You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.25 | ভাইবোনছড়া অপারেশন (খাগড়াছড়ি সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

ভাইবোনছড়া অপারেশন (খাগড়াছড়ি সদর)

ভাওয়ালিয়াবাজু যুদ্ধ (ভালুকা, ময়মনসিংহ) সংঘটিত হয় ২৫ ও ২৬শে জুন ২ দিন। তবে মূল যুদ্ধ হয় দ্বিতীয় দিন। এ-যুদ্ধে ১৯৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
ভালুকা উপজেলা সদর থেকে ১০ কিমি পূর্বে ভাওয়ালিয়াবাজু গ্রামের অবস্থান। গ্রামটি ভালুকা ও গফরগাঁও থানার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ গ্রামের পাশ দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে সূতিয়া নদী। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় এ এলাকাটি ছিল অনেকটা বন-জঙ্গলে পরিবেষ্টিত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং ৭০ উইং রেঞ্জার্স-এর অপারেশনাল এরিয়া ছিল ভালুকা থানা এলাকা। অপরদিকে পার্শ্ববর্তী টাঙ্গাইল জেলা ও রাজেন্দ্রপুরে অবস্থান নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট|
২৪শে জুন রাতে ময়মনসিংহ ও ঢাকা থেকে হানাদার বাহিনীর দুটি দল অতি সন্তর্পণে গফরগাঁও থানায় এসে সমবেত হয়। ২৫শে জুন ভোরে গরুর গাড়িতে ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ উঠিয়ে তারা রাজাকারদের সহযোগিতায় গাড়ির দুপাশ দিয়ে হেঁটে গফরগাঁও থেকে শিবগঞ্জ রোড হয়ে ভালুকার উদ্দেশে অগ্রসর হতে থাকে। এর মধ্যে এক কোম্পানি সৈন্য তাদের রসদ ও রেশন সামগ্রী বহন করার জন্য ৪০টি গরুর গাড়িতে নিয়োজিত ছিল। বর্ষাকালের এ সময়ে কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তা অতিক্রম করে (২০ কিমি) ভালুকা পর্যন্ত পৌঁছানো ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
২৪শে জুন আফসার বাহিনী-র সহকারী কমান্ডার মো. আনছার উদ্দিন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাকবাহিনীর ভালুকা থানার দিকে আগমনের খবর জানতে পারেন। প্রথমে আনছার উদ্দিন কয়েকজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে পাকসেনাদের শিবগঞ্জ বাজারে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করেন। পরে তিনি কৌশলগত কারণে ভাওয়ালিয়াবাজু নামক স্থানে সূতিয়া নদী পার হয়ে নদীর বিপরীত তীরে (পশ্চিম পাশে) পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। নদীর তীর ঘেঁষে বাংকার খুঁড়ে তিনি সুদৃঢ় অবস্থান নেন।
২৫শে জুন সকাল ১০টার দিকে পাকসেনাদের দলটি ভাওয়ালিয়াবাজুর সূতিয়া নদীর ফেরিঘাটের সামনে এসে উপস্থিত হয়। পাকিস্তানি সেনা কমান্ডার পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর তার বাহিনী ফেরি নৌকা দিয়ে নদী পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে একদল পাকসেনা নদীর পার্শ্ববর্তী উঁচু পার থেকে নিচে নেমে এসে ফেরি নৌকায় ওঠার জন্য জড়ো হতে থাকে। হানাদাররা আয়ত্তের মধ্যে চলে এলে পশ্চিম পাড়ে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা লাইট মেশিনগান ও রাইফেল দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকসেনাদের একটি অংশ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নিহত হয়। নদীর পাড়ে অবস্থানরত অন্য পাকসেনারা পজিশন নিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। তাদের ভারী মেশিনগানের গুলিতে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অল্প হলেও সুরক্ষিত অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করায় পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণ তাঁদের কাবু করতে পারেনি। সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। : বেলা ১টার দিকে মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন এবং যুদ্ধের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মেজর আফসার দায়িত্ব নেয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়। নদী অতিক্রম করতে না পারায় থেমে-থেমে যুদ্ধ চলতে থাকে। রাতে আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে যুদ্ধে যোগ দেন।
২৬শে জুন সকাল থেকে শুরু হয় অবিরাম যুদ্ধ। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদাররা ঢাকায় যোগাযোগ করে। দুপুরের দিকে যুদ্ধরত পাকবাহিনীর সমর্থনে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের পেছনে ধলিয়া গ্রামে হেলিকপ্টারযোগে ছত্রীসেনা নামতে শুরু করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলে তাঁরা অবস্থান ছেড়ে পিছু হটেন। ভাওয়ালিয়াবাজুর ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১৯৫ জন সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান (পিতা তাহের আলী, মল্লিকবাড়ী) শহীদ এবং পার্শ্ববর্তী হোসেনপুর থানার আফাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, গফরগাঁওয়ের বারবাড়িয়া গ্রামের মোস্তফা কামাল, ভালুকা থানার পনাশাইল গ্রামের মজিবুর রহমান আহত হন। ভাওয়ালিয়াবাজু যুদ্ধের খবর আকাশবাণী- ও বিবিসি- ফলাও করে প্রচার করে। ভাওয়ালিয়াবাজু যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ (ধামশুর; আফসার বাহিনীর প্রধান), শাহ মো. আনছার উদ্দিন মাস্টার (খাগাটি, ত্রিশাল), সেনাসদস্য নাজিম উদ্দিন (রাজেন্দ্রপুর, গাজীপুর), মোমতাজ উদ্দিন (বান্দিয়া), বশির উদ্দিন (ডাকাতিয়া), অনিল সাংমা (মল্লিকবাড়ী), আইয়ুব আলী (রায়মনি, ত্রিশাল), হাসমত আলী (বারা, গফরগাঁও), কালু (বারবাড়িয়া, গফরগাঁও), মোসলেম উদ্দিন (মল্লিকবাড়ী), নারায়ণ চন্দ্ৰ পাল (মল্লিকবাড়ী), মো. খলিলুর রহমান (ধামশুর), সিরাজুল হক (ভালুকা), আশরাফ উদ্দিন (মেদিলা), মোসলেম উদ্দিন দারোগা (আড়াইপাড়া, সখিপুর), ডা. আবুল হোসেন (মল্লিকবাড়ী), আ. রাজ্জাক (মেদুয়ারী), মো. আমজাদ হোসেন (মল্লিকবাড়ী), মো. আজিম উদ্দিন (বান্দিয়া), মো. তফির উদ্দিন তালুকদার (গোয়ারী), মো. চান মিয়া (ঝালপাজা), শাহ আলী আকবর (ভালুকা), মো. আব্দুল কাদের (নিশাইগঞ্জ), মো. শামছুদ্দিন (আংগারগাড়া), মো. খোরশেদ আলম (ডাকুরিয়া), মো. শহিদুল ইসলাম (কাচিনা), মো. লিয়াকত আলী (কুল্লাব) প্রমুখ। [মো. শফিকুল ইসলাম কাদির]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড