You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.29 | বোরহানউদ্দিন বাজার যুদ্ধ (বোরহানউদ্দিন, ভোলা) - সংগ্রামের নোটবুক

বোরহানউদ্দিন বাজার যুদ্ধ (বোরহানউদ্দিন, ভোলা)

বোরহানউদ্দিন বাজার যুদ্ধ (বোরহানউদ্দিন, ভোলা) সংঘটিত হয় ২৯শে অক্টোবর। এতে ১ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ২০-২৫ সাধারণ মানুষ শহীদ হন। অপরদিকে জনতার হাতে একজন পাকসেনা নিহত হয়।
বাজারে ছিল বোরহানউদ্দিন থানা। বাজারের মাঝ দিয়ে ভোলা-চরফ্যাশন সড়ক চলে গেছে। ২৭শে অক্টোবর বাংলাবাজার যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা ২৮শে অক্টোবর রাতে বোরহানউদ্দিন বাজারের বশির মিয়ার ঘরে রেজি-ই-করিম চৌধুরী (চুন্নু মিয়া) এমপিএ, বশির আহম্মেদ মিয়া, মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরী, হাইকমান্ড মো. সিদ্দিকুর রহমান, সামছু মিয়া, মাকসুদুর রহমান, আচমত মিয়া, ল্যান্স নায়েক মো. সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ বৈঠক করে বাংলাবাজারের যুদ্ধসহ ভোলায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বোরহানউদ্দিন বাজার আক্রমণের আশঙ্কায় বাজারের চারপাশে পাহারা জোড়দার করার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বোরহানউদ্দিন খেয়াঘাট ও লঞ্চঘাটে পাহারার দায়িত্ব নেয় হাইকমান্ড সিদ্দিকুর রহমানের গ্রুপ। বাজারের উত্তর ও পশ্চিম দিকে পাহারার দায়িত্ব নেয় আচমত মিয়ার গ্রুপ। বাজারের বিভিন্ন স্থানে ও বোরহানউদ্দিন হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন রেজি-ই-করিম চৌধুরী (চুন্নু মিয়া) এমপিএ। খাবারের দায়িত্ব নেন বশির আহম্মেদ মিয়া, সৈয়দ ডাক্তারসহ সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা। বাজারের ব্যবসায়ীরা তাদের সহযোগিতা করেন।
বোরহানউদ্দিন বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের জমায়েত হওয়ার খবর পেয়ে ভোলায় অবস্থানরত পাকবাহিনী ২৮শে অক্টোবর সকালে বোরহানউদ্দিনের পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদী হয়ে বোরহানউদ্দিন খালের দিকে লঞ্চযোগে ঢোকার চেষ্টা করলে আচমত মিয়ার গ্রুপ শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলি পর পাকবাহিনী পিছু হটে। ২৯শে অক্টোবর ভোররাতে পাকবাহিনীর ৮০-৮৫ জনের একটি দল লঞ্চযোগে বোরহানউদ্দিন খালে ঢোকার সময় মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চটিকে চর গঙ্গাপুরে আক্রমণ করেন। ঐ সময় পাকবাহিনীর গুলিতে আলতাফ হোসেন মারা যান। মুক্তিযোদ্ধাদের বাধা দান পাকবাহিনীকে প্রতিহত করতে পারেনি। তারা গুলি করতে-করতে বোরহানউদ্দিনে এসে পৌছায়। বোরহানউদ্দিনে পৌঁছে পাকসেনারা বোরহানউদ্দিন থানার সার্কেল অফিসার সিরাজুল ইসলামের বাসায় ঢুকে তাঁকে ও তাঁর শ্যালক গিয়াসউদ্দিন সেন্টু, রতন ও বাসার অন্যান্যদের মারধর করে বন্দি করে। এরপর শুধু সিরাজুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তারা বাজারের দিকে যেতে থাকে। এদিকে ভোলা থেকে সড়ক পথে ২০-২৫ জন পাকসেনার একটি দল বাজারের উত্তর পাশে এসে স্কুলে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ- সময় সার্কেল অফিসারকে ধরে সঙ্গে নিয়ে আসা পাকবাহিনীর দলটি বাজারে ঢুকে অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে-করতে বাজারের উত্তর পাশে ব্রিজের ওপর অবস্থান নিয়ে স্কুলের দিকে গুলি চালাতে থাকে। স্কুলে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ত্রিমুখী সংঘর্ষ চলাকালে সার্কেল অফিসার সিরাজুল ইসলাম স্কুলের সামনের ব্রিজ থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। স্কুল ও বাজারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সকলে পিছু হটে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে সক্ষম হন। তবে মুক্তিযোদ্ধা দুলাল গ্রামের সাধারণ মানুষ সফিজল পাটোয়ারী, ওহাব পাটোয়ারী, কাঞ্চন, হাসমত মাস্টার, মজিবল কেরানী, আব্দুল হাকিম, নুরুল ইসলাম মাস্টার, আজহার বেপারী, ইসমাইলসহ ২০ থেকে ২৫ জন যুদ্ধে শহীদ হন এবং একজন পাকসেনা গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয়। অতঃপর পাকবাহিনী বাজারে মোফাজ্জল বাকলাই, খলিল বাকলাই, ফরহাদ বাকলাই, সৈয়দ ডাক্তার, জেবল পঞ্চায়েত, বাচ্চু মিয়া, নসু মিয়া, গফুর চৌধুরী, আলী আহম্মদ বেপারী, বশির আহম্মেদ মিয়ার বাসা ও দোকানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ ব্যাপক ধ্বংষযজ্ঞ চালায়। এরপর পাকবাহিনীর এই দলটি বোরহানউদ্দিনের পূর্বদিকে বোরহানগঞ্জ বাজারে গিয়ে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন করে বিকেলে বোরহানউদ্দিন ফিরে আসে। বোরহানউদ্দিন এসে তারা ওসিএলএসডি আব্দুল ওহাব ও তার পরিবারকে নিগৃহীত করে ও লুটপাট চালায়। তারা সার্কেল অফিসারের কার্যালয়ে গিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে তিনজনকে দাঁড় করিয়ে গুলি করলে দুই জন মারা যান। ঘটনাক্রমে গুলিবিদ্ধ হয়েও গিয়াসউদ্দিন সেন্টু নামে একজন বেঁচে যান। বোরহানউদ্দিন বাজার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন হাইকমান্ড মো. সিদ্দিকুর রহমান, আচমত মিয়া, হাবিলদার সামছু মিয়া, ল্যান্স নায়েক মো. সিদ্দিকুর রহমান, মাকসুদুর রহমান প্রমুখ। [শিমুল চৌধুরী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড