মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিক ও লেখক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়
বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, পদ্মভূষণ (১৯০৪-১৯৯৩) সাংবাদিক ও লেখক। তিনি ১৯০৪ সালের ৩রা জুলাই পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি কোলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। কবি হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে উদ্বোধন পত্রিকার মাধ্যমে। আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় (১৯২৫)। দীর্ঘ সময় তিনি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন (১৯৩৭-৬২)। তারপর তিনি দৈনিক বসুমতী, দৈনিক ভারতকথা ইত্যাদি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি বিশ্বশান্তি সংসদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি বেশকিছু পুস্তক রচনা ও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর রচিত পুস্তকসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস (১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড) উল্লেখযোগ্য। তিনি ভারতীয় সাংবাদিক এসোসিয়েশনের (Indian Journalists Association) সভাপতি ছিলেন (১৯৫০-৫২, ১৯৬৯)। সাহিত্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবে ভূষিত হন (১৯৭০)। ১৯৯৩ সালের ২০শে মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির সদস্য বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৎকালীন যুগান্তর পত্রিকার একদল তরুণ সাংবাদিক নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করতেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন যুগান্তর পত্রিকায় তাঁর উল্লেখযোগ্য সম্পাদকীয় ছিল- ইতিহাসের এক আশ্চর্য দৃশ্য : পূর্ববঙ্গে বাঙালির জাতীয় স্বাধীনতার লড়াই, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতবর্ষ ও রাশিয়া, বাংলাদেশের মুক্তি ও ভারত ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়-কে ১৫ই ডিসেম্বর ২০১২ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]
বিমান মল্লিক (জন্ম ১৯৩৩) যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ভারতীয় শিল্পী, নকশাবিদ ও অধ্যাপক। তিনি ১৯৩৩ সালের ১৭ই ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬০-
সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন। ১৯৬০-৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের সেন্ট মার্টিন’স স্কুল অব আর্টে কলা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে মহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ব্রিটিশ ডাকবিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিটের নকশা তৈরি করেন। এটিই ছিল প্রথম ব্রিটিশ ডাকটিকিট, যেটি কোনো বিদেশী নেতার স্মরণে প্রকাশিত হয় এবং প্রথম বিদেশী কোনো নকশাবিদ দ্বারা নকশা করানো হয়। তিনি মিডেলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়, কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। তিনি লেখালেখির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। তিনি ধূমপানবিরোধী “ক্লিন এয়ার অভিযান’ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ঘুরে বেড়ান এবং ধূমপানবিরোধী তাঁর মৌলিক পোস্টার নানা দেশের নানা ভাষায় প্রকাশিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক ১৯৮৮ সালে তাঁর এ প্রকল্পকে সম্মাননা জানানো হয়। শিল্পী ও লেখক হিসেবে তিনি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি), অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস ও অন্যান্য সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্প সম্পন্ন করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সাবেক মন্ত্রী জন স্টোন হাউসের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার- বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ডাকটিকিট প্রচলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নকশাবিদ বিমান মল্লিক বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিটের একটি সেটের নকশা তৈরি করেন, যার জন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। ২৪শে জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হারকেটে কক্ষে এক সাড়ম্বর অনুষ্ঠানে ডাকটিকেটগুলো বিভিন্ন দেশে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। স্ট্যাম্প বিক্রয়লব্দ অর্থ বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে জমা হয়৷
মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ বিমান মল্লিক-কে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হয়। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড