You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.19 | বৈলগ্রাম ব্রিজ যুদ্ধ (রাজৈর, মাদারীপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

বৈলগ্রাম ব্রিজ যুদ্ধ (রাজৈর, মাদারীপুর)

বৈলগ্রাম ব্রিজ যুদ্ধ (রাজৈর, মাদারীপুর) সংঘটিত হয় দুবার – ১৯শে নভেম্বর ও ৩রা ডিসেম্বর। মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট-রাজৈর-মস্তফাপুর সড়কে টেকেরহাট ও রাজৈরের প্রায় মধ্যবর্তী স্থানে বৈলগ্রাম ব্রিজ অবস্থিত। এখানেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুটি যুদ্ধ হয়। প্রথম যুদ্ধে ৯ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও কয়েকজন রাজাকার আহত হয় এবং দ্বিতীয় যুদ্ধে পাকসেনারা পিছু হটে।
১৯শে নভেম্বরের যুদ্ধ ছিল মূলত রাজৈর থানা আক্রমণ পরিকল্পনার একটি অংশ। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা দুবার রাজৈর থানা আক্রমণ করেন। প্রতিবারই মাদারীপুর এ আর হাওলাদার জুটমিল ও টেকেরহাটের সেনাক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে থানার শক্তি বৃদ্ধি করায় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শত্রুদের বড় ধরনের ক্ষতি করা সম্ভব হয়নি। তাই রাজৈর থানা আক্রমণ শুরু হলে যাতে থানার সাহায্যে পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে আসতে না পারে, সেজন্য বৈলগ্রাম ব্রিজের পাশে রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা মাইন পুঁতে এম্বুশ করেন। নভেম্বর মাসের মধ্যভাগে ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ শেষে প্রচুর অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ শাজাহান খানের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর শতাধিক সদস্যের একটি দল রাজৈর থানা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এ এলাকায় আগে থেকে সরোয়ার হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী এবং থানা কমান্ডার এম এ কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল অবস্থান করছিল। তাঁরা আব্দুল কাইয়ুম মীর, শেখ সেকেন্দার আলী, আমিন উদ্দিন বাওয়ালী, শেখ আক্কাছ আলী, এ কে ফজলুল হক মোল্লা, নজরুল ইসলাম পান্না প্রমুখ কমান্ডারের নেতৃত্বে হোসেনপুর, ইশিবপুর, পাখুল্ল্যা, গয়লাবাড়ি ও কদমবাড়ি গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করেন। শাজাহান খানের দল আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের জনবল ও অস্ত্রশক্তি উভয়ই বৃদ্ধি পায়। ফলে রাজৈর থানার সকল ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে নবোদ্যমে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়।
রাজৈর থানা আক্রমণের জন্য ৪০-৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সরওয়ার হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে থানা ভবন রেইড করে। ১৮ জনের আরেকটি দল শাজাহান খানের নেতৃত্বে বৈলগ্রাম সিএন্ডবি রোডে এম্বুশ করে। এখানে ছোট একটি ব্রিজ ও আশেপাশে কয়েকটি ঘর ছিল। এ দলের দায়িত্ব ছিল সাহায্যকারী শত্রুদলকে প্রতিহত করা। ১৮ জনের দল আবার দুভাগ হয়ে পরিখা খুঁড়ে অবস্থান নেয়। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন কাজী আবুল হোসেন। অন্য দলে নেতৃত্ব দেন আব্দুল কাইয়ুম মীর। ব্রিজে এন্টি পার্সোনাল মাইন পুঁতে রাখা হয়।
পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯শে নভেম্বর সরোয়ার হোসেন মোল্লা থানা আক্রমণ ও শাজাহান খান বৈলগ্রাম ব্রিজ এম্বুশে নেতৃত্ব দেন। প্রথমে বৈলগ্রামের একটি বাড়ির লোকজনকে সরিয়ে দেয়া হয়। রাস্তার দুপাশে এম্বুশ করা হয় যাতে শত্রুরা ক্রস ফায়ারে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শাজাহান খান ছাড়া আর কেউ মাইন পুঁততে জানতেন না। রাস্তা খুঁড়ে মাইন বসিয়ে তার টানতে গিয়ে তারের ঘাটতি পড়ে। তখন দুটি মাইনের জন্য মাত্র একটি নেগেটিভ ব্যবহার করা হয়। একটা রান্নাঘরের বেড়া খুলে ভিটির আড়ালে সুইস হাতে মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইরাদ অবস্থান নেন। পরিকল্পনা মাফিক সরওয়ার হোসেনের নেতৃত্বে রাজৈর থানা আক্রান্ত হলে টেকেরহাট থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি ট্রুপস্ মুভ করে রাজৈরের দিকে। এদিকে মাইনের তার শর্ট পড়ার কারণে শফিকুল ইরাদকে চাইনিজ স্টেনের ঠিক ব্যারেলের সামনে শুয়ে থাকতে হয়। পাকিস্তানি সেনারা মাইনের কাছাকাছি আসতেই শফিকুল ইরাদ তারে টান দেন। শাজাহান খান প্রথম ফায়ার শুরু করেন। ইরাদের মাথার উপর দিয়েই তিনি ফায়ার করেন। এটি খুবই বিপজ্জনক অবস্থা ছিল। ইরাদ একপাশে গড়িয়ে ক্রলিং করে শাজাহান খানের পাশে চলে যান। তার সংযোগের ত্রুটির কারণে মাত্র একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। এতে ৯ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও কয়েকজন রাজাকার আহত হয়। স্প্রিন্টারের আঘাতে রফিক হাওলাদার নামে একজন রাজাকার কমান্ডার আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি|
বৈলগ্রাম ব্রিজের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় ৩রা ডিসেম্বর সকালে। বরিশালগামী পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি বহরের ওপর আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণ করলে এক ঘণ্টা স্থায়ী তীব্র যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে পাকবাহিনীর গাড়ি বহর পিছু হটে টেকেরহাট ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। [শেখ নাছিমা রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড