বেতাগী বেসামরিক সহায়ক কমিটি (বেতাগী, বরগুনা)
বেতাগী বেসামরিক সহায়ক কমিটি (বেতাগী, বরগুনা) ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার – (যা মুজিবনগর সরকার- নামে পরিচিত) গঠিত হওয়ার পর বেতাগীতে প্রবাসী সরকারের পক্ষে গণপ্রশাসন গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহায়তার জন্য একটি বেসামরিক সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি বেসামরিক প্রশাসনিক ইউনিটের ন্যায় কার্যক্রম শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে জনমত তৈরি ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সহায়ক কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর কর্যক্রম উপজেলার অগণিত মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে সহায়তা করে। সহায়ক কমিটি এখানকার মুক্তিবাহিনীর থাকা-খাওয়া, নিরাপদ আশ্রয়, প্রশিক্ষণ প্রদান, যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি, স্থানীয় কর্মচারীদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধকরণ, সরকারের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ, রসদ সরবরাহ, সুষ্ঠুভাবে বিচার কার্য সম্পাদন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পরিকল্পিতভাবে মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা ও থানা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে সহায়তাদানের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে লড়াই চালিয়ে যেতে উদ্ধুদ্ধ করে।
সেনাবাহিনীর উপ-ল্যান্স নায়েক মো. মোতালেব সিকদার থানা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পাওয়ার পর অস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে বেসামরিক নাগরিকদের ব্যবহৃত বন্দুক সংগ্রহের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এরপর বেসামরিক সহায়ক কমিটির উদ্যোগে একাধিক রাইফেল, পিস্তল ও বন্দুক সংগ্রহ করে কার্যক্রম শুরু হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে ৭টি বন্দুক সংগৃহীত হয়। এ অঞ্চলের মুক্তিকামী জনতা ব্যাপকভাবে সহায়ক কমিটির কার্যক্রমে অংশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে। অনেক পরিবারের নারী সদস্যরাও এতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
বেতাগীতে কর্মরত ডেভেলপমেন্ট অফিসার (সিও) মো. আব্দুল হাই বেসামরিক সহায়ক কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৫ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। সহায়ক কমিটি বেতাগী, বরগুনা, মির্জাগঞ্জসহ আশ- পাশের মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ সরকারের অধীনে নিয়ে আসে। কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৯নং সেক্টরের অধীনস্থ গ্রুপ কমান্ডার (থানা কমান্ডার) ক্যাপ্টেন মো. আলতাফ হায়দার এগিয়ে এলে এ জনপদে মুক্তিসংগ্রাম সর্বজনীন গণযুদ্ধে রূপ নেয়। এর ফলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এ-সময় বেতাগীকে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। কাজিরাবাদের সাবেক চেয়ারম্যান সুখরঞ্জন রায়ের ওপর দক্ষিণাঞ্চল এবং বিবিচিনির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের গাজীর ওপর উওরাঞ্চলের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের দিকনিদের্শনার জন্য সহায়ক কমিটির অন্যতম সংগঠক হুমায়ুন কবির হিরু (স্বাধীনতা উত্তর জাসদ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত) ভারতে গমন করেন। সহায়ক কমিটির অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় বুড়ামজুমদারের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম মিয়ার ওপর। তিনি এখানকার সকল ধরনের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। সহায়ক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্যে আরো ছিলেন— বেতাগী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আ. আজিজ হাওলাদার, শিক্ষানুরাগী শাহাবউদ্দিন সিকদার, মনোরঞ্জন বল, হোসনাবাদের সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মাতবর, ফজলুল হক মাস্টার, মোকামিয়ার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান হামেজ আলী ডাক্তার, সড়িষামুড়ির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ খান ও মনোয়ার হোসেন শাহজাহান।
পাকবাহিনীর দোসর শান্তি কমিটির সদস্যরা হিন্দু সম্পত্তি লুটপাট ও নির্যাতনসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে এ কমিটি পাকবাহিনীর স্থানীয় দোসরদের বিরুদ্ধে বিশেষ অপারেশন কার্যক্রম শুরু করে। ফলে লুটপাটের মাত্রা কমে আসে এবং দালালরা অধিকাংশই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়। এতে সহায়ক কমিটির ওপর জনগণের আস্থা বেড়ে যায়। করুনা মাতব্বর বাড়ির স্কুল ও দেশান্তরকাঠি খ্রিস্টান পাড়ায় মুক্তিবাহিনীর দুটি স্থায়ী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং বেসামরিক প্রশাসন চালু হয়। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলের জাতীয় পরিষদ সদস্য আসমত আলী সিকদারের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শাহজাদা আব্দুল মালেক খান বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে আগস্ট মাসে ভারতে যান। নভেম্বর মাসে তিনি বশিরহাটের আমনালী ক্যাম্প স্থাপনসহ দু-দফায় শতাধিক যুবককে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
বেতাগী থানা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট সে-সময় বরগুনা জেলার মধ্যে সবচেয়ে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী ইউনিট ছিল। এ ইউনিট গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। অক্টোবর মাসের শেষদিকে পটুয়াখালী সাব-সেক্টর কমান্ড থেকে দুদফায় দুজন নন-কমিশন সেনাকর্মকর্তাকে বেতাগী ইউনিটের অধিনায়কত্ব প্রদান করা হয়। এ-সময় চান্দখালী বন্দরকে কেন্দ্র করে বেতাগী, বরগুনা ও মির্জাগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ গড়ে ওঠে। সহায়ক কমিটি তাদের অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় শামিল হয়। এভাবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সহায়ক কমিটি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে বেতাগীবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। [সাইদুল ইসলাম মন্টু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড