ভুরুঙ্গামারী যুদ্ধ (ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম)
ভুরুঙ্গামারী যুদ্ধ (ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম) ভুরুঙ্গমারী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক যুদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর নাগেশ্বরীর সংকোশ নদীর তীরবর্তী বলদিয়া, সুবলপাড়, মাদারগঞ্জ, ধলডাঙ্গা, শিলখুড়ি, মইদাম, বাশঁজানি, রতিলাই, পাগলাহাট, বহালগুড়ি, চরভুরুঙ্গামারী, বাবুরহাট, ভরতেরছড়া, সোনাহাট, ঝাউকুটি, নাজিরহাট, খোঁচাবাড়ি, পাইকেরছড়া, পাটেশ্বরী, জয়মনিরহাট, আন্ধারীরঝাড়, বাঘভাণ্ডার, ভুরুঙ্গামারী কলেজ, পাইলট স্কুল, দেওয়ানের খামার এবং সিও অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ও যুবশিবির গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ২৭শে মে ভুরুঙ্গামারী দখলের পর পাকিস্তানিরা উপর্যুক্ত অনেক স্থানে নিজেদের ক্যাম্প গড়ে তোলে। পাকসেনাদের এসব ক্যাম্প সত্ত্বেও ভুরুঙ্গামারীর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মুক্তিবাহিনীর মুক্তাঞ্চল ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে আক্রমণ করলে ভুরুঙ্গামারী শহর ও অন্যান্য স্থানে কয়েক দফায় যুদ্ধ হয়। ভুরুঙ্গামারী ৬ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন একটি প্রধান যুদ্ধএলাকা ছিল।
জুন মাসের পূর্বে সোনাহাট ও পশ্চিমে বাঘভাণ্ডার এলাকায় মুক্তিবাহিনী অবস্থান নেয়ায় পাকবাহিনী ভুরুঙ্গামারী থানা সদর এলাকা ছাড়া আর কোথাও অবস্থান নিতে পারেনি। পরে বাঘভাণ্ডার, ভুরুঙ্গামারী কলেজ, সোনাহাট, আন্ধারীরঝাড়, সিও অফিস, বাসস্ট্যান্ড ও দেওয়ানের খামার এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের প্রতিরোধ করতে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন। এ এলাকায় মিত্রবাহিনী বিমান হামলাও পরিচালনা করে।
ভুরুঙ্গামারী কলেজ ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্থানীয় হেডকোয়ার্টার্স। তাদের একজন মেজর এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ আক্রমণ পরিচালনার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ৩টি দল গঠন করেন। সেগুলোর দুটি ছিল রেইড পার্টি এবং অন্যটি কভারিং ফায়ার পার্টি। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুর এসএমজি পোস্টে প্রতিটি বাংকারের জন্য ২ জন করে মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। কলেজের পুকুরের উত্তর- পূর্ব কোণায় ক্রলিং করে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এক সঙ্গে ৩টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে এসএমজি বাংকারটি উড়ে যায়। একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের কভারিং পার্টি ফায়ার করতে-করতে কলেজে ঢুকে পড়ে। আকস্মিক আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পরাজিত হয়। মুক্তিবাহিনীর এ সাহসী ও পরিকল্পিত আক্রমণে পাকবাহিনীর মেজরসহ ২০ জন নিহত হয়।
আগস্ট মাসে সাহেবগঞ্জের ভাটিয়াবাড়ি ক্যাম্প থেকে বাঘভাণ্ডারের পশ্চিম এলাকায় অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে-মাঝে ভুরুঙ্গামারী শহরে বিচ্ছিন্ন আক্রমণ পরিচালনা করতেন। একবার ভুরুঙ্গামারী কলেজের পুকুরের কাছে পজিশন নিলে পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারির শেল নিক্ষেপ করে। শেলের আঘাতে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বেশকয়েক জন আহত হন।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে ভুরুঙ্গামারী সদরের দেওয়ানের খামার এলাকার পাকিস্তানি দালাল এফাজ হাজীর বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী আতিথেয়তা গ্রহণ করতে এলে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ির চারদিকের ঝোপ-ঝাড়ে অবস্থান নেন। পাকিস্তানিরা খাওয়া শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করেন। এতে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়।
১১ই সেপ্টেম্বর ভুরুঙ্গামারী-রায়গঞ্জ সড়কের ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে হাবিলদার সোনা মিয়ার নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা রাস্তা কেটে সামান্য দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে পরিখা তৈরি করেন। সে পরিখার মধ্যে মর্টার, এলএমজি, রাইফেল ও গ্রেনেড নিয়ে তাঁরা অবস্থান নেন। ৫০০ গজ দূরে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ সরকার কাট অব পার্টি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, যাতে এম্বুশে পড়ে পাকসেনারা পেছনে পালিয়ে গেলে বা রায়গঞ্জ থেকে তাদের নতুন সৈন্য এলে তাদের ওপর আক্রমণ করা যায়। সকালের দিকে পাকবাহিনী একটি জিপ ও একটি ট্রাক ভর্তি সৈন্য কাটা রাস্তার কাছে পৌঁছে এবং ব্যারিকেড মনে করে রাস্তার ওপর থেকে গাছ ও লতাপাতা সরাতে শুরু করে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা এলএমজি ও মর্টারের গুলিবর্ষণ এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। পাকসেনারা এক পর্যায়ে আহত ও নিহত সৈন্যদের ফেলে পালিয়ে যায়। এ সফল এম্বুশে পাকিস্তানি বাহিনীর ১ জন অফিসার, ১ জন জেসিও এবং ৭ জন সৈনিক নিহত হয়। পরে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করেন। এ অপারেশনের সাফল্য মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করে। ১১ই নভেম্বর রাতে ভুরুঙ্গামারীর পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন ১২ই নভেম্বর সকালে ভুরুঙ্গামারীর পাটেশ্বরী রেলওয়ে স্টেশনে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর মিত্রবাহিনী বিমান আক্রমণ চালায়। আকাশ ও স্থল পথে যৌথবাহিনীর আক্রমণে পাটেশ্বরীতে অবস্থানরত পাকবাহিনী বিপুল ক্ষয়- ক্ষতির পর ভুরুঙ্গামারী পর্যন্ত পিছু হটে।
১৩ই নভেম্বর রাত ১২টায় মিত্রবাহিনীর সাপোর্ট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে ডজন-ডজন আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করলে পাকিস্তানিরা বিচলিত হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের ৮-১০টি দলের এক হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর কয়েকশত সৈনিক ও অফিসার পাকিস্তানি বাহিনীকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কামান, মর্টার, আর্টিলারি, মেশিনগান, এসএলআর, রাইফেল ও গ্রেনেড আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়।
সকালে মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুঙ্গামারীর পশ্চিমে দারোগা সাহেবের বাড়ির কাছে বাশঁঝাড়ে অবস্থান নেন। সেখানে আগে থেকেই বড় ড্রেন খুঁড়ে রাখা ছিল। এটিকে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার হিসেবে ব্যবহার করে সেখান থেকে গুলি চালাতে থাকেন। ভোরবেলা সুবেদার আরব আলীর ‘এ’ কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার সোনা মিয়ার কোম্পানির ছোড়া গোলা পাকসেনাদের বাংকারে আঘাত হানে। মুক্তিবাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণে পাকিস্তানিরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা এক সময় পিছু হটতে থাকে। ১১টার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুঙ্গামারী শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সিও অফিস ও ভুরুঙ্গামারী কলেজস্থ পাকবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স দখল করেন। পাকবাহিনীর বাংকারে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আতা উল্যাহ খান একজন তরুণীসহ নিহত হয়। সিও অফিসের দোতলা থেকে ১৫ জন বীরাঙ্গনাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ভুরুঙ্গামারী কলেজ থেকেও ১০-১৫ জন নারীকে উদ্ধার করা হয়। এসব উদ্ধার অভিযানে মুক্তিযোদ্ধা লে. সামাদ, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা জয়নালসহ অন্যরা যুক্ত ছিলেন। মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় জয়মনিরহাটের মাইন সরিয়ে অবস্থান নেয় এবং কয়েকজন ইপিক্যাপ ও পাকসেনাকে আটক করে। ১৪ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারীর বিভিন্ন পাকক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কমপক্ষে ২০০ নিরীহ মানুষকে উদ্ধার করেন। লে. সামাদ ভুরুঙ্গামারী থানা সদর নিয়ন্ত্রণে নেন এবং ভুরুঙ্গামারীতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তখনো শহরের বিভিন্ন স্থানে লাশ ছড়িয়ে ছিল। বাতাসে লাশের গন্ধ। অসংখ্য নির্যাতিত নারীর কংকাল, ছেড়া শাড়ি, চুড়ি, নাকফুল আর কানের রিং ছড়িয়ে ছিল শহরের বিভিন্ন জায়গায়। ভুরুঙ্গামারী হানাদারমুক্ত করতে ৩ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও শতাধিক নারী জীবনদান করেন। সহস্রাধিক মানুষ গণহত্যার শিকার হন। [এস এম হারুন অর রশীদ লাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড