রিশালের বানারীপাড়া অঞ্চলের স্থানীয় বাহিনী ‘বেণু বাহিনী’ (বানারীপাড়া, বরিশাল)
বেণু বাহিনী (বানারীপাড়া, বরিশাল) মুক্তিযুদ্ধকালে বরিশালের বানারীপাড়া অঞ্চলে বেণীলাল দাশগুপ্তের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্থানীয় বাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা এবং স্থানীয় দোসরদের লুটতরাজ বন্ধের লক্ষ্যে বাহিনীর তৎপরতা শুরু। বিপ্লবী রাজনীতিতে বিশ্বাসী বেণীলাল দাশগুপ্ত ১৯৪২ সালে বানারীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বীরেন মোহন দাশগুপ্ত। বেণীলাল ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে গাভা হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ছোটবেলায় পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রগতিশীল রাজনীতিতে হাতেখড়ি হলেও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাঁর ছাত্ররাজনীতির কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটে। তিনি ভাসানী ন্যাপের বানারীপাড়া থানার সভাপতি ছিলেন|
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সময় তিনি ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঐ ভাষণে ছিল স্বাধীনতার প্রস্তুতি গ্রহণের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। বেণীলাল বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ৭ই মার্চের পর তিনি কর্মস্থল গাভা হাইস্কুলে ফিরে আসেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫শে মার্চের গণহত্যা তাঁকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে। বরিশাল শহর এপ্রিলের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়। ফলে বহু মানুষ শহর ছেড়ে দূরবর্তী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নেয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বিল সদৃশ্য গাভা- নরেরকাঠী, বানারীপাড়া ও স্বরূপকাঠি এলাকাতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার সঙ্গে-সঙ্গে স্থানীয় দোসররা বাড়িঘর বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘর লুটপাট শুরু করে। বেণীলাল এমন পরিস্থিতিতে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের লুটপাট বন্ধের লক্ষ্যে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। শুরুর দিকে তাদের প্রধান কাজ ছিল হানাদারদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট বন্ধ করা এবং লুট হওয়া মালামাল মালিকদের ফেরত দেয়া। ধীরে-ধীরে এ বাহিনী গোটা বানারীপাড়া অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় বেণু বাহিনী নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। এ বাহিনী কয়েকটি সেকশনে বিভক্ত ছিল। এর কমান্ডারগণ ছিলেন আবদুর রশীদ, কাজী মতিউর রহমান, কেশবচন্দ্র দাশ, হাসান আলী, মোসলেম খান প্রমুখ।
এ বাহিনীর প্রথম ক্যাম্প ছিল গাভার বুড়ি বাড়ি, ২য় ক্যাম্প ছিল গাভার কমলা রানীর বাড়ি, ৩য় ক্যাম্প ছিল গাভা হাইস্কুলের হেডমাস্টারের কোয়ার্টার্স (বিল্ববাড়ি)। এ ছাড়াও স্বরূপকাঠি থানার নরেরকাঠী এবং বানারীপাড়ার বড় বণিকের বাড়িতে এ বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। এ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল বানারীপাড়া, উজিরপুর থানার গুঠিয়া, ঝালকাঠি জেলার গাভা রামচন্দ্রপুর ইউনিয়ন এবং স্বরূপকাঠি থানার একটি অংশ। বেণু বাহিনী একটি সর্বদলীয় রূপলাভ করে। এ বাহিনী ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর ন্যাপ, কমিউনিস্ট, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং প্রগতিশীল রাজনীতির সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। ৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর বেণু বাহিণীর অস্তিত্ব মেনে নিয়ে তাদের সহযোগিতা করেন।
বেণু বাহিনীর নিয়ন্ত্রাধীন এলাকাগুলো ছিল ছোট-বড় খাল দ্বারা বিভক্ত। পাকিস্তানি বাহিনী গানবোট নিয়ে এসব এলাকায় প্রবেশ করলে তাদের সঙ্গে বেনু বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। এসব সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পরবর্তীতে খুব সংঘবদ্ধ বড় দল ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী এসব এলাকায় আসত না।
বেণু বাহিনী স্থানীয়ভাবেই প্রশিক্ষণ নিত। তবে পরবর্তীতে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া অনেকে এ বাহিনীতে যোগদান করেন। এ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ। এ বাহিনীর অধিকাংশ অস্ত্র সংগৃহীত হয় বানারীপাড়া থানা দখল এবং রাজাকারদের কাছ থেকে। বেণু বাহিনীকে স্থানীয় লোকজন বিভিন্নভাবে সাহায্য করত।
বানারীপাড়া থানায় বেণু বাহিনী ও সিরাজ শিকদারের বাহিনী সমন্বিত আক্রমণ করে থানা দখল করে। থানা দখল আক্রমণে পুলিশের দুজন সদস্য নিহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী বানারীপাড়া বন্দর দখল করতে এলে বেণু বাহিনীর সঙ্গে চার ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ হয় এবং দেলোয়ার নামে বেণু বাহিনীর এক সদস্য শহীদ হন। সেদিন রাতে বেণু বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা করে এবং বহু পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এ সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি বাহিনী বানারীপাড়া ছেড়ে চলে যায় এবং বেণু বাহিনী এখানে মুক্ত অঞ্চল হিসেবে চলাফেরা শুরু করে। এরপর বেণু বাহিনী বরিশাল শহর দখলে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
যুদ্ধ শেষে এ বাহিনী পিরোজপুর সাব-ডিভিশনে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ও গুলি জমা দেয়। যুদ্ধপরবর্তী দেশ পুনর্গঠনে এ বাহিনীর সদস্যগণ সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এ বাহিনীর অনেকে সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় যোগদান করেন এবং বেণীলাল দাশগুপ্ত শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান। [আবুল বাশার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড