ভাতশালা যুদ্ধ (দেবহাটা, সাতক্ষীরা)
ভাতশালা যুদ্ধ (দেবহাটা, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ১৭ই অক্টোবর। এতে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
ভাতশালা দেবহাটা উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। পাশেই ইছামতি নদী বাংলাদেশ-ভারত সীমানা নির্দেশ করে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। নদীর পশ্চিম পাড়ে ভারতের হাসনাবাদ এবং পূর্বপাড়ে ভাতশালা। ভাতশালার উত্তর পাশে শাঁকরা-কোমরপুর গ্রাম। শাঁকরা বিওপি (বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট)-তে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। উনিশ শতাব্দীর শুরুতে (১৮১০) নীল ব্যবসায়ের প্রসার শুরু হলে বাংলার অনেক স্থানে নীলচাষ শুরু হয় এবং সে কারণে ইংরেজরা বিভিন্ন স্থানে নীলচাষ ও নীল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নীলকুঠি স্থাপন করে। শাঁকরা গ্রামেও তেমনই একটি নীলকুঠি ছিল। কুঠিসংলগ্ন শাঁকরা কাস্টম হাউজের বিশাল গোডাউন থেকে পূর্বদিকে এক মাইল পর্যন্ত ওয়াপদা (WAPDA)-র রাস্তা খুঁড়ে বাঙ্কার তৈরি করে পাকসেনারা সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।
নবম সেক্টরের অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার (মোহাম্মদ শাহজাহান)-এর নেতৃত্বে ভাতশালায় অবস্থিত পাকসেনাদের ঘাঁটিতে একটি সফল অভিযান পরিচালিত হয়। মূল যুদ্ধ হয় ভাতশালা গ্রামে। তাই এ যুদ্ধকে ভাতশালা যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়।
১৭ই অক্টোবর ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার তাঁর বাহিনীকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন। প্রথম ভাগের দায়িত্বে থাকেন তিনি নিজে। এ দলটি থাকে ইছামতি নদীর পাড়ে ওয়াপদা রাস্তার নিচে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আব্দুর রহিম, আব্দুল গণি, মোফাজ্জেল হোসেন, আব্দুল গফ্ফার, গোলজার হোসেন সরদার, ইয়াছিন আলী, জামসেদ আলম প্রমুখ। দ্বিতীয় দলে ছিলেন বরিশাল জেলার কয়েকজন অকুতোভয় যোদ্ধা। উল্লেখ্য যে, বরিশাল অঞ্চল ৯ম সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত থাকায় বরিশাল জেলার মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত এলাকার অনেক যুদ্ধে অংশ নেন। তৃতীয় দলে ছিলেন ভারতীয় ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের লেফটেন্যান্ট মৃণাল কান্তি মুখার্জীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা। সিদ্ধান্ত হয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দল উত্তর প্রান্ত থেকে ফায়ার করবে এবং ঐ এলাকা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে। এ লক্ষ্যে দুটি দুই ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি এলএমজি, এসএলআর ও গ্রেনেড এবং পর্যাপ্ত গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্ধারা নির্ধারিত স্থানে অবস্থান করেন।
ঘটনার দিন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। শাঁকরা- কোমরপুর বিওপি ছিল পাকসেনাদের একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি। পেছনে তাদের সরবরাহ লাইন ছিল খোলা ও নিরাপদ। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর পেছনে ছিল ইছামতি নদী ও ভারতের সীমান্ত। সুতরাং সরবরাহ ও যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। কেবল উত্তর দিকটা ছিল কিছুটা মুক্ত।
অবিরাম বৃষ্টির ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ও রসদ ভিজে যায়। খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। তবুও তাঁরা প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যান। বৃষ্টি পরোক্ষভাবে তাঁদের জন্য সহায়ক হয়। কারণ সাতক্ষীরা থেকে নতুন করে পাকবাহিনী এসে যুদ্ধরত পাকসেনাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেনি। এক নাগারে দুই রাত একদিন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে। পাকসেনারা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার পরও সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়নি। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের দক্ষ পরিচালনায় সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে লড়ে যায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১০-১২ জন পাকসেনা হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের একযোগে গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত ও বাকিরা আহত হয়।
তখন ছিল রমজান মাস। যুদ্ধের শেষ দিনে ইফতারির সময় আগত বিধায় উভয়পক্ষ কিছু সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতি দেয়। ঠিক সেই সময় হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে মুক্তিযোদ্ধা গোলজার হোসেন সরদারের মাথায়। তিনি মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাঁর বাড়ি ছিল দেবহাটা থানার দক্ষিণ কুলিয়া গ্রামে। জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের টাউন শ্রীপুরস্থ বাড়ির পুরাতন ভিটায় সমাহিত করা হয়। [সিরাজুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড