You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বেগমগঞ্জ উপজেলা (নোয়াখালী) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বেগমগঞ্জ উপজেলা (নোয়াখালী)

বেগমগঞ্জ উপজেলা (নোয়াখালী) ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ রেডিও পাকিস্তানের বিশেষ ঘোষণা বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোনো কারণ ছাড়াই ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এ অপ্রত্যাশিত সংবাদে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বেগমগঞ্জ উপজেলার মানুষও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র এ উপজেলার চৌমুহনী বাজারের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ মিছিল নিয়ে ডিবি রোড, গোলাবাড়িয়া ও মহেশগঞ্জসহ প্রধান-প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে এবং ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৩রা মার্চ দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতালের কর্মসূচি বেগমগঞ্জ উপজেলায় সফলভাবে পালিত হয়। সকল অফিস-আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। উপজেলার সকল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন নুরুল হক এমএনএ, মোহাম্মদ হানিফ এমএনএ, এডভোকেট মো. সাখাওয়াতুল্লাহ এমপিএ, গাজী আমিন উল্যা, ছাত্রনেতা মো. শাহজাহান, মোহাম্মদ উল্যা, সফিকুর রহমান প্রমুখ।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ পরের দিন ৮ই মার্চ রেডিওর মাধ্যমে এখানকার মানুষ শুনে তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান ও নির্দেশনাবলি জানতে পারে। এরপর ৮ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বেগমগঞ্জ উপজেলার মানুষ সর্বাত্মকভাবে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি (জেলা হেডকোয়ার্টার্স মাইজদীর মাধ্যমে প্রাপ্ত) পালন করে। অপরদিকে বিবিসি নিউজ, ভয়েস অব আমেরিকা ও আকাশবাণীর মাধ্যমে আন্দোলন-সংগ্রামের সংবাদ শুনে নিজেদের উদ্যোগে পরবর্তী প্রস্তুতি নিতে থাকে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে উপজেলার সর্বত্র বাড়ি- ঘরের ছাদ, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।
গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। নোয়াখালীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিমের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ২৬শে মার্চ জেলা হেডকোয়ার্টার্সের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জানার পর জেলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আবদুল মালেক উকিল এমএনএ আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের জন্য সকলকে সর্বশক্তি নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। সঙ্গে-সঙ্গে বেগমগঞ্জবাসী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা বেগমগঞ্জে পৌঁছার পরই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রনেতাদের আহ্বানে ছুটিতে থাকা, কর্মস্থল থেকে পালিয়ে আসা এবং অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর (পুলিশ, আর্মি ও নৌসেনা) সদস্যরা বেগমগঞ্জ হাইস্কুল ময়দান, চৌমুহনী কলেজ ময়দান, একলাশপুর, ছয়ানী বাজারসহ জমিদার হাট, বাংলা বাজার ও রাজগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে, মাঠে-ময়দানে ছাত্র-যুবকদের নিয়ে ডামি বন্ধুক ও লাঠি দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এপ্রিল মাসে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-জনতা দেশমাতৃকার টানে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য কুমিল্লা ও ফেনী সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। গণিপুর গ্রামের আবুল হোসেন বাঙ্গালী (এসএসসি পরীক্ষার্থী) জুন মাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে প্রবেশ করেন। আসামের লোহারবন ক্যাম্পে ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে আগস্ট মাসে তিনি ফেনীর বিলুনিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সাব-সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাফর ইমামের অধীনে পরশুরামে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে নোয়াখালীতে এসে তিনি কমান্ডার নুরুল হকের অধীনে বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল, সোনাইমুড়ী, বজরা ও বাংলা বাজার অপারেশনে অংশ নেন। সোনাইমুড়ী অপারেশনে তিনি আহত হন।
উপজেলার শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেলা ও থানার সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা হলেন- নুরুল হক এমএনএ, সাখাওয়াতুল্লাহ এমপিএ, অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ এমএনএ, মোহাম্মদ উল্যা, মো. শাহজাহান, মো. জাফর উল্যা, কারী করিম উল্যা, গাজী আমিন উল্যা, সফিকুর রহমান প্রমুখ। প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান। বেগমগঞ্জ থানা সদর থেকে আনুমানিক ৯ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে গোপালপুর বাজারে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ছাত্র ইউনিয়ন – নেতা আবু কায়েস মাহমুদ, মোহাম্মদ মোহসীন দুলাল, জাকির হোসেন, মাহমুদুল হাসান চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ এলাকার চিকিৎসক ডা. আনিসুল ইসলাম, ছাত্রনেতা নিমচন্দ্র ভৌমিক, সাহাব উদ্দিন মিন্টু ও স্থানীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়। এখানে গড়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং সেন্টার, যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্জয় ঘাঁটি।
এ উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন- কারী করিম উল্যা (এফএফ), ডা. এ বি এম জাফর উল্যা (বিএলএফ), ছায়েদুল হক ছাদু (এফএফ), মো. শফিকুর রহমান (এফএফ), সিরাজুল আলম খান (বিএলএফ, উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর অধিনায়ক), সাহাব উদ্দিন মিন্টু (বিএলএফ), এ জেড এম শাহজাহান (বিএলএফ), আদুল মান্নান (বিএলএফ) ও ডাক্তার আনিসুল ইসলাম (বিএলএফ)।
এপ্রিল মাসের প্রথম থেকেই পাকহানাদার বাহিনী কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস থেকে বের হয়ে সড়কপথে লালমাই এবং রেলপথে লাকসাম হয়ে নোয়াখালী অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। এ খবর পেয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে ছুটিতে আসা সৈনিক সুবেদার লুৎফর রহমান তাঁর বাহিনী নিয়ে ৬ই এপ্রিল থেকে ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত দৌলতগঞ্জ, নাথেরপেটুয়া, বিপুলাসার সোনাইমুড়ীতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় জনগণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য বগাদিয়া, শাহবাজপুর ও রথিজোরার সড়ক ও রেলসেতু ভেঙ্গে ফেলে। সুবেদার লুৎফর রহমানের দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য নুরুল হক এমএনএ এবং ডিসি মঞ্জুরুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেনী থেকে বেশ কিছু গ্রেনেড ও যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করে। এসব হালকা অস্ত্র হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট নয় জেনেও মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে বাংকার গড়ে পাহারা দিতে থাকেন। স্থানীয় সাধারণ মানুষ তাঁদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। সাধারণ মানুষও মরিচের গুঁড়া, লবণের পানি ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিল। হানাদার বাহিনী সোনাইমুড়ী ও বেগমগঞ্জ হয়ে নোয়াখালীতে প্রবেশের সময় বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং দৌলতগঞ্জ ও লাকসামে পাকিস্তান বিমান বাহিনী হানাদারদের সহযোগিতা দেয়।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী বেগমগঞ্জ উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে এবং এখানকার চৌরাস্তায় অবস্থিত বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে।
আবুল কাসেমকে কমান্ডার করে বেগমগঞ্জে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। বাহিনীর অন্যান্য সদস্য হলো— আবদুল লতিফ, আফজল মিয়া, তফাজ্জল হক, আবদুল হক, জয়নাল আবেদীন, শামছুল হক, আবদুল হক, আবদুল মালেক, ইলিয়াস মিয়া, চৌধুরী মিয়া, আবদুর রব, আবুল কাসেম-২, কোরবান আলী সর্দার, মনুডুবালী, আবদুর রব-২, খোকা মিয়া, খোন্দকার আতাউর রহমান ও মনির আহম্মদ।
পাকবাহিনী এ উপজেলায় হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। তারা মিরওয়ারিশপুর গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন করে। ২২শে সেপ্টেম্বর তারা রসুলপুর ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামে নরেন্দ্রকুমার শূরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পাকসেনারা জুলাই মাসে হাসানহাটে পুলের ওপর আতিক উল্যাকে গুলি করে হত্যা করে। টেকনিক্যাল হাইস্কুলের নিচতলার পূর্ব-পশ্চিমের কক্ষের নির্যাতনকেন্দ্রে (বর্তমানে এটি টর্চার ‘৭১ জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত) তারা বহু মানুষকে নির্যাতন করে। ২৩শে এপ্রিল তারা জেলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনীতে অগ্নিসংযোগ করে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুণ্ঠন চালায়। ১৯শে আগস্ট পাকবাহিনী সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত গোপালপুর বাজারে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ৫০ জনের অধিক মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে হত্যা করে এবং গোপালপুর বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। হত্যার গোপালপুর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত।
বেগমগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনী বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। সেগুলো হলো- বেগমগঞ্জ চৌরাস্তার টেকনিক্যাল হাইস্কুল, কালী বাবুর গ্যারেজ (চৌমুহনীর বর্তমান সমবায় মার্কেট), কলেজ রোড (গার্লস হাইস্কুলের দক্ষিণে বিসমজিন ভবন), চন্দ্রগঞ্জ বাজার ক্যাম্প ও বাংলা বাজার শামছুন নাহার হাইস্কুল ক্যাম্প। বেগমগঞ্জ চৌরাস্তার সামান্য উত্তরে নোয়াখালী-লাকসাম রোডে নোয়াখালী খালের ওপর কালাপুল অবস্থিত। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী স্বাধীনতাকামী বহু মানুষকে ধরে এনে কালাপুলের ওপর গুলি করে হত্যা করে খালে ফেলে দেয়। এছাড়া বহু নারী-পুরুষকে এই কালাপুলে হত্যা করে এর সংলগ্ন মাঠে মাটিচাপা দেয়। এটি কালাপুল বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগমগঞ্জ উপজেলা ছিল নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এ উপজেলায় লোকসংখ্যা বেশি থাকায় মুক্তিবাহিনীর সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, বেগমগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়েই সড়ক ও নৌপথে চাঁদপুর, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াত করতেন। তৃতীয়ত, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিনা বাধায় এ উপজেলায় প্রবেশ করতে পারেনি। চতুর্থত, হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়া-আসার সময় পথে বেগমগঞ্জের প্রধান সড়ক ব্যবহার করত। পঞ্চমত, পাকবাহিনী বেগমগঞ্জের চৌরাস্তার ক্যাম্পকে চতুর্দিকে অর্থাৎ মাইজদী হেডকোয়ার্টার্স, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীতে অপারেশন করার জন্য সুবিধাজনক মনে করত। এসব কারণে দীর্ঘ ৯ মাসে এ উপজেলায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়।
৫ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনীর একটি দল সামরিক ভ্যানে করে ফেনী থেকে চন্দ্রগঞ্জ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এ খবর পেয়ে সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা রাস্তার পাশে ইটের স্তূপের আড়ালে এম্বুশ করেন। পাকবাহিনীর ভ্যানটি কাছাকাছি আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে তাদের ওপর আক্রমণ করেন।
চন্দ্রগঞ্জ বাজার যুদ্ধএ ২৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে সেখান থেকে সরে যেতে সক্ষম হন।
৬ই মে বাংলাবাজার সংলগ্ন ফেনাকাটা নামক স্থানে সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি সামরিক বহরকে আক্রমণ করলে যুদ্ধ হয়। ফেনাকাটা যুদ্ধএ ৩৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১০ই আগস্ট পাকবাহিনীর শতাধিক সৈন্য গোপালপুর দখল করার উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করলে তিতাহাজরা নামক স্থানে হাবিলদার জাবেদ আলীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাদের প্রতিরোধ করেন এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২ জন সদস্য নিহত ও ১৪ জন আহত হয়। গোপালপুর যুদ্ধএ হাবিলদার জাবেদ আলী, নায়েব হাসমত উল্যা, হাবিলদার মমতাজ, নজির আহম্মদ মোক্তার, সিপাহি সিরাজ, নায়েব সিরাজ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। ২৬শে আগস্ট পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগী মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন সুবেদার লুৎফর রহমান এবং সুবেদার ওয়ালী উল্লাহ। মুক্তিযোদ্ধারা ত্রিমুখী আক্রমণ করলে ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। আমিন বাজার যুদ্ধএ মুক্তিযোদ্ধারা ২১টি চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করেন।
২৬শে সেপ্টেম্বর রাজগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ২ দিন স্থায়ী এ-যুদ্ধে ২৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। রাজগঞ্জ যুদ্ধএ নেতৃত্ব দেন কমান্ডার হাসেম। ৭ই ডিসেম্বর বেগমগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নেভাল কমান্ডো ডা. মো. শাহ আলম, বীর উত্তম- (পিতা মো. আলী আহম্মদ চৌধুরী, করমূল্যাহপুর), মেজর মো. ইব্রাহিম, বীর বিক্রম (পিতা আইয়ুব আলী, মধুপুর), মো. আমান উল্লাহ, বীর বিক্রম (পিতা ইসমাইল মিয়া, হাটগাঁও), নায়েক নুরুজ্জামান, বীর বিক্রম (পিতা আরিফ মিয়া, জাহানাবাদ), দেলোয়ার হোসেন, বীর বিক্রম (পিতা আফিস উদ্দিন, ওয়াজকিপুর) সুবেদার আবুল কালাম, বীর প্রতীক (পিতা আফজাল হোসেন, লতিফপুর) ও গোলাম মোস্তফা, বীর প্রতীক (পিতা আবদুল রেজ্জাক, রামপাছরা)।
এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- দেলোয়ার হোসেন, বীর বিক্রম (১৩ই ডিসেম্বর ফেনী জেলার পাঠাননগর যুদ্ধে শহীদ), নায়েক নুরুজ্জামান, বীর বিক্রম (১০ই জুন চন্দ্রগঞ্জ যুদ্ধে শহীদ), মো. আমান উল্লাহ, বীর বিক্রম (১৩ই ডিসেম্বর খানসামা যুদ্ধে শহীদ), আবুল কাসেম (পিতা ওক্কাছ মিয়া, হোসেনপুর), ছালেহ আহম্মেদ মজুমদার (পিতা আবদুল ছালাম মজুমদার, মিরওয়ারিশপুর), আবু তাহের চৌধুরী (পিতা মো. ইউনুছ মিয়া, মহেশপুর), সফি উল্যাহ (পিতা মোবারক আলী ভূঞা, মনপুরা), চাঁদ মিয়া (পিতা সৈয়দ মিয়া, মুজাহিদপুর), আবু সুফিয়ান (পিতা সুলতান মিয়া, একলাশপুর), মুজিবুল হক (পিতা মজুহার মিয়া, পশ্চিম একলাশপুর), ইব্রাহিম (পিতা বদিউজ্জামান, জয়নারায়ণপুর), মো. আবু তাহের (পিতা ছিদ্দিক উল্যাহ, . মুজাহিদপুর), সিরাজ উদ্দিন (পিতা এমরাত উল্যাহ, নাজিরপুর), আমান উল্যাহ চৌধুরী ফারুক (পিতা হালিম উল্যাহ চৌধুরী, অম্বর নগর), সবুজ (পিতা ছিদ্দিক উল্যা মিয়া, মান্দারী), রবি (পিতা হরিমোহন সাহা, ভবানীগঞ্জ), ট্রুপ কমান্ডার হাসেম, গোলাম হায়দার, শফিকুর রহমান, কাজী আবু বকর ছিদ্দিক (পিতা কাজী মোখলেছুর রহমান, কাদিরপুর), আবদুল হক (পিতা আবদুল করিম, শরীফপুর), সাহাব উদ্দিন ইস্কেন্দার ভুলু (পিতা সেকান্দর মিয়া উকিল, কাদিরপুর), নুরুল হুদা (লক্ষ্মীনারায়ণপুর)।
বেগমগঞ্জ চৌমুহনী-চৌরাস্তা টেকনিক্যাল হাইস্কুলে ‘৭১ জাদুঘর’, বেগমগঞ্জ চৌমুহনী-চৌরাস্তায় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্কয়ার এবং আমান উল্যাপুর ইউনিয়নের ফাজিলপুর গ্রামে (বেগমগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর সড়কে) শহীদ রুহুল আমিন বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গোপালপুর গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। কাজীরহাট বাজারে শহীদ আমান উল্যা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয় মাঠে বিজয় মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চৌমুহনী কলেজের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সালেহ আহম্মদ কলেজ (এস এ কলেজ)। একলাশপুর ইউনিয়নে গাবুয়া থেকে হৈল্লার হাট পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর উত্তম ডা. শাহ আলম সড়ক এবং গোপালপুর ইউনিয়নের সাধুপুর গ্রামে (উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে) একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর বিক্রম মেজর মো. ইব্রাহিম সড়ক। [মো. ফখরুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড