মুক্তিযুদ্ধে ভাঙ্গুরা উপজেলা (পাবনা)
ভাঙ্গুরা উপজেলা (পাবনা) পাবনা জেলার অন্তর্গত গুমানী ও বড়াল নদীবিধৌত একটি এলাকা। এ উপজেলার উত্তর সীমান্তে চাটমোহর উপজেলা এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তে তাঁড়াশ উপজেলা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাঙ্গুরা পাবনার ফরিদপুর থানার আওতাধীন একটি ইউনিয়ন ছিল। ১৯৮১ সালের ১২ই নভেম্বর এটি থানায় উন্নীত হয়। ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে ভাঙ্গুরা উপজেলা গঠিত। ইউনিয়নগুলো হচ্ছে ভাঙ্গুরা সদর, পার ভাঙ্গুরা, দিলপাশার, খানমরিচ, অষ্টমনিষা ও মন্ডুতোষ।
বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় ভাঙ্গুরাতেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-এর সকল কর্মসূচি এখানে যথারীতি পালিত হয়। এ সকল আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল লতিফ মীর্জা। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খান বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্র আনতে শুরু করে। শাসক গোষ্ঠীর আচরণে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কিছুতেই তারা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেবে না। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া জান্তার হীন চক্রান্ত বুঝতে পেরে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানান। ভাঙ্গুরাবাসী তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ভাঙ্গুরার ছাত্র-যুবকরা নিজেদেরকে সংগঠিত করতে থাকে। তারা ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগঠিত হয়ে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। এরপর বেশকিছু ছাত্র-যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে যায়। সেখানে কেচুয়াডাঙ্গা, শিলিগুড়ি ও দেরাদুন থেকে তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। তাদের মধ্যে ছিল— এম এ হান্নান, আব্দুস সামাদ, গোলাম মোহাম্মদ বাবলু, আব্দুল কুদ্দুস, আসাদুর রহমান, মকছেদুর রহমান, আসলাম আলী, নজরুল ইসলাম, আইনুল হক, আবু বকর, আক্কাস আলী, মোতাহার হোসেন, মহসিন আলী, আব্দুল খালেক, আকবর আলী, সফিজ আলী, শাহজাহান আলী, মজিবর রহমান, আখতার আলী, মোজাম্মেল হক প্রমুখ। এদের মধ্যে কয়েকজন ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বেশকিছু ছাত্র-যুবক ভাঙ্গুরার সীমান্তবর্তী নওগাঁ বাজারের নিকট পলাশডাঙ্গা যুবশিবির-এ যোগদান করে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন।
ভাঙ্গুরা থানার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আব্দুল হান্নান এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ বাবুল, আব্দুস ছামাদ মাস্টার, আব্দুল কুদ্দুস (স্টেশন মাস্টার) ও আসাদুর রহমান। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার কমান্ডার আব্দুল লতিফ মীর্জার এলাকা ভাঙ্গুরার সীমান্তবর্তী হওয়ায় তাঁর পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের তৎপরতা নওগাঁ বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি এ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। এছাড়া রফিকুল ইসলাম বকুল পাবনা জেলার দায়িত্বে থাকায় এর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কমান্ড বলবৎ ছিল।
পাকসেনারা এপ্রিল মাসে পাবনার ফরিদপুর সদরে এসে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা ভাঙ্গুরা বড়াল ব্রিজের নিকট রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকাররা পাকসেনাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখত। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাকসেনারা মাঝে মাঝে ভাঙ্গুরায় আসত। জুন মাসে পাকসেনারা ভাঙ্গুরা ডাকবাংলো, বড়াল ব্রিজের স্টেশন ও কৈডাঙ্গা ব্রিজের কাছে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীর সহযোগিতায় এ উপজেলায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলো- মাজহারুল ইসলাম (নৌবাড়িয়া), মো. নুরুন্নবী মৌলভী, তৈয়ব আলী মাস্টার (হাঙ্গরা গাড়ি), রমজান আলী জেহাদী (ভবানীপুর) প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের সময় মে মাসে ফরিদপুর থানার হাদল গ্রামে পাকবাহিনীর দ্বারা গণহত্যা সংঘটিত হলেও তৎকালীন ভাঙ্গুরা ইউনিয়নে কোনো গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা রফিকুল ইসলাম বকুলের সহযোগিতায় পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পথে নিজেদের এলাকায় আসতে শুরু করেন। তারা নওগাঁ বাজারের নিকট স্থাপিত পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরে সমবেত হতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পলাশডাঙ্গা যুবশিবির ছিল একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাঙ্গুরার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না। নৌকা ছাড়া পলাশডাঙ্গায় যাওয়ার অন্য কোনো উপায় ছিল না। পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরে স্থানীয় যুবকরাও প্রশিক্ষণ নেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। যুবশিবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল লতিফ মীর্জা এবং তাঁর সহযোগী ছিলেন আমজাদ হোসেন ও লুৎফর রহমান অরুণ। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ ফরিদপুর থানার সেলিম ও মান্নানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপে যোগ দেন। রাজাকারদের মাধ্যমে পলাশডাঙ্গা যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের খবর জানতে পেরে পাকসেনারা নভেম্বর মাসে সেখানে আক্রমণ করে। সুবিধাজনক স্থলপথ না থাকায় পাকসেনারা সিরাজগঞ্জ থেকে তাঁড়াশ হয়ে নৌকাযোগে এসে খুব ভোরে পলাশডাঙ্গা যুবপ্রশিক্ষণ শিবির আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও গেরিলা পদ্ধতিতে পাকসেনাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্মুখী আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পলাশডাঙ্গা যুদ্ধ কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এ-যুদ্ধে ১৩০ জন পাকসেনা, শতাধিক মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়।
দিলপাশা ব্রিজ, বড়াল ব্রিজ প্রভৃতি এলাকায় পাহারারত পাকবাহিনীর ওপর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ করে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেন। মুক্তিসেনারা বড়াল ব্রিজের কাছে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে তাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছ থেকে কিছু রাইফেল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এসব কাজে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করেন ২০০৮ সালে পাবনা-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের পিতা হাজী মোহাম্মদ মহসিন। ১৬ই ডিসেম্বর ভাঙ্গুরা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ভাঙ্গুরা উপজেলার একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন- ইউনুছ আলী পিতা দলিল আকন্দ, কলকতি; (সেনাসদস্য)। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পরপরই কলকাতাস্থ বাংলাদেশ দুতাবাসে কর্মরত ভাঙ্গুরার কৃতী সন্তান হোসেন আলী পাকিস্থান সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং কলকাতা দূতাবাসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২০১০ সালে ভাঙ্গুরা উপজেলা পরিষদ ক্যাম্পাসে পাবনা জেলা পরিষদের উদ্যোগে তাঁর নামে একটি অডিটোরিয়াম কাম কম্যুনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের স্মরণে ভাঙ্গুরা স্মৃতিসৌধ- উদ্বোধন করা হয়। [মো. আব্দুদ দাইন সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড