You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.31 | ভিংলাবাড়ি-জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ প্রতিরোধযুদ্ধ (দেবীদ্বার, কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

ভিংলাবাড়ি-জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ প্রতিরোধযুদ্ধ (দেবীদ্বার, কুমিল্লা)

ভিংলাবাড়ি-জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ প্রতিরোধযুদ্ধ (দেবীদ্বার, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ৩১শে মার্চ। এতে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ৫ জন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
৩০শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে ১৫ সদস্যের একদল পাকিস্তানি সেনা কসবা ও কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মীরপুর এলাকায় হত্যাকাণ্ড চালায়। এ-সময় বাঙালিদের হাতে এক পাকসেনা নিহত হওয়ার পর বাকি ১৪ জন পায়ে হেঁটে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি (বর্তমান ময়নামতি সেনানিবাস)-র দিকে এগুতে থাকে। ৩১শে মার্চ ভোররাতে ভিংলাবাড়ি এলাকায় তারা অবরুদ্ধ হয়। এ সংবাদ পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে ভিংলাবাড়ি, বড় আলমপুর, চাঁপানগর, দেবীদ্বার, ছোট আলমপুর, বিনাইপাড়, ফতেহাবাদ, বিজলীবাজার, মরিচাকান্দাসহ বিভিন্ন গ্রামের হাজার-হাজার মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে চতুর্দিক প্রকম্পিত করে দা, ছেনি, লাঠিসহ বিভিন্ন দেশীয় হাতিয়ার নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকসেনারা ধাওয়া খেয়ে চাঁপানগর গ্রামের হাজারী বাড়ির আবুল কাসেম হাজারীর ঘরে ঢুকে পড়ে। এ-সময় ওই বাড়ির এক গৃহবধূর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানোর সময় আবুল কাসেম হাজারী এক পাকিস্তানি সেনাকে লক্ষ করে ইট ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দেয় এবং রাগে-ক্ষোভে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে পাকিস্তানি সেনার গুলিতে তিনি শহীদ হন। এ ঘটনায় বাঙালিরা আরো ক্ষেপে ওঠে। বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স থেকে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসা কয়েকজন পুলিশ ও সেনাসদস্য যোগ দেন এবং দেবীদ্বার থানার অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। এ-সময় দেবীদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম রকিবুল হক চৌধুরী অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে থানা সংলগ্ন পুরাতন বাজারের পোস্ট অফিসে আশ্রয় নেন। দেবীদ্বার গ্রামের আব্দুল আউয়াল সরকার (পিতা আব্দু সরকার), রেনু মিয়া পুলিশ (পিতা আজগর আলী), ছোট আলমপুর গ্রামের আবু তাহের (পিতা সৈয়দ আলী)-সহ আনুমানিক ৩০ জন দৌড়ে গিয়ে ওসিকে ঘেরাও করে। আবু তাহের ওসির হাত থেকে চাবি ছিনিয়ে নিলে এক পর্যায়ে ওসি নিজে অস্ত্রাগারের তালা খুলে অস্ত্র লুণ্ঠনে জনতাকে সহযোগিতা করেন। বিক্ষুব্ধ জনতা সমস্ত অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম নির্যাতনে ওসি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং ঘটনার এক সপ্তাহ পর ৭ই এপ্রিল থানায় কর্মরত অবস্থায় মারা যান। স্থানীয়রা তাকে দেবীদ্বার ছোট আলমপুর গ্রামের আমিন বাড়ির গোরস্তানে দাফন করে।
এদিকে লুণ্ঠিত হাতিয়ারের পাশাপাশি দেশীয় হাতিয়ার দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে বাঙালিরা যুদ্ধ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা গুলিবর্ষণ করতে-করতে ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে বানিয়াপাড়া ফুলতলায় বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করলে তাদের গুলিতে বানিয়াপাড়া গ্রামের ইদন মিয়া সরকার (পিতা মৈধর আলী সরকার) শহীদ হন। পাকিস্তানি হায়েনারা আবারো বারেরা কোরের পাড় এলাকায় জনতা কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়। বারেরা গ্রামের কৃষক সৈয়দ আলী তখন হালচাষ করছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের দেখে দৌড়ে এসে হালের পাজুন (গরু তাড়ানোর বেত) দিয়ে পেটাতে থাকেন। তার মেয়ে ও জামাই ঢাকায় তখন নিখোঁজ এবং পাকিস্তানি হায়েনাদের কর্তৃক ২৫শে মার্চ রাতে অসংখ্য লোকের হতাহতের ঘটনায় তিনি সংক্ষুব্ধ ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে সৈয়দ আলী শাহাদত বরণ করলে অপর এক কৃষক আব্দুল মজিদ সরকারও লাঠি দিয়ে হানাদারদের পেটাতে থাকেন। এ সময় হানাদারদের গুলিতে তিনিও শাহাদাত বরণ করেন। একই জায়গায় বিক্ষুব্ধ জনতার গুলি ও লাঠিপেটায় এক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং বারেরা গ্রামের সরকার বাড়ির ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক সরকার (পিতা আব্দুল করিম সরকার), দেলোয়ার হোসেন সরকার, রসুলের বাড়ির শামসুল হকসহ বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। চরবাকর এলাকায় আব্দুর রহমান পুলিশ, এলাহাবাদ গ্রামের ন্যাপ নেতা মুস্তাকুর রহমান ফুল মিয়াসহ কয়েকজন গাছের আড়ালে ওঁৎ পেতে থেকে গুলি করে দুজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। লক্ষ্মীপুর বাস স্টেশনের কাছে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসা সৈনিক লক্ষ্মীপুর গ্রামের ফজলুল হক পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ করে গুলি বর্ষণ করার সময় অপর এক পাকিস্তানি সেনার গুলিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। বিক্ষুব্ধ জনতা লক্ষ্মীপুর এলাকায় আরো এক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে। বেগমাবাদ এলাকায় জনতার ইট- পাটকেল নিক্ষেপ, গুলি ও লাঠির আঘাতে আরো দুজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এ-সময় বাজেবাখর গ্রামের চাঁন মিয়ার পুত্র আলফু মিয়া ফকিরসহ আরো দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। কালিকাপুর এলাকায় পৌঁছার পর বেগমাবাদ গ্রামের আফসুর উদ্দিনের পুত্র উসমান আলী এক সেনাকে কোচের আঘাতে হত্যা করেন।
১৫ জন পাকিস্তানি সেনার উল্লিখিত দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা ও কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মীরপুর এলাকায় হত্যাকাণ্ড চালানোর সময় প্রথমে একজন নিহত হয়। এরপর বাকি ১৪ জনের মধ্যে বারেরায় একজন, চরবাকরে দুজন, লক্ষ্মীপুরে একজন, বেগমাবাদে দুজন, কালিকাপুরে একজন মোট ৭ জন নিহত হয়। অবশিষ্ট ৭ জন জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় জনতা তাদের হত্যা করে দুজনকে মাটিতে পুঁতে ফেলে এবং ৫ জনের লাশ বস্তাবন্দি করে গোমতি নদীতে ভাসিয়ে দেয়। [নাহিদ মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড