইউনিয়নের ষোলদাগ গ্রাম সংলগ্ন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পার্শবর্তী স্থানে। অপর যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ভেড়ামারা পৌরসভার ফারাকপুর উত্তর রেলগেট গোরস্থানের কাছে। ফারাকপুর যুদ্ধে কে এম রফিকুল ইসলাম শহীদ হন। এছাড়া উভয় যুদ্ধে দুপক্ষে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভেড়ামারা উপজেলা ৯ই ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— কে এম রফিকুল ইসলাম, বীর প্রতীক (পিতা আসাদ আলী খান, গোলাপনগর)।
ভেড়ামারা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— কে এম রফিকুল ইসলাম, বীর প্রতীক (ফারাকপুর যুদ্ধে শহীদ) ও অফেল উদ্দীন (পিতা ইবাদত মণ্ডল, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যুদ্ধে শহীদ; হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন পদ্মাপাড়ের গণকবরে সমাহিত)।
উপজেলার প্রাঙ্গণে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ, চণ্ডিপুর ট্র্যাজেডি স্মরণে রাখার জন্য সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। কে এম রফিকুল ইসলাম, বীর প্রতীক যে গ্রামে শহীদ হন, সেই ফারাকপুরের নাম এখন রফিকনগর। এ গ্রামে তাঁর নামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া ভেড়ামারা থেকে গোলাপনগর সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর প্রতীক শহীদ রফিক সড়ক। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে নির্মিত হয়েছে হার্ডিঞ্জ সেতু মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ। [মেহেদী হাসান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড