You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বীরগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বীরগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর)

বীরগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর) ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে ঠাকুরগাঁও যাওয়ার পথে বীরগঞ্জে যাত্রাবিরতি করেন। এ-সময় তিনি শহীদ মিনার মোড় (বর্তমান তিনমাথা মোড়) এলাকায় একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যে উপস্থিত জনতা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়, যার প্রভাব পড়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে। ফলে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘যার যাকিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারাদেশের জনগণের মতো বীরগঞ্জের জনগণও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সমস্ত স্কুল-কলেজ, অফিস- আদালত, ব্যাংক-বিমা, দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়। পাক সরকারের বিরুদ্ধে চলতে থাকে দুর্বার গণ-আন্দোলন।
সাতই মার্চের ভাষণ এর পরদিন ৮ই মার্চ সকাল ১১টার দিকে মিজানুর রহমান চৌধুরী (শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী) বীরগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিস-সংলগ্ন ‘তৃপ্তি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এ এসে নিত্যানন্দ সাহা (এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি)-র সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার পর তাঁরা উপস্থিত সকলকে স্থানীয় ডাক্তারখানা মাঠে জনসভায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। অত্যল্প সময়ের মধ্যে জনসভা শুরু হলে সেখানে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে যে-কোনো পরিস্থিতি
মোকাবেলার জন্য সকলকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। সভায় ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়ে তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যে-কোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানান। নেতৃবৃন্দের এই বক্তব্য শুনে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের মধ্যে আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে। তারা মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রতিরোধও গড়ে তোলে। স্বাধীনতা লাভের জন্য তারা যে-কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে একদিন তারা মিছিল শেষে মো. গোলাম রহমান শাহ এমপিএ-র নেতৃত্বে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বীরগঞ্জ থানার মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।
বীরগঞ্জের নেতৃবৃন্দ বুঝতে পেরেছিলেন যে, দেশে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তাই এদিন দুপুরে মিজানুর রহমান চৌধুরী, নিত্যানন্দ সাহা, মো. হবিবর রহমান মিঞা (আওয়ামী লীগ নেতা)-সহ আরো কয়েকজন বীরগঞ্জ থানায় গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফজলুল হক বসুনিয়ার সঙ্গে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনিও সকলকে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। সেখানে উপস্থিত সকলের আলোচনা শেষে জনমত গড়ে তোলা, আত্মরক্ষা এবং যে-কোনো আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী থানার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর সদস্যরা ছিলেন- মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী, নিত্যানন্দ সাহা, মো. হবিবর রহমান মিঞা, মো. আব্দুল মালেক, এ টি এম আমিনুল ইসলাম, মো. শহীদুল ইসলাম, মো. তরিকুল আলম, মো. নুরুজ্জামান চৌধুরী (গামা), গোবিন্দ সাহা, খালেক হাজী (লস্করপুর), একরামুল হক প্রমুখ। বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্যরা গোপনে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। গামা চৌধুরীর রাইস মিলে পরিষদের কার্যক্রম চলতে থাকে। ওসি মো. ফজলুল হক নেপথ্যে থেকে পরিষদের সঙ্গে কাজ করেন।
দেশের পরিস্থিতি আরো সংকটময় হলে জনগণকে সংগঠিত করা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হয়। এ-দলের সদস্য ছিলেন- মো. আব্দুল বারী, মো. আমজাদ হোসেন, মো. ফজলুল করিম, মো. একরামুল হক, মো. মোকছেদুল হক, মো. নুরুল ইসলাম চৌধুরী, মো. আজিজুল হক, গোবিন্দ চন্দ্র সাহা, মো. মিজানুর রহমান প্রমুখ।
ঢাকায় ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর পাকসেনারা বাঙালি পুলিশ, মিলিটারি, ছাত্র, শিক্ষক ও যুবকদের হত্যা করতে থাকলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার সঙ্গে এতদঞ্চলের . যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের মালামাল আনানেয়া বন্ধ হয়ে গেলে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বীরগঞ্জের ছাত্র-যুবকরা তাতে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কালীপদ রায় (পিতা দরপচাঁদ রায়, দাইক্ষেত্র)-সহ ১০-১২ জন যুবক ভারতে যান। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার-এর শপথ গ্রহণের পর তাঁরাসহ ২৫ জন যুবক মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পে ভর্তি হন। তাঁরা হলেন- কালীপদ রায়, প্রেমানন্দ রায়, মধুসূদন রায়, প্রভাতচন্দ্র রায়, টংকনাথ রায়, ক্ষিতীশচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কামিনী রায়, কেশবচন্দ্র রায়, দধিনাথ রায়, ভ্রমর রায়, সুবাসচন্দ্র রায়, গিরিশচন্দ্র রায়, সুনীলচন্দ্র রায়, বিনয় অধিকারী, নৃপেন্দ্রনাথ অধিকারী, রাজেন্দ্রনাথ রায়, সুধীরচন্দ্র রায়, ক্ষেত্রমোহন রায়, তুলশীচন্দ্র রায়, অলিকান্ত বর্মণ, পূর্ণচন্দ্র রায়, প্রস্থনাথ রায়, মোহিনী অধিকারী এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ অধিকারী। এঁরা এক মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে আরো অনেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বীরগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যাঁরা কমান্ডারের য়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- মো. আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী (পিতা নুরুদ্দীন চৌধুরী, সাত খামার), হরিপ্রসাদ রায় পতা বিপিনচন্দ্র রায়, কাজলগাঁও), এস এম এ খালেক পিতা হেলাল উদ্দিন, সুজাপুর) এবং মো. খাজা নাজিমউদ্দিন পতা মকছেদ আলি, কেটগাঁও ২নং পলাশবাড়ি)।
প্রশে মার্চের পর ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পের বাঙালি নারা প্রতিরোধ গড়ে তুললে কয়েকজন পাকসেনা ও দুজন জের পরিবারসহ চৌপুকুরিয়া গ্রামে পালিয়ে আসে। এ খবর নে উত্তেজিত বাঙালিরা স্থানীয় বন্দুক নিয়ে তাদের আক্রমণ রে। পাকসেনাদের আরেকটি দল মদনপুর গ্রামে এসে বড় ছের আড়ালে ও একটি বড় গর্তে আশ্রয় নেয়। সংগ্রাম রিষদের লোকজন এবং সাধারণ জনগণ এ খবর পেয়ে লে-দলে তীর-ধনুক, লাঠিসোটা ও দেশীয় বন্দুক নিয়ে াদের আক্রমণ করে। বীরগঞ্জ ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মচারী হসিন আলী (লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী) তার দোনলা বন্দুক -য়ে দুজন পাকসেনাকে মেরে ফেলে। হঠাৎ একজন াকসেনা গর্ত থেকে গুলি করলে মহসিন আলীর ঘটনাস্থলে ত্যু হয়। এ ঘটনার পর উত্তেজিত জনতা একযোগে াক্রমণ করে ঐ পাকসেনাকেও মেরে ফেলে।
কিসেনারা যাতে বীরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, নজন্য সংগ্রাম পরিষদ, স্বেচ্ছাসেবক দল, থানার পুলিশ এবং ানীয় জনগণ মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শত্রুর মাকাবেলায় তারা আদিবাসীদের কাছ থেকে তীর-ধনুক, াঠি-বল্লম ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে গ্রামে-গ্রামে ছড়িয়ে ড়ে এবং বিভিন্ন রাস্তায় বেরিকেড দেয়। রাত জেগে পাড়ায়-পাড়ায় পাহারা দেয়। সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে ঠাকুরগাঁও- ঞ্চগড় যেতে হলে বীরগঞ্জের ওপর দিয়ে যেতে হতো। তাই ীরগঞ্জ মহাসড়কের শালবাগান, কলার, লেঙ্গেরা পুকুরপাড়, বীরগঞ্জ রোড এবং উত্তরে ঢেপারপুল পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তালা হয়। পাকসেনারা যাতে যানবাহন নিয়ে ঠাকুরগাঁও যতে না পারে সেজন্য রাস্তা কেটে এবং রাস্তায় গাছ ফেলে চাতগাঁ ব্রিজে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।
৩ই এপ্রিল পাকসেনারা গাড়িবহর নিয়ে ঠাকুরগাঁও ইপিআর চ্যাম্পে যাওয়ার পথে ভাতগাঁ ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করেন। কিন্তু সব প্রতিরোধ ভেঙ্গে তারা এদিন পীরগঞ্জে প্রবেশ করে এবং বীরগঞ্জ থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর তারা স্থানীয় রাজাকার ও বিহারিদের হযোগিতায় সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ইত্যাদি শুরু করলে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ফলে জনগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে থাকে। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশত্যাগ শুরু করে। বীরগঞ্জের বিহারি মেহেদী মামুদ, মোহাম্মদ আলী প্রমুখ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
বীরগঞ্জে পাকবাহিনীর সহযোগিতার স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। মোহাম্মদ আলী (পিতা আব্দুর রহিম, সুজালপুর পৌরসভা, বীরগঞ্জ) ছিল রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। তার সহযোগীরা হলো- মেহেদী মামুদ বিহারি (মটর সাইকেল মেকার, রাজাকার কমান্ডার), হালিমুজ্জামান চৌধুরী ওরফে দুলু চৌধুরী (রামপুর, কাহারোল; রাজাকার কমান্ডার), মো. হায়দার আলী (সাদুল্লাপুর, ৪নং লাল্টাপুর ইউপি), আব্দুল্লাহ হেল কাফী (শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনের পরিকল্পনাকারী ও নেতৃত্ব দানকারী; উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতা এবং ২০০১ সালে সংসদ সদস্য), মো. বাহার উদ্দিন (মাদাতী, ৬নং শালগ্রাম), মো. হাকিম মাস্টার কমান্ডার (নিজপাড়া), আব্দুল হামিদ মাস্টার (পিতা হেফাজউদ্দিন, ভোগনগর, ভাবকী; কমান্ডার), মো. মকিমউদ্দিন (পিতা দবিরউদ্দিন, ৬নং গোলাপগঞ্জ; শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও কমান্ডার), মো. ইসমাইল হোসেন গনি (পিতা সিরাজউদ্দিন, তুলসীপুর, লাটের হাট; শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), ডা. ইউসুফ আলী (শীতলাই), মো. এমদাদুল হক (সাতোর), মো. মতিয়ার চৌধুরী (তড়ৎবাড়ি) প্রমুখ।
পাকবাহিনী বীরগঞ্জে প্রবেশ করার পর স্থানীয় দোসরদের নিয়ে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড শুরু করে। ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী নির্বিচারে এদের ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে-গ্রামে ঢুকে ব্রাশফায়ার করে বাঙালিদের হত্যা করতে থাকে। তারা চৌপুকুরিয়া গ্রামের জিন্দাপীর এলাকায় ১৩ জন এবং সেনগ্রামের মদনপুর অনেককে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। মদনপুরে শহীদদের তারা জলাপুকুরের গর্তে মাটিচাপা দেয়। এ ঘটনা প্রচারিত হওয়ার পর স্থানীয় অধিবাসীরা দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। তাদের অধিকাংশই ছিল স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক।
যতই দিন যেতে থাকে, অত্যাচারের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। যেসব বাড়িতে যুবক ছেলে-মেয়ে ছিল, রাতের বেলা স্থানীয় দোসররা পাকসেনা ও বিহারিদের পথ দেখিয়ে সেসব বাড়িতে নিয়ে যেত। প্রথমে টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার নিত, পরে যুবতি মেয়েদের নিয়ে যেত। এর ফলে দেশত্যাগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। বেশিরভাগ হিন্দু পরিবার রাতের অন্ধকারে গরুর গাড়িতে সামান্য মালপত্র নিয়ে সেতাবগঞ্জ-বিরল-মঙ্গলপুর হয়ে ভারতে চলে যায়। বীরগঞ্জের উত্তর অঞ্চলের লোকজন বাংলাবান্ধা হয়ে শিলিগুঁড়িতে যায়। এক পর্যায়ে মঙ্গলপুর রেল লাইন পার হওয়ার সময় ব্যাপক লুটপাট ও কয়েকজন যুবতি মেয়ে ধর্ষিত হয়। সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে অনেক হিন্দু পরিবারের নারী ও পুরুষদের আলাদা-আলাদা ঘরে নিয়ে নারীদের নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়, আর পুরুষদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। তাদের বিধবা স্ত্রীদের কেউ-কেউ এখনো বোয়ালমারী, চেঙ্গাইক্ষেত্র ও নওগাঁ-মহুগাঁ গ্রামে বেঁচে আছেন। কাজল-ঘড়াবন্ধ গ্রামের পরিবারগুলো চিরিরবন্দর ও কাউগাঁ রেললাইন পার হওয়ার সময়ও নারীরা রেলস্টেশনের ঘরে ধর্ষণের শিকার হন এবং পুরুষদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। ঐসব এলাকায় স্বামীহারা বিধবাদের কাউ-কাউকে এখনো দেখা যায়।
গোপালগঞ্জ অত্র এলাকার হিন্দুপ্রধান একটি বড় হাট। এখানে রাজাকাররা ক্যাম্প করে খুবই অত্যাচার শুরু করে। তারা প্রতিরাতে হিন্দু বাড়িগুলোতে ঢুকে জোরপূর্বক টাকা- পয়সা আদায় করত। ডা. বিজয় নামে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। তাঁকে একদিন শালবাগানে ধরে নিয়ে হত্যা করে তারা ফেলে রাখে। জগৎচন্দ্র রায় নামে এক ছাত্র ছিল। রাতের বেলা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর এ এলাকার হিন্দু গ্রামগুলো প্রায় মানুষশূন্য হয়ে পড়ে; অধিকাংশই ভারতে চলে যায়। হাবলুহাট সংলগ্ন উত্তর পাশের পাড়ার দুই মাসের শিশুসন্তানের পিতা ছিলেন জীতেন্দ্রনাথ রায়। পাকসেনারা তাকে একদিন দুপুরবেলা রাস্তার পাশ থেকে ধরে নিয়ে যায়। তার আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালে তাঁর বিধবা স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন।
লক্ষ্মীপুর, লস্করপুর, রসুলপুর ও নিজপাড়া ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ হেল কাফী এ এলাকায় ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। সে একরাতে কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এর ফলে ঐ রাতেই ঐ গ্রামগুলোর হিন্দুরা ভারতে চলে যায়। যাওয়ার পথে মঙ্গলপুর রেললাইনে লুটপাটের ফলে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
বীরগঞ্জ উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন। বর্তমান উপজেলা অফিসের পার্শ্ববর্তী বাজারের সকল ব্যবসায়ী ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের, বিশেষত মাড়োয়ারি শ্রেণির। মেহেদী হাসান নমে এক উর্দুভাষী বিহারি এখানে রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটি গঠন করে। সে সৈয়দপুর থেকে পাঞ্জাবি সৈন্যদের এনে স্থানীয় দোসরদেরসহ এ এলাকায় নৃশংস কর্মকাণ্ড চালায়। তারা নারীধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী কর্ম করে।
পাঁচপীর নামক হিন্দুপাড়ায় নশীপ্রসাদ রায় নামে একজন বিত্তবান ব্যক্তি ছিলেন। মেহেদী বিহারি একদিন রাজাকার কমান্ডার ডা. ইউসুফ আলী (শীতলাই)-সহ অন্যদের নিয়ে তাঁর বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালায় এবং কালীচরণ রায় নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার পেটে ছুরি মারে। এর ফলে তার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসে এবং বিনা চিকিৎসায় সে মারা যায়। এ ঘটনার পর এলাকার ভীত- সন্ত্রস্ত লোকজন অন্যত্র চলে যায়।
বীরগঞ্জ উপজেলায় অনেকগুলো গণহত্যার ঘটনা ঘটে। সেগুলো হলো: মহুয়াগাঁ গণহত্যা, সেনগ্রাম গণহত্যা, পাল্টাপুর গণহত্যা, আরাজি চৌপুকুরিয়া গণহত্যা, দামাইক্ষেত্র গণহত্যা ও মাঝাপাড়া গণহত্যা। মহুয়াগায় ১০ জন, সেনগ্রামে বহু জন, পাল্টাপুরে বহু জন, আরাজি চৌপুকুরিয়ায় ১৫ জন, দামাইক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন এবং মাঝাপাড়ায় ১৬ জন লোক শহীদ হন।
যুদ্ধের শেষদিকে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও মুক্ত হওয়ার পর ৬নং সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) এম মাসুদুর রহমান, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, এফএফ- কমান্ডার পানোয়ার রহমান পিন্টু এবং সুবেদার খালেক মিত্রবাহিনীর ট্যাংকবহর, পদাতিক বাহিনী, গেরিলা বাহিনী ও মর্টার বাহিনী নিয়ে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। ৫ ও ৬ই ডিসেম্বর পঁচিশ মাইল নামক স্থানে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়, যা পঁচিশ মাইল যুদ্ধ নামে পরিচিত। পাকবাহিনী ও যৌথবাহিনীর মধ্যে সংঘটিত এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী পালিয়ে যায়।
১লা ডিসেম্বর যৌথবাহিনী রহিম বক্স হাইস্কুলের পেছনের বিরাট বাঁশবাগানে পাকবাহিনীর বাংকারে আক্রমণ করলে উভয় পক্ষে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। অবশেষে মিত্রবাহিনী ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ করলে পাকসেনারা পিছু হটে। এরপর পাকসেনাদের একটি দল বীরগঞ্জের শালবাগান এবং আরেকটি দল খানসামা যাওয়ার পথে নদীর ধারে বাংকার করে অবস্থান নেয়। কিন্তু মিত্রবাহিনীর গোলার আঘাতে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় তাদের একটি দল ভাতগাঁ ব্রিজের দুপাশে বাংকার করে পজিশন নেয়। কিন্তু মিত্রবাহিনীর গোলার আঘাতে টিকতে না পেরে সেখান থেকে পিছু হটার সময় তারা ব্রিজটির পশ্চিম অংশ ভেঙ্গে দিয়ে সৈয়দপুর ও দিনাজপুরের দিকে পালিয়ে যায়। তাদের আরেকটি দল মদনপুর গ্রামে অবস্থান নিলে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। কিন্তু এখান থেকেও তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবশেষে ৬ই ডিসেম্বর তারা সৈয়দপুর ও খানসামার দিকে পালিয়ে গেলে বীরগঞ্জ সদর হানাদারমুক্ত হয়। কিন্তু ১৩ই ডিসেম্বর কৃষ্ণনগরে একটি যুদ্ধ হয়। -কৃষ্ণনগর যুদ্ধএ পরাজয়ের পর পাকসেনারা নীলফামারী ও সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যায়। ফলে এদিন সমগ্র বীরগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
বীরগঞ্জ উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন- আমির উদ্দিন, (পিতা টুরু মোহাম্মদ, সম্ভুগা; রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন; ২৫শে মার্চ শহীদ হন), বুধারু বর্মণ (পিতা আন্ধারু বর্মণ, সাজালপুর; তৃপ্তি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার-এর কর্মচারী; ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিরল উপজেলার একটি সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন), মতিলাল বর্মণ (পিতা রাজমোহন বর্মণ, দেউলি; ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন; ৬ই জানুয়ারি ১৯৭২ দিনাজপুর মহারাজা হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হন) এবং রমেন সেন (পিতা কিরণচন্দ্র সেন, বড় করিমপুর; ঐ)।
জিন্দাপীর এলাকায় ১৩ শহীদের গণকবর ও সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। সেনগ্রাম গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ২০০৫ সালে পূর্ব মল্লিকপুর এইচ এস কলেজের অধ্যক্ষ এস এম মোজাফ্ফর হোসেনের উদ্যোগ এবং মনোরঞ্জন শীল গোপাল এমপি-এর সহযোগিতায় শাহপাড়ায় একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মনোরঞ্জন শীল গোপাল এমপি-র সহযোগিতায় ২০১১ সালে বুধারু বর্মণের স্মরণে একটি, ৬নং নিজপাড়া ইউনিয়নে একটি, মতিলাল বর্মণের স্মরণে দেউলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি এবং রমেন সেনের স্মরণে বীরগঞ্জ-ঝাড়বাড়ি পাকা সড়কের পাশে তাঁর পৈতৃক বাড়ির সামনে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ বুধারু বর্মণ ও মতিলাল বর্মণের নামে দুটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সড়ক দুটি হলো— শহীদ বুধারু সড়ক (তাজমহল মোড় থেকে খানসামা মোড় পর্যন্ত) এবং শহীদ মতিলাল সড়ক (দিনাজপুর- পঞ্চগড় সড়কের বটতলি হাট থেকে গড়েয়া পর্যন্ত)।
মুক্তিযোদ্ধা গোপালচন্দ্র রায়ের নাম অনুসারে আরেকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘গোপাল সড়ক’ (ঝাড়বাড়ি থেকে গড়ফতুর পর্যন্ত)। [মো. মোজাম্মেল হক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড