You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বেড়া উপজেলা (পাবনা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বেড়া উপজেলা (পাবনা)

বেড়া উপজেলা (পাবনা) পাবনা জেলার একটি সমৃদ্ধ উপজেলা। পাবনা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এটি অবস্থিত। এর উত্তরে শাহজাদপুর ও চৌহালী থানা, দক্ষিণে গোয়ালন্দ ও রাজবাড়ী থানা, পূর্বে চৌহালী, দৌলতপুর ও শিবালয় থানা এবং পশ্চিমে সুজানগর ও সাঁথিয়া থানা। ১৯৮৩ সালে বেড়া থানা উপজেলায় উন্নীত হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনেই বেড়াবাসী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বেড়া থেকে যথাক্রমে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও আহমেদ রফিক আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার সুবাদে ঢাকার প্রতিদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে বেড়াবাসী অবহিত ছিল। অবশেষে ৭ই মার্চ বেড়ার আপামর জনতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে এক কাতারে মিলিত হয়। এভাবেই বেড়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ-এর উদ্যোগে বেড়া থানা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ৩২ জন যুবককে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ লক্ষ্যে বেড়া বিবি হাই স্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এখানে প্রশিক্ষণ দানের জন্য কমান্ডারের দায়িত্ব প্রদান করা হয় আব্দুল মজিদ মোল্লাকে। সহকারী কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় আনসার কমান্ডার আবেদ আলী এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক গোলজার হোসেনকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তারা হলেন- আব্দুল খালেক, জানে আলম, সুজাউদ্দিন, আব্দুস সাত্তার, বোরহান উদ্দিন, শুকুর আলী, জয়নাল আবেদিন, চাঁদ মিয়া, মজনু, মানিক, জয়গুরু প্রমুখ। প্রথমে প্যারেড, শরীরচর্চা, লাঠি-সোঁটা ও ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার শেখানো হয় এবং পরে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এভাবে অল্পদিনের মধ্যেই একটি প্রশিক্ষিত প্লাটুন গড়ে তোলা সম্ভব হয়। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে ঢোকার প্রবেশপথ ছিল বেড়া। তাই ঢাকা থেকে পাকসেনারা যাতে বেড়ায় প্রবেশ করতে না পারে এজন্য শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।
১৩ই মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ এবং আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ ঢাকা থেকে বেড়ায় আসেন প্রশিক্ষণ শিবিরের অগ্রগতি দেখতে। ১৪ই মার্চ থেকে শুরু হয় প্রকাশ্যে প্রশিক্ষণ। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য বেড়ায় পূর্বে গঠিত প্রশিক্ষণ শিবিরকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা হলেন— শামসুল হক টুকু, মো. আব্দুল লতিফ মনু, এস এম আমীর আলী, মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, মো. গোলজার হোসেন, ডা. আলাউদ্দিন এবং মো. আব্দুল হাই। ১৫ই মার্চ বেড়া বন্দরে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বেড়াবাসী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গোয়ালন্দঘাট শপথ গ্রহণ করে। ২৮শে মার্চ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ সহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা জরুরি ভিত্তিতে বেড়ার সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে ঢাকা থেকে পালিয়ে বেড়ায় আশ্রয় নেয়া লোকজনদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং বেড়ার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করাসহ পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ উদ্যোগ সফল করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাবকমিটি গঠন করা হয়। সাবকমিটির সদস্যবৃন্দ হলেন- মো. রইচ উদ্দিন, মফিজ উদ্দিন আহমেদ, মো. বদিউল আলম, আব্দুল লতিফ মনু, আব্দুল খালেক, আব্দুর রাজ্জাক (রাজা মিয়া), হাসেন আলী চৌধুরী, চাঁদ মিয়া, অনিল চন্দ্ৰ পাল, ডা. বি দাস, মঙ্গিলাল মাড়োরা এবং মফিজ উদ্দিন সরকার। এ কমিটির মুখ্য দায়িত্ব ছিল অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহ করা। ৩০শে মার্চ আওয়ামী লীগের আহ্বানে পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য কয়েক হাজার মানুষ লাঠি, ফলা, বল্লম ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বেড়া বিবি হাই স্কুল মাঠ এলাকায় হাজির হয়। জনসমাগম শেষে জনতার একটি জঙ্গি মিছিল সমগ্র বেড়া প্রদক্ষিণ করে। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার মিছিলের ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করলে স্বাধীনতাকামী জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
প্রশিক্ষণের এক পর্যায়ে ২৭শে মার্চ বেড়া থানা থেকে প্রচুর গোলাবারুদসহ ১১টি থ্রি-নট-থ্রি ও মার্কফোর রাইফেল সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু লাইসেন্স করা অস্ত্র সংগ্রহ ও নগরবাড়ী ঘাট পুলিশ ক্যাম্প থেকে ৪টি রাইফেল, প্রচুর গোলাবারুদ ও একটি স্পিডবোট সংগ্রহ করা হয়। এ সময় বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ ৮ জন বাঙালি সৈন্য এসে বেড়া ক্যাম্পে যুক্ত হন। দিনাজপুর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স থেকে দুটি ট্রাকে ২০ জনের অধিক ইপিআর বগুড়া হয়ে অস্ত্রসহ বেড়া ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। এ সময় সিরাজগঞ্জ এবং অন্যান্য স্থান থেকে বেশকিছু পুলিশ ও আনসার সদস্য অস্ত্রসহ তাদের সঙ্গে যোগদান করেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে বেড়ায় পাকহানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ প্রতিরোধযোদ্ধা মিলিয়ে প্রায় ৪০০ সদস্যের একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে ওঠে। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ এ সকল যোদ্ধার করমজা মাদ্রাসায় থাকার ব্যাবস্থা করেন। তাদের খাবারের দায়িত্ব নেন পাবনার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। এছাড়াও বেড়ার সাধারণ মানুষের উদ্যোগেও যোদ্ধাদের জন্য প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে ঢাকা থেকে পাকসেনাদের আগমন ঠেকাতে বেড়ার প্রতিরোধযোদ্ধারা যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
এপ্রিল মাসে নগরবাড়ি ও ডাববাগান যুদ্ধএর পর বেড়ার তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ভারত গমনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর গোপনে যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যায়। তারা সড়কপথ পরিহার করে গ্রাম-গঞ্জের রাস্তা ধরে অগ্রসর হতে থাকে এবং নৌকায় পদ্মা নদী পার হয়ে কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর হয়ে ভারতে প্রবেশ করে।
বেড়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে প্রতিরোধযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কুরমাইল ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁর সুষ্ঠু তত্ত্ববধানে কুরমাইল ক্যাম্প শ্রেষ্ঠ ক্যাম্পে পরিণত হয়। ১৩ই জুন মুজিবনগর সরকার-এর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান কুরমাইল ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও ৪০০ তরুণ তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। মন্ত্রী কুরমাইল ক্যাম্পকে ‘দি বেস্ট ক্যাম্প’ বলে আখ্যায়িত করেন। জুনের মাঝামাঝি এ ক্যাম্প থেকে ৯২৮ জনকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪০টির মতো ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল। প্রশিক্ষণার্থী ছিল প্রতি ক্যাম্পে গড়ে ৮০ জনের মতো। কুরমাইল ক্যাম্প থেকে ১৭০০ যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ নিজে ক্যাম্পটি পরিচালনা করতেন। বিস্ফোরক প্রশিক্ষণ দিতেন ক্যাপ্টেন ক্ষোধ। অস্ত্র প্রশিক্ষক ছিলেন সুবেদার বিল্লাল ও সুবেদার ইবরাহিম। ক্যাম্পটি সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করতেন ইলিয়াস, হাফেজ উদ্দিন, ফেরু মিয়া, মফিজ, আমজাদ প্রমুখ। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ কুরমাইল ক্যাম্পে বসেই বেড়ার সার্বিক অবস্থা অবগত হতেন। মজিদ মোল্লা, মনু মাস্টার এবং ব্যবসায়ী বকু মণ্ডলের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলত।
বেড়া উপজেলার কিছু তরুণ নদীয়ার কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ কুরমাইল ক্যাম্পের পরিচালক হওয়ায় বেড়া উপজেলার যুব সম্প্রদায় এ ক্যাম্পেই প্রশিক্ষণ নেয়। বেড়া এবং এর আশপাশ থেকে অধিক সংখ্যক তরুণদের কুরমাইল ক্যাম্পে আনার জন্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ বেড়ার মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক আলীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং তরুণদের পথ-খরচ বাবদ নগদ ১০ হাজার টাকা প্রদান করেন। এই টাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক আলী পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের অনেক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে একাধিকবার ভারত গমণ করেন। বেড়ার তরুণরা কুরমাইল ক্যাম্পে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ নিত। এ প্রশিক্ষণে যারা দক্ষতার পরিচয় দিত, তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের পানিঘাটায় পাঠানো হতো। বেড়ার অনেক তরুণ পশ্চিম দিনাজপুরের প্রতিরাম ইয়ুথ ক্যাম্পেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ ক্যাম্পে এক মাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। প্রশিক্ষণের ধরন ছিল পিটিপ্যারেড, হাতিয়ারে গুলি লোড- আনলোড, ফায়ারের পদ্ধতি ও শত্রুর নিকট থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়া ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন। আর পাতিরাম ইয়ুথ ক্যাম্প ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর। বেড়ার যে-সকল তরুণ ভারতে যেতে পারেনি, তারা বেড়া বিবি হাইস্কুল মাঠ ও করমজা মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে রাতের বেলায় আনসার কমান্ডার আব্দুল মজিদ মোল্লার নিকট অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিত|
৩১শে মার্চ পাবনা সদরের এমপিএ আব্দুর রব বগা মিয়ার নির্দেশে বেড়ায় অবস্থানরত প্রতিরোধযোদ্ধারা নগরবাড়ি ঘাটে গিয়ে অবস্থান নেন। ২রা এপ্রিল পাবনা সদর থেকে প্রায় ২০০ প্রতিরোধযোদ্ধা ৮টি জিপ, ৩০টি বড় বাস ও কয়েকটি ট্রাকে চেপে নগরবাড়ি ঘাটে এসে হাজির হন। পাকসেনাদের ঠেকাতে প্রতিরোধযোদ্ধারা বাঙ্কার তৈরি করে সামনের দিকে বালুর বস্তা সাজিয়ে ছোট-খাটো দুর্গ গড়ে তোলেন। ৪ঠা এপ্রিল সকাল দশটায় হানাদার বাহিনীর যুদ্ধ বিমান প্রতিরোধযোদ্ধাদের ওপর বোমা বর্ষণ শুরু করে। প্রতিরোধযোদ্ধারাও বাঙ্কার থেকে বিমান লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকেন। ৯ই এপ্রিল শুক্রবার নগরবাড়ি ঘাটে দুদফা এয়ার রেইড হয়। বিমানদুটি অনেক ওপর থেকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের ওপর বোমা বর্ষণ করতে থাকে। প্রতিরোধযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দিতে থাকেন। ১০ই এপ্রিল শনিবার সকালে পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ করে নগরবাড়ি ঘাটে চতুর্মুখী আক্রমণ শুরু করে। প্রতিরোধযোদ্ধাদের বাঙ্কারে টিকে থাকা বা বাঙ্কার থেকে পালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে এমন নাজুক অবস্থার মধ্যেও প্রতিরোধযোদ্ধারা সারাদিন যুদ্ধ চালাতে থাকেন। বিমান হামলার শিকার হয়ে ৪ জন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন অনেকেই। এটি নগরবাড়ি ঘাট প্রতিরোধযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য নগরবাড়ি থেকে ১০ মাইল উত্তরে পাইকারহাট ডাববাগানে বেড়ার প্রতিরোধযোদ্ধারা শক্তিশালী প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলেন। ১৯শে এপ্রিল আনুমানিক সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগরবাড়িঘাট থেকে থেকে পাকসেনাদের একটি কনভয় ডাববাগানের দিকে অগ্রসর হয় এবং দুপুর নাগাদ পাকবাহিনী গেরিলা কায়দায় ডাববাগানে অবস্থানরত প্রতিরোধযোদ্ধাদের ওপর হামলা শুরু করে। প্রতিরোধযোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হলে পেছন দিক থেকে হানাদার বাহিনীর অপর একটি দল আক্রমণ করে। ফলে প্রতিরোধযোদ্ধারা এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যান। প্রতিকূল অবস্থায়ও তাঁরা মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণে টিকতে না পেরে তাঁরা পশ্চাদপসরণ করতে থাকেন। প্রায় তিন ঘণ্টা স্থায়ী ডাববাগান প্রতিরোধ যুদ্ধে উভয়পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২জন অফিসারসহ প্রায় ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের মধ্যে ২৬ জন ইপিআর, ৫০ জন আনসার ও ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী শহীদ হন।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে উত্তরাঞ্চল পুনর্দখলের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ ব্রিগেড যমুনার পশ্চিমপাড় দিয়ে অগ্রসর হয়। এই ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিল ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব আরবাব। ১০ই এপ্রিল নগরবাড়ি দখলের পর পাকবাহিনী নগরবাড়ি ঘাটে ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর পাকবাহিনীর ৫৭ ব্রিগেড দুই অংশে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ ১০ই এপ্রিল রাতেই পাবনার দিকে রওয়ানা হয়। অপর অংশ বগুড়ার পথে অগ্রসর হলে পাইকারহাট ডাববাগানে শক্তিশালী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ১৯শে এপ্রিল ডাববাগান যুদ্ধের পর পাকবাহিনী বেড়ায় অনুপ্রবেশ করে বেড়া বন্দরে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা বেড়া বন্দরসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার্থে পাকহানাদার বাহিনী বেড়ার নগরবাড়ি ঘাটে শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। উত্তরবঙ্গের পাবনা, বগুড়া ও রাজশাহী দখলে রাখার জন্য নগরবাড়িই ছিল একমাত্র প্রধান রুট। তাই ভারী সমরাস্ত্র যেমন কামান ও বহু ট্যাঙ্কসহ পাকসেনারা এ ক্যাম্পে অবস্থান করত। পাকসেনারা বেড়া বন্দর ও নগরবাড়ি ঘাটে ক্যাম্প স্থাপনের পর পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ- ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে বেড়ায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল এডভোকেট আব্দুর রহিম (পিতা কছিম উদ্দিন প্রামাণিক, সানিলা)। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলো- আলহাজ রইচ উদ্দিন (সাহাপাড়া), ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম (করমজা), আবু হোসেন সরকার (শম্ভুপুর), আলহাজ এন্তাজ উদ্দিন (হাতিগাড়া), নুরু মিয়া (তালতলা), আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রাজা মিয়া (জোড়াদহ), এ কে এম রইচ (হাতিগাড়া) প্রমুখ। শান্তি কমিটির কাজ ছিল এলাকায় পাকিস্তানবিরোধী কোনো কার্যাকলাপ যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং তরুণদের তালিকা তৈরি করে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে জানানো। শান্তি কমিটির সদস্যরা তরুণদের ধরে এনে ক্যাম্পে হাজির করত। কোনো লোককে সন্দেহ হলেই পাকসেনারা কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করত। এ কাজে অবাঙালি পুলিশরা আর্থিকভাবে লাভবান হতো। কারণ কোনো তরুণ ধরা পড়লেই তাকে মুক্ত করার জন্য অভিভাবককে ক্ষেত্রবিশেষে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিহারি অথবা অবাঙালি পুলিশদের উৎকোচ দিতে হতো।
পাকবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় শান্তি কমিটির সদস্যরা সমাজের বিভিন্ন দুষ্কৃতিকারী ও পাকিস্তানপন্থীদের নিয়ে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে। পাকিস্তান সরকার ইপিআর-এর নাম পরিবর্তন করে বিহারিদের দিয়ে গঠন করে পাকিস্তান ডিফেন্স ফোর্স। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও জেলখানার দাগি আসামীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মিলিশিয়া বাহিনী। পাকিস্তান ডিফেন্স ফোর্স ও মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা ছিল রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহায়ক শক্তি। রাজাকার ও আলবদররা এলাকায় হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ চালায়। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অর্থ, অস্ত্র ও রেশন পেত। আলবদর বাহিনীর সর্বাধিনায়কের নাম ছিল মতিউর রহমান নিজামী (মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় অনুযায়ী ১০ই মে ২০১৬ ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়)। তার বাড়ি ছিল বেড়া সংলগ্ন সাঁথিয়া উপজেলায়। সে বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে অবলম্বন করে ৩১৩ জন সশস্ত্র যুবকের সমন্বয়ে এক-একটি ইউনিট গঠন করে। বেড়ায়ও সে একটি শক্তিশালী আলবদর ইউনিট গঠন করেছিল।
বেড়া উপজেলার রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হলো- মোজাহার মোল্লা (পায়না), ইজ্জাত বেপারী (পায়না), আজাহার খলিফা (বৃশালিখা), হামিদ মাস্টার (বৃশালিখা), মো. আব্দুল মান্নান (শম্ভুপুর), আসাদ (দত্তকান্দি), পিরু মিয়া (নতুন পাড়া), মো. ফরহাদ (পায়না), আবু সামা মন্ডল (হাতিগাড়া), লুৎফর রহমান (পায়না), মো. রাজা (পায়না), বাচ্চু মিয়া (শম্ভুপুর), চাঁদ আলী (নতুনপাড়া), রহম আলী (নতুনপাড়া), মোহাম্মদ আলী (বেতবাড়িয়া), মো. শহিদ মিয়া (নতুনপাড়া), আব্দুল মজিদ (সম্ভুপুর) প্রমুখ। আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিল মো. রফিকুল ইসলাম বাবলু (পিতা ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম, করমজা; মতিউর রহমান নিজামীর ঘনিষ্ঠ সহচর) এবং সদস্য হিসেবে তৎপর ছিল আব্দুল মজিদ (সম্ভুপুর)। এছাড়া পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল জামায়াতে ইসলামীর নেতা ব্যারিস্টার আনোয়ার-উল-ইসলাম, মুসলিম লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আলহাজ রইচ উদ্দিন ও ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম (স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে যুদ্ধের সময় জনতার হাতে নিহত) এবং জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মীর মোহাম্মদ আলী ঠান্টু মিয়া (পাকসেনাদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত, এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কুকীর্তির সঙ্গে জড়িত ছিল)।
৬ই এপ্রিল থেকে ১০ই এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাটের প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং ১৯শে এপ্রিল ডাববাগানের যুদ্ধে পরাজয়ের পর বেড়ার প্রতিরোধযোদ্ধারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। ২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী বেড়া থানার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং ঐদিনই তারা তাদের দোসরদের লেলিয়ে দেয় বেড়া বাজার লুট করার জন্য। বিকেল থেকে সারারাত লুটপাট চলে। ১৮ ঘণ্টার মধ্যে গোটা বেড়া বাজারের ধন-সম্পদ লুটেরাদের হস্তগত হয়। এরপর পাকবাহিনী বেড়ার মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের পাটের গুদামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ১০ লক্ষ মণ পাট পুড়ে ভস্মীভূত হয়। অপর দিকে পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয়ভাবে রাজাকার বাহিনী গঠন করে তাদের সহযোগিতায় আশপাশের গ্রামে অসংখ্য নারী-পুরুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতন শেষে রাস্তার পাশে গাব গাছে ঝুলিয়ে তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কখনো গুলি করে হত্যা করত। পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী বেড়া ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা অগণিত নারী-পুরুষকে ধরে পাশবিক অত্যাচার শেষে যমুনা নদীর তীরে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দিত।
যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ৪টি বিভাগকে ৪টি সেক্টরে ভাগ করেছিল। পাবনাকে তারা উত্তরবঙ্গের প্রধান ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে গড়ে তোলে। পাবনা ছিল ভারতের সীমান্ত থেকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ দূরত্বে। সম্ভবত নিরাপত্তার কথা ভেবেই তারা পাবনাকে প্রধান ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। আর পাবনার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল বেড়া উপজেলার নগরবাড়িতে। বেড়া সদরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু লোকের বসবাস ছিল। পাকবাহিনী হিন্দুদের বিশেষ শত্রু মনে করত। ফলে হিন্দুরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। রাস্তায় কোনো লোক দেখলেই হানাদাররা আইডেন্টিটি কার্ড চেক করত। হিন্দু না মুসলমান এটা নিশ্চিত হবার জন্য কাপড় খুলে পরীক্ষা করত। পাকসেনারা নুরু মিয়া, আলহাজ এন্তাজ উদ্দীন, রাজাকার পিরু মিয়া, আসাদ প্রমুখের দ্বারা গোটা বেড়া থানায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এরা গ্রামের পর গ্রাম বিশেষ করে হিন্দুপ্রধান এলাকায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণ চালায়, গ্রাম থেকে লুটপাট করে পাকবাহিনীর জন্য রসদ সংগ্রহ করে। তাদের হাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অসংখ্য লোক নিহত হয়। বহু নারীকে তারা পাকবাহিনীর লালসা মেটানোর জন্য তাদের হাতে তুলে দেয়। প্রায় ৮ মাস ধরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বেড়া, নগরবাড়ি, বাঘাবাড়ি এবং তালিমনগর এলাকায় ব্যাপক নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
পাকবাহিনী তাদের বেড়া বন্দরের ক্যাম্পকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। এছাড়া নগরবাড়িতে তাদের একাধিক টর্চার সেল ছিল। এসকল টর্চার সেলে শুধু বেড়া নয়, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে অগণিত নারী-পুরুষকে ধরে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ যমুনা নদীতে ফেলে দিত। আবার কখনো-কখনো লোকজন ধরে এনে হাত-পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে শরীরে নাইট্রিক এসিড ঢেলে দিত। মুহুর্তেই সারা শরীর গলে শরীরের সব হাড়গোর বের হয়ে যেত। এরকম অসংখ্য বিকৃত লাশ গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়। অনেক সময় মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে অর্ধমৃত ব্যক্তিকেও মাটির নিচে চাপা দেয়া হতো। হানাদার বাহিনী মেয়েদেরকে ক্যাম্পে উলঙ্গ করে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ক্ষত-বিক্ষত দেহটাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দিত। রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনী বেড়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নগরবাড়ির টর্চার সেলে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করত।
বেড়ার নগরবাড়িতে পাকসেনাদের ঘাঁটি ছিল। নগরবাড়ি ঘাটে তারা অগণিত লোককে হত্যা করে লাশগুলো যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দিত। হত্যার স্থানটি নগরবাড়ি ঘাট বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ পর্বে ১৯শে এপ্রিল সংঘটিত ডাববাগান যুদ্ধে ইপিআর, আনসারসহ ১২৬ জন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। তাই পরবর্তীকালে ডাববাগানের নাম হয় শহীদনগর এবং এখানে অনেকের গণকবর রয়েছে। স্থানটি শহীদনগর গণকবর নামেও পরিচিত।
বেড়ার অর্ধশতাধিক তরুণ ভারতের পানিঘাটা থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে চারজন কমান্ডারের নেতৃত্বে আগস্ট মাসে বেড়া ও এর আশপাশে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ চারজন কমান্ডার হলেন- মো. ইসাহাক আলী, ফেরদৌস হোসেন ফুল, মো. আব্দুল হাই এবং মো. মোজাহারুল ইসলাম। পরবর্তীতে গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার মতিয়ার রহমান (রহমতে খোদা), আসকার আলী, সাকের আলী এবং এস এম আমীর আলী তাঁদের বাহিনী নিয়ে বেড়ায় এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। প্রত্যেক কমান্ডারের অধীনে ১২-১৩ জন করে সশস্ত্র গেরিলা ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বেড়ায় কোনো বিশেষ বাহিনী না থাকলেও এখানকার কিছু তরুণ পলাশডাঙ্গা যুবশিবির-এর সদস্য ছিল। এর সর্বাধিনায়ক ছিলেন আব্দুল লতিফ মির্জা। গোটা জেলাব্যাপী এ বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বাঘাবাড়ি ঘাটের যুদ্ধ ও বেড়া থানা বিজয়ে এ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যুদ্ধের সময় পাবনা জেলার মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে অংশ নিতেন। আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেড়ার মুক্তিযোদ্ধারা নগরবাড়ি ঘাট, নাকালিয়া, নগরবাড়ি-বাঘাবাড়ি সড়কপথ ও বাঘাবাড়ি ঘাটে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হন। এ উপজেলায় বড় ধরনের কোনো গেরিলা অপারেশন না হলেও মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া ও শাহ্জাদপুরে অনেক গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। এ-সকল অপারেশনের মধ্যে দিকপুর অপারেশন ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী গেরিলা অপারেশন।
২৭শে সেপ্টেম্বর ১৫-২০ জন মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর সদস্য মো. শাহ্জাহান আলীর নেতৃত্বে নৌকাযোগে ভিটাপাড়া ব্রিজে পাহারারত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। রাজাকাররাও পাল্টা গুলি চালায়। ভিটাপাড়া রাজাকার ক্যাম্প যুদ্ধএ মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন এবং মকবুল হোসেন আহত হন। অন্যদিকে রাজাকার মোন্তাজ ও মমিন নিহত হয় এবং অন্যরা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে ১২টি রাইফেল এবং বেশকিছু গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ২৯শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ছনদহ গ্রামের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। একই সঙ্গে রাজাকারদের আশ্রয়দাতা ইউপি চেয়ারম্যান শামসুল হকের বাড়িতেও হানা দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন টের পেয়ে রাজাকাররা পালাতে থাকে। ছনদহ রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনএ একজন রাজাকার নিহত হয় এবং বেশ কয়েকটি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ১২ই ডিসেম্বর একদল পাকসেনা অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ পায়ে হেঁটে বারোপাখিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে ফায়ার করতে- করতে যমুনার পাড় ধরে নগরবাড়ি ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এ সংবাদ পেয়ে দিকপুর নামক স্থানে তাদের বাধা দেয়। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ। ২দিকপুর যুদ্ধএ মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ আলী ও আব্দুল খালেক শহীদ এবং ল্যান্স নায়েক আব্দুল আওয়াল (ইপিআর সদস্য) আহত হন। অপর পক্ষে ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়।
১৪ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বেড়া থানা অপারেশন করেন। তাঁরা তিন দলে বিভক্ত হয়ে থানা ঘিরে ফেলেন। এ অপারেশনে নেতৃত্ব দেন গেরিলা কমান্ডার এস এম আমীর আলী, ইসাহাক আলী, ফেরদৌস হোসেন ফুল ও ইপিআর সদস্য মো. শাহজাহান আলী। মুক্তিযোদ্ধারা থানায় অবস্থানরত পাকসেনা ও রাজাকারদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। পাকসেনারা আত্মসমর্পণে রাজী না হলে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে পাকসেনারা থানা ত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বাঘাবাড়ি এবং নগরবাড়ি ঘাটের দিকে চলে যেতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৫ই ডিসেম্বর বাঘাবাড়ি ও নগরবাড়িতে ভারতীয় মিত্রবহিনীর বিমান থেকে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হয়। বোমার আঘাতে কয়েকশ পাকসেনা প্রাণ হারায়। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনতার হাতেও অনেক সৈন্য প্রাণ হারায়। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফেরদৌস হোসেন ফুল আগুনে দগ্ধ হয়ে আহত হন। ১৬ই ডিসেম্বর বেড়া উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— এ কে খন্দকার, বীর উত্তম- (পিতা খন্দকার আব্দুল লতিফ, পুরান ভাঙ্গেরা)। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বেড়া উপজেলার যে-সকল মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁরা হলেন- নাজিম উদ্দিন (পিতা হেকমত আলী, মৈত্রবাধা), জয়গুরু বিশ্বাস (পিতা ক্ষিতীশ চন্দ্র বিশ্বাস, বনগ্রাম), আব্দুল খালেক (পিতা জুরান উদ্দিন, বৃশালিকা), মেহরাব আলী (পিতা ময়েন উদ্দিন, বৃশালিকা), মনছের খাঁ (পিতা জাবেদ খাঁ, শম্ভুপুর), আব্দুল সাত্তার (পিতা নওশের আলী, দক্ষিণপাড়া), শমসের আলী (পিতা জহির উদ্দিন, দক্ষিণ পাড়া), দুলাল (পিতা মহির উদ্দিন, দক্ষিণপাড়া), রইচ উদ্দিন (পিতা রিয়াজ উদ্দিন, দাসপাড়া), নাজিম উদ্দিন (পিতা আফতাব উদ্দিন, মাসুমদিয়া), আব্দুর রশিদ (পিতা বাহাদুর মোল্লা, শীতলপুর), হোসেন আলী (পিতা কামর প্রামানিক, দয়ালনগর), আব্দুল কাদের (পিতা রইচ উদ্দিন, চরপাড়া), তুষ্টু শেখ (পিতা আলাই শেখ, শম্ভুপুর), ওসমান (পিতা রইচ উদ্দিন, চরপাড়া), আব্দুর রশিদ খান (পিতা ময়েজ উদ্দিন খান, ঘোপসিলেন্দা), নুরুল হোসেন মিয়া (পিতা আলহাজ আব্দুর রহমান মিয়া, নাটিয়াবাড়ি), রইচ শিকদার (পিতা রিয়াজ উদ্দিন শিকদার, ঢালার চর), নাজিম উদ্দিন মিয়া (পিতা আব্দুল বাসেদ মিয়া, ঘোপসিলেন্দা), জাফর আলী (পিতা তাজু শেখ, পাইককান্দি), আমজাদ হোসেন (পিতা মাওলানা আব্দুল হামিদ, পাটগাড়ি), নিস্তারিনী বসু (স্বামী অমর বসু, হরিনাথপুর), প্রভাষ চন্দ্র মজুমদার সূর্য (পিতা প্রসন্ন চন্দ্র মজুমদার, রঘুনাথপুর)।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলার ইতিহাসকে ধারণ করে পাবনার বেড়ায় ‘শেকড় থেকে শিখরে’ ‘ভাস্কর্য’, বেড়ায় পৌরসভার সামনে ৭ বীরশ্রেষ্ঠসহ বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য ‘জ্যোতির্ময়’ এবং বেড়া বি বি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে ‘বিজয় বাংলা’ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া বেড়া বি বি হাইস্কুল প্রাঙ্গণে এ স্কুলের ১০ম শ্রেণির ছাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের সমাধি রয়েছে। প্রতিবছর ১৪ই ডিসেম্বর এখানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। শহীদ আব্দুল খালেকের স্মরণে ১৯৭২ সালে প্রায় ৫ বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করা হয় শহীদ আব্দুল খালেক স্টেডিয়াম।
মাসুমদিয়া গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিনের নামে বেড়া সংলগ্ন একটি বাজারের নামকরণ করা হয় নাজিম বাজার। মুক্তিযোদ্ধা জয়গুরু বিশ্বাসের (১৩ই জুন ফরিদপুর থানার কালিয়ানীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) স্মরণে বেড়ায় প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে জয়গুরু রোড। ঢাকা কলেজের মেধাবী ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হোসেনের (১৯৭০ সালে তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন, ২২শে সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার পিয়ারপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৭২ সালে কাশিনাথপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় শহীদ নুরুল হোসেন মহাবিদ্যালয়। ১৯শে এপ্রিল বেড়ার ডাববাগানে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে যে- সকল মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁদের স্মরণে ডাববাগানের নামকরণ করা হয় শহীদনগর। [মো. ছাবেদ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড