মুক্তিযুদ্ধে বিয়ানীবাজার উপজেলা (সিলেট)
বিয়ানীবাজার উপজেলা (সিলেট) আন্দোলন-সংগ্রামের এক উর্বর ভূমি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এখানকার গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। মহান ভাষা-আন্দোলন-এর। স্পর্শও লেগেছিল এখানে। ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন ঢাকার রাজপথে শহীদ হন বিয়ানীবাজারের সন্তান মনু মিয়া (শ্রমিক)। বাঙালিদের ন্যায্য দাবি ও অধিকার চিরতরে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে আইয়ুব সরকার ১৯৬৮ সালে মুজিবুর রহমান-এর বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করলে আইনি লড়াইয়ের জন্য বিয়ানীবাজারের মানুষ স্থানীয়ভাবে এবং প্রবাসে (লন্ডনে) অর্থ সংগ্রহ করে পাঠায়। ৭০-এর নির্বাচনে বিয়ানীবাজারের মানুষ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ- প্রার্থীদের বিজয়ী করে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার পক্ষে গণরায় দেয়।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা ও স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরুর খবর বিয়ানীবাজারে এসে পৌঁছলে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার নির্দেশ অনুযায়ী অত্র এলাকার জনগণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাধীনতাকামী জনগণ ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ২৭শে মার্চ মিছিল সহকারে থানা শহরের পি এইচ জি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হয় সেখান থেকে তারা শত্রুর সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করার জন্য জেলা শহর সিলেট অভিমুখে শেওলা ফেরিঘাট পর্যন্ত ছুটে যায়। সাধারণ মানুষ বারইগ্রাম-সিলেট প্রধান সড়কের পাশের গাছ কেটে সড়ক বন্ধ করে দেয়। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা পূর্ব মুড়িয়ার জনগণ ঢাকায় নিরীহ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করে। বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রোশের শিকার হয় ইপিআর-এর সারপার বিওপি। জনতার হামলায় দুজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের নির্দেশনা অনুসারে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সংগঠিত করার জন্য থানা আওয়ামী লীগের সহ- সভাপতি সিরাজ উদ্দীন আহমদ এশু মিয়াকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে (৪ঠা এপ্রিল) সংগ্রাম পরিষদকে অধিকতর শক্তিশালী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সকল রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিশিষ্টজনদের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতি গঠন করা হয়। এ সমিতির উদ্যোগে পি এইচ জি উচ্চ বিদ্যালয়ে ট্রানজিট ক্যাম্প খোলা হয়। প্রতিদিন সীমান্তের উদ্দেশে ছুটে আসা শতশত শরণার্থীকে এ ক্যাম্পে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো হয়। বিয়ানীবাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পি এইচ জি হাইস্কুল প্রাঙ্গণ, ডাকবাংলো চত্বর এবং দাসগ্রাম বাবুর বাজারে তিনটি ক্যাম্প খোলা হয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও ছাত্র-যুবকরা প্রশিক্ষণের জন্য দলে-দলে এসব ক্যাম্পে এসে যোগ দেয়। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে আসেন আনসার কমান্ডার কাজী আলাউদ্দিন (মাথিউরা), ইউনাইটেড ব্যাংক বিয়ানীবাজার শাখার ম্যানেজার জামিরুল ইসলাম (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও ছাত্র ইউনিয়ন- নেতা), প্রাক্তন সেনা-সদস্য আবদুল মতিন (লম্বা মতিন) এবং অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য চুনু মিয়া। বাঁশের লাঠিকে ডামি রাইফেল হিসেবে ব্যবহার করে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। ঢাকার ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুন নূর (ঘুঙ্গাদিয়া) ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফৈজুর রহমান ফৈয়াজের প্রচেষ্টায় বিয়ানীবাজার থানার ওসি হাফিজ উদ্দিন দেওয়ান বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য থানার অস্ত্রভাণ্ডার থেকে কয়েকটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল সরবরাহ করেন। পণ্ডিতপাড়ায় অবস্থিত ইপিআর ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবেদার দাইয়ান স্টেনগান ও এলএমজি সরবরাহ করেন। সুবেদার দাইয়ান ডাকবাংলো, স্কুল প্রাঙ্গণ ও বাবুর বাজার ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণও দিতেন। ইপিআর ফাঁড়ির সুবেদার মতিউর রহমানও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সহায়তা করেন। হবিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণার্থীদের দ্রুত ভারতের আগরতলায় পাঠানোর কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব দ্য স্টাফ কর্নেল এম এ রব এমএনএ ১২ই এপ্রিল বিয়ানীবাজারের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।
উপর্যুক্ত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোর বাইরেও বিয়ানীবাজারের গ্রাম পর্যায়ে আরো কয়েকটি ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। রাজনীতিবিদ আব্দুল জব্বার, আবুল খায়ের চৌধুরী ও সামছুদ্দিনের প্রচেষ্টায় বালিঙ্গায়, সুবেদার দাইয়ানের উদ্যোগে বৈরাগী বাজারে, আব্দুল হক কমান্ডার ও সাজ্জাদুর রহমানের উদ্যোগে শেওলায়, আব্দুল মোছাব্বির কমান্ডারের উদ্যোগে দুবাগ বাজারে এবং ইপিআর-এর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার আব্দুর রউফ কুটি মিয়ার (পরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) উদ্যোগে পূর্ব মুড়িয়ার মাইজকাপন-ইনামপুরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। দেউলগ্রাম ও কুড়ারবাজারেও দুটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু হয়। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিয়ানীবাজার থেকে ৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তেলিয়াপাড়ায় পাঠানো হয়।
সংগ্রাম পরিষদকে শক্তিশালী করার জন্য সর্বদলীয় যে সহায়ক সমিতি গঠন করা হয়েছিল, তার আহ্বায়ক ছিলেন বিয়ানীবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মুজম্মিল আলী। সমিতির সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের আব্দুল আজিজ, আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম, সিরাজ উদ্দীন আহমদ এশু মিয়া, ফখরুদৌলা (দৌলা মিয়া), ফৈজুর রহমান, আব্দুল মতিন, – তাজউদ্দিন আহমদ, আব্দুল বাতেন তাপাদার, ন্যাপের আরজদ আলী, আব্দুল লতিফ প্রমুখ। স্থানীয় গণ্যমান্য। ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন পঞ্চখ-হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাছন আলী চৌধুরী (অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন), সমাজসেবক সহিব আলী (পরবর্তীতে সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), আব্দুস ছাত্তার, বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ ইমদাদুর রহমান প্রমুখ। ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামের আব্দুল নূর ঢাকায় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনিও এ- সময় বিয়ানীবাজারে এসে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদ (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী) ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর উদ্যোগে যুদ্ধকালীন সময়ে দুটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা গড়ে ওঠে। সমরকুশলী মেজর (অব.) আব্দুল ফাত্তাহ চৌধুরী যুদ্ধের প্রথম দিকে সিলেটে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। পরে তিনি মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম একজন বেসামরিক অফিসার থেকে যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি ক্যাপ্টেন পদে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে সাব- সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুজিবনগর সরকার-এর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটিও তাঁর ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন হয়। মেজর জেনারেল (অব.) হারুন আহমদ চৌধুরী, বীর উত্তম- মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম। সেনাবিদ্রোহের নায়ক মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর।উত্তম-এর অন্যতম সহযোগী ছিলেন।
বিয়ানীবাজারের নেতৃবৃন্দ এলাকায় থেকে যেমন মুক্তিযুদ্ধ . সংগঠিত করেছেন, তেমনি এ এলাকার কেউ-কেউ প্রবাসে থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গ্রেট ব্রিটেনে কেন্দ্রীয়ভাবে গড়ে ওঠা ‘একশন . কমিটি ফর দি পিপল’স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে’ বা ‘যুক্তরাজ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একশন কমিটি’র গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ছিলেন বিয়ানীবাজারের অধিবাসী। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য-সামগ্রী নিয়ে ভারতেও এসেছিলেন|
বিয়ানীবাজার উপজেলার সাংবাদিকরাও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা ভারতে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য চারটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। করিমগঞ্জ থেকে রাজনীতিবিদ এ এইচ শাআদত খান ও সাহিত্যিক-সাংবাদিক আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম মুক্তবাংলা এবং সাংবাদিক মোহাম্মদ আব্দুল বাসিত জয়বাংলা প্রকাশ করেন। কলকাতা থেকে ‘বাংলাদেশ সংগ্রামী জনগণের বিপ্লবী মুখপত্র’ স্লোগানসম্বলিত জন্মভূমি প্রকাশ করেন তরুণ সাংবাদিক মোস্তফা আল্লামা। কাছাড়ের শিলচর থেকে বাংলাদেশ প্রকাশ করেন লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও সাংবাদিক আব্দুল মতিন চৌধুরী।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জেলা শহর সিলেট পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। হিংস্র হায়নার দল সেখানে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিধন ও বাঙালিদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে অবরুদ্ধ জনপদের নারী-বৃদ্ধ-শিশু নির্বিশেষে হত্যা, মা-বোনদের ধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু করে। জেলার সর্বত্র তাদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং থানাগুলো দখলের চেষ্টা করে। অপরদিকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে প্রতিরোধ করে সিলেটকে শত্রুমুক্ত করার প্রস্তুতিও শুরু হয়। এরকম একটি উদ্যোগ নেয় বিয়ানীবাজারের দুবাগে সমবেত বাঙালি ইপিআর ও আনসার সদস্য এবং স্থানীয় মুক্তিকামী যুবকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। ২৫শে মার্চের পর ভারত সীমান্তের কাছে গজুকাটা, বড়গ্রাম, লক্ষ্মীবাজার ও সোনাপুর ইপিআর ক্যাম্পের বাঙালি সৈন্যরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করে দুবাগ বাজারে সমবেত হন এবং স্থানীয় মেওয়া মাদ্রাসায় ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে অবস্থান করেন। তাঁদের কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার সামস উদ্দিন (পরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) এবং সহকারী কমান্ডার ছিলেন নায়েক আফজাল। এ ক্যাম্প থেকে সিলেট শহরকে হানাদারমুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। অপরদিকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ রব এমএনএ, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এমএনএ প্রমুখ আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও ছাত্রসহ সর্বস্তরের জনতাকে নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সিলেট শহরকে হানাদারমুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। এর অংশ হিসেবে হবিগঞ্জ- মৌলভীবাজার-বিয়ানীবাজার হয়ে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার কৌশল নির্ধারিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এফএফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) রেজিমেন্টের সিনিয়র মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম (৪নং সেক্টর কমান্ডার)-কে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর দত্তের নেতৃত্বে সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী মৌলভীবাজার থেকে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। তখন পাকবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুই প্লাটুন সৈন্য শেরপুরে এবং এক প্লাটুন সৈন্য শাদিপুরে অবস্থান করছিল। মেজর দত্তের অনুরোধে মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম (২ নং সেক্টর কমান্ডার ও ‘এস’ ফোর্সের প্রধান) ক্যাপ্টেন আজিজ (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল, বাড়ি গোলাপগঞ্জের রানাপিং)-এর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য তাঁর সাহায্যার্থে পাঠান। তাঁরা কুলাউড়া-বড়লেখা-বিয়ানীবাজার-শেওলা-গোলাপগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সিলেট শহরের অদূরে পাকসেনাদের সঙ্গে তাঁদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এতে পাকসেনারা পরাস্ত হয়ে সিলেট শহরে চলে যায়। ক্যাপ্টেন আজিজ সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করেন। অন্যদিকে মেজর দত্ত শাদিপুর হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হন। মুক্তিবাহিনী বিশ্বনাথপুরে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটে পালিয়ে যায়। ৭ই এপ্রিল সিলেট বিমানবন্দর ও লাক্কাতুরা চা-বাগানের কিছু অংশ ছাড়া সমস্ত সিলেট জেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ৮ই এপ্রিল পাকসেনারা শালুটিকর বিমানবন্দর ও লাক্কাতুরা এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের অব্যাহত আক্রমণে ক্যাপ্টেন আজিজের কোম্পানি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারপরও পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। পাকবাহিনী সি-১৩০ বিমানযোগে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। এদিকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাবে মুক্তিবাহিনী শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে গোলাপগঞ্জের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে ভারত সীমান্তের বিয়ানীবাজার-বড়গ্রাম বিওপি এলাকায় অবস্থান নেয়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল শেওলাঘাট থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে পাকবাহিনীকে বাধা দেয়া। বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ তখনো মুক্ত ছিল। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য শেওলা ফেরিঘাটে অবস্থান নেয়। বড়গ্রাম থেকে কর্নেল রবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে-মধ্যে তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৪ঠা মে প্রথম বিয়ানীবাজারে প্রবেশ করে। তখন তাদের আক্রমণের শিকার হয় থানা সদরে অবস্থিত আওয়ামী লীগের অফিস, মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত নজীর ফার্মেসি, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত আবদুল বাতিন তাপাদারের দোকানসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো পাকবাহিনী পুড়িয়ে দেয় এবং শহরের ব্যাংকগুলো লুট করে ফিরে যায়। এরপর ৭ই জুন পুনরায় এসে পুলিশ স্টেশন সংলগ্ন সড়ক বিভাগের ডাকবাংলোতে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া সিলেটগামী সড়কের সঙ্গে সংযোগস্থল, বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী চারখাইয়ের জালালনগর গ্রামের ইয়াজ মিয়া তাপাদারের বাড়ি, চারখাই ও বিয়ানীবাজারের মধ্যবর্তী কুশিয়ারা নদীর শেওলা ফেরিঘাট এবং সীমান্তবর্তী সরাপারেও তাদের ক্যাম্প ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনী বিয়ানীবাজার দখল করার পর স্থানীয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামীর নেতা-কর্মী এবং স্থানীয় দালালরা তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিল মুসলিম লীগ নেতা আব্দুর রহিম ওরফে বচন হাজী (শ্রীধরা-নবাং) এর সদস্য ছিল হাজী সিকন্দর আলী (নয়াগ্রাম), মছদ্দর আলী মষট্রি (কসবা), ফুরকান আলী মাস্টার (খাসা), আব্দুল মালিক তাপাদার ওরফে দুদু মিয়া (মুল্লাগ্রাম), আব্দুল হক কুটুমনা (শ্রীধরা), মজির উদ্দিন চেয়ারম্যান (পাতন), আব্দুল হেকিম তাপাদার (কসবা), মোক্তার আলী (শ্রীধরা), হাফিজ উদ্দিন (শ্রীধরা), কুতুব উদ্দিন চেয়ারম্যান (মুড়িয়া ইউপি), বাবুল মিয়া (ঘুঙ্গাদিয়া), ছাদউদ্দিন (বড়দেশ), মুজম্মিল আলী ওরফে কালামিয়া (খাসাড়িপাড়া), কাজী ইব্রাহিম আলী (বড়দেশ), সুলেমান হোসেন খান (বড়দেশ), সিতাই বিবি (ফতেহপুর), জামিল রেদওয়ান ওরফে বোরকা হাজী (মাথিউরা), আতর আলী, বাহার উল্লাহ, মতছির আলী, ফিরোজ আলী, গনিওর রহমান, রইছ আলী, তেরা মিয়া চৌধুরী, ইউসুফ আলী, আব্দুল খালেক, মুসফিকুর রহমান চৌধুরী (চুনু মিয়া), মধু মিয়া প্রমুখ। এরা ছিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী। কেউ-কেউ ছিল গ্রাম্য মাতব্বর। এদের মধ্য থেকে ১৭ জনকে নিয়ে ‘মজলিশে সুরা’ গঠন করা হয়। মুড়িয়া ইউনিয়নের সারপারেও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর আহ্বায়ক ছিল জামায়াত নেতা মাওলানা ডা. ফজলুল করিম। এলাকায় তার পরিচিতি ছিল ‘কুত্তা মৌলভী’ হিসেবে। পাকিস্তানি বাহিনী সারপার এলাকা দখল করার পর
এ কমিটির পরামর্শে সেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর পরাজয়ের পর মাওলানা ফয়জুল করিম পাকিস্তানে পালিয়ে যায় এবং প্রায় ১৫ বছর সেখানে অবস্থান শেষে ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশে ফিরে আসে।
রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল শফিক আহমদ (দেউল)। সে বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকার বাহিনীর জন্য সদস্য সংগ্রহ করত। আলবদর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল আব্দুল রাজ্জাক। বিয়ানীবাজারের আরেকজন শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছিল নেজামে ইসলামীর সভাপতি মাওলানা আতাহার আলী (ঘুঙ্গাদিয়া)। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে কিশোরগঞ্জ শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি ছিল। তার প্রতিষ্ঠিত জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসা ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের ট্রেনিং সেন্টার। এসব স্বাধীনতাবিরোধী পাকবাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে বিয়ানীবাজারের ১২৮ জন সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের মধ্যে ৮০ জন বিয়ানীবাজারে এবং ৪৮ জন দেশের অন্যত্র শহীদ হন। শহীদদের মধ্যে মুসলমান ১০৪ জন এবং হিন্দু ২৪ জন। তাদের মধ্যে আবার নারী ছিলেন ৯ জন ও পুরুষ ১১৯ জন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বিয়ানীবাজারে যত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও অগ্নিকাণ্ড ঘটায়, তার পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল শান্তি কমিটির আহ্বায়ক আব্দুর রহিমের। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সে এসবে লিপ্ত হয়। তার ইঙ্গিতে প্রথম হত্যাকাণ্ড শুরু হয় আলীনগর ইউনিয়নে। ১০ই এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট শহর শত্রুমুক্ত করার জন্য মরণপণ লড়াই করেন। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী বিমান হামলা চালায়। তাতে আলীনগর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের দুই ঠিকাদার সাইদুর রহমান ও সইয়ব আলী শহীদ হন। এরপর ঐ এলাকার গাড়িচালকরা সড়কে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেয়। এ-সময় আব্দুর রহিম এলাকার অবস্থা স্বাভাবিক এটা প্রমাণ করার জন্য চালকদের গাড়ি চালানোর নির্দেশ দেয়। যারা অস্বীকার করে, তাদের তালিকা প্রস্তুত করে সে পাকবাহিনীকে খবর দেয়। পাকবাহিনী এসে তালিকা অনুযায়ী আলীনগর ইউনিয়নের কাদিমল্লিক গ্রামের আব্দুল হামিদ চৌধুরী, চারখাই নয়াখানী গ্রামের মতিউর রহমান ওরফে মাসুক মিয়া এবং ঢাকা উত্তর মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আসফাক উদ্দিনকে হত্যা করে। পাকিস্তানি দালাল ফয়েজ আহমদের ইঙ্গিতে টিকরপাড়ার আব্দুল লতিফকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। হিন্দু ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে অস্বীকার করায় পাকসেনারা ৬০ বছর বয়স্ক প্রবাসী আব্দুল বারিক ওরফে রজিদ আলী জঙ্গীকে চারখাই-সিলেট সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতার পক্ষে তৎপরতা চালানোর অভিযোগে ফাজিলপুর গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী আশফাক আহমদকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।
সিলেট-বিয়ানীবাজার সড়কের সড়কভাংনী ব্রিজে অপারেশন চালাতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেয়ার অভিযোগে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা আশপাশের এলাকার লোকজনের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। শান্তি কমিটির সদস্য ফুরকান আলী মাস্টারের ইঙ্গিতে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর বার্তাবাহক বৈরাগীবাজার-খশিরগ্রামের জামালউদ্দিন ও ঘুঙ্গাদিয়ার মনোহর আলীকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। স্বাধীনতার পক্ষে গান গাওয়ার কারণে মাথিউরা গ্রামের রাজাকার জামিল রেদওয়ান ওরফে বোরকা হাজীর ইন্ধনে বাউল শিল্পী কমরউদ্দিনকে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই পাকবাহিনী তাদের স্থানীয় দোসরদের সহযোগিতায় স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করা শুরু করে। অভিনব কায়দায় তাদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এভাবে তারা এক নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে। বিশেষকরে তাদের সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসার শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। স্বাধীনতাবিরোধীরা শুধু রাজনৈতিক কারণেই নয়
ব্যক্তিগত জিঘাংসা, সম্পত্তির লোভ এবং যৌনলালসা মেটানোর জন্যও তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এর ফলে অনেকে জীবন ও সম্পদ হারায়।
২৭শে এপ্রিল জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের প্ররোচনায় চারখাইর জালালনগর গ্রামের ৭৫ বছর বয়স্ক ইয়াজ মিয়া তাপাদার ওরফে জলশাহ ফকিরকে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর অপরাধ তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থক। পরদিন নইরচক হিন্দুপাড়ায় অভিযান চালিয়ে দুই বৃদ্ধ নরেশ দাস ও রূপীচরণ দাসকে ধানকাটার কাস্তে দিয়ে গলার রগ কেটে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। নরেশ দাসের একমাত্র পুত্র সুনীল চন্দ্র দাস পিতার এই মর্মান্তিক মৃত্যুখবর শুনে নিজেও মারা যায়। বাঘবাড়ির বাস ড্রাইভার আব্দুল মান্নানকে হত্যা করে কুশিয়ারা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সে নিজের গাড়িতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা-নেয়া করত। গ্রাম থেকে জোর করে নারীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দেয়ায় জালালনগর- ফরগ্রামের আব্দুল খালিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি হায়নাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি জালালনগর গ্রামের সরকুম আলী নামে একজন প্রতিবন্ধীও। পাকসেনাদের দেখে ভয় পেয়ে দৌড় দিলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এলোপাতাড়ি গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারায় লাংলাকোনার সুনাহর আলীর ৯-১০ বছরের শিশুকন্যা বেগুন বিবি। মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর সন্দেহে একজন অজ্ঞাতনামা মুক্তিযোদ্ধাকে চারখাই বাজার থেকে আটক করে পল্লীশাসন গ্রামের ভাঙ্গার সড়কের পাশে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে এলাকাবাসী তাঁর লাশ স্থানীয় গোরস্থানে দাফন করে। পাকবাহিনী ২০শে মে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে দুবাগ ইউনিয়নের নয়াদুবাগ এলাকায় প্রবেশ করে প্রথমেই অভিযান চালায় হিন্দুদের ধর্মীয় স্থান নয়াদুবাগ আখড়ায় সেখানে ৮০ বছর বয়সী বালকদাস বৈষ্ণব ও ৫০ বছর বয়সী কামিনীচরণ দাস নামক দুজন সন্নাসীকে তারা হত্যা করে। সীমান্ত থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয় দক্ষিণ দুবাগের মণীন্দ্র চন্দ্র দাসকে। ২৪শে মে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজন হওয়ার অভিযোগে বশির আলী লাই, তজমান আলী, জমির আলী (বলাই মিয়া), সিদেক আলী (সিদই মিয়া) ও নুর আলীকে ধরে এনে মেওয়া এলাকার কুশিয়ারা নদীর তীরে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করায় সাতলপার- কোনাগ্রামের ৫০ বছর বয়স্ক কৃষক আইয়ুব আলীকে হত্যা করা হয়। জমি দখলের বিবাদের জেরে রাজাকারদের ইঙ্গিতে পাকবাহিনীর হত্যার শিকার হন নয়াদুবাগের মফজ্জিল আলী মবই, ময়না মিয়া ও কলেজ ছাত্র আব্দুল জলিল মাখন। শেওলা ইউনিয়নের ঢেউনগর গ্রামে অভিযান চালিয়ে পাকবাহিনী বারীন্দ্র নমশূদ্রকে হত্যা করে। দিঘলবাকের আব্দুল ওয়াহিদ ক্ষেতে ধান কাটার সময় পাকবাহিনীর মর্টার হামলায় প্রাণ হারান। এ এলাকার আরেক শহীদ হচ্ছেন চারাবইর লেচু বিবি। কুড়ারবাজার ইউনিয়নের খশির-বৈরাগীবাজার গ্রামের জামালউদ্দিন মুক্তিবাহিনীর বার্তাবাহক হওয়ায় এক রাজাকারের সহযোগিতায় পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে প্রাণ হারান।
পাকিস্তানি সৈন্যরা আকস্মিকভাবে গোবিন্দশ্রী বাজারে প্রবেশ করে জন্মান্ধ আব্দুল হাইকে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী ৭ই জুন বিয়ানীবাজার থানা দখলের পর কসবা- বড়বাড়ি থেকে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আজিজের ভাই রেফারি আব্দুল মান্নানের স্ত্রী ও সন্তানদের, ফতেহপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেনের পিতা ও ভাই এবং মাথিউরার একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাই সিরাজ উদ্দিন সিরইর স্ত্রীকে ধরে আনে। স্বজনদের রক্ষায় আত্মসমর্পণ করলে আব্দুল মান্নান ও সিরাজ উদ্দিন সিরইকে হত্যা করা হয়। স্বজন মুক্তিযোদ্ধা শুধু এই অপরাধে আলতাফ হোসেনের পিতা তাহির আলী ও ভাই আবুল হোসেন নিজামকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়।
পাকিস্তানি হানাদাররা এলাকায় আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য এলোপাতাড়িভাবে মর্টার শেল নিক্ষেপ করত। এমন একটি শেলের আঘাতে শহীদ হয় কসবা গ্রামের আব্দুল কাদিরের চার বছরের শিশুপুত্র আখতার হোসেন সাউন। মাথিউরার দুধবক্সী-দিঘীরপারের আব্দুল আজিজ মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় পাকসেনারা তাঁর দুই ভাই আব্দুল হাসিব ও আব্দুল লতিফকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
মুল্লাপুর ইউনিয়নের (বর্তমানে বিয়ানীবাজার পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত) সুপাতলা গ্রামের মনোরঞ্জন ঘোষের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন বর্তাবাহককে আশ্রয় দেয়ায় তার এবং উমানন্দ ঘোষের পরিবার আক্রান্ত হয়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এই দুই পরিবারের ১৪ জনকে বন্দি করে নির্মম নির্যাতনের পর ২৪শে জুলাই রাধুটিলায় হত্যা করে, যা রাধুটিলা গণহত্যা নামে পরিচিত। হত্যার পর নিহতদের লাশ ওখানেই কবর দেয়া হয়। তাই কবরের স্থানটি রাধুটিলা গণকবর হিসেবে পরিচিত। রাজাকাররা ঐ বাড়িদুটি লুট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সুপাতলা গ্রামের শ্রমিক মিছির আলী ও মুরাদগঞ্জ বাজারের নৈশ প্রহরী ছলু খলিফাকে বিনা কারণে পথিমধ্যে পাকবাহিনী হত্যা করে।
যুদ্ধের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে পাকবাহিনীর মুড়িয়া ইউনিয়নের পূর্ব মুড়িয়া এলাকা দখলে নেয়ার পর স্থানীয় রাজাকারদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের ধরে এনে হত্যা করে। ২৬শে সেপ্টেম্বর ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে নয়াগ্রামের আব্দুন নুর জমাদারের পুকুরপাড়ে গণকবর দেয়। এ ঘটনা পূর্ব মুড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অভিযোগে পিতাকে জিম্মি করে পুত্র মোস্তফা হোসেন চৌধুরী রেদন মিয়াকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হওয়ার কারণে মাকে জিম্মি করে পুত্র রাতিবুর রহমান চৌধুরীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। ধানক্ষেতে কর্মরত অবস্থায় নয়াগ্রাম- পুন্নারাইর কৃষক তজিদ আলীকে বিনা কারণে হত্যা করা হয়। সারপার এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে দখল করার উদ্দেশ্যে পাকবাহিনীর মর্টার হামলা চালায়। এতে প্রাণ হারান আস্টঘরির রফিক উদ্দিন ও আব্দুল লতিফ এবং সারপার-সৈয়দবাড়ির গোলাম সরওয়ার। নয়াগ্রামের ইউসুফ আলী এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন জকিগঞ্জের উজিরপুর গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে। সেখানে পাকবাহিনীর এলোপাতাড়ি মর্টার হামলায় তিনি প্রাণ হারান। একইভাবে তাজপুর গ্রামের ফিরোজ মিয়ার শিশুকন্যা বেগম পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন দুবাগের নয়াদুবাগ-চকরবন্দের এক বাড়িতে আশ্রয় নিলে সেখানে মর্টার হামলায় সে প্রাণ হারায়। নয়াগ্রামের ৫০ বছর বয়স্ক ভিক্ষুক নজির মাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারায়।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এক রাতে লাউতা ইউনিয়নের জলঢুপ-বড়গ্রামের দুটি হিন্দু বাড়িতে আক্রমণ চালায়। এতে প্রাণ হারান গুরুপ্রসন্ন দাস ও রাধারমণ দাস। পাড়িয়াবহর গ্রামের ডা. নিশিকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কাউকে না পেয়ে তাঁর গৃহভৃত্য শ্রীমান ও দিনমজুর মুহিব আলীকে হত্যা করে। অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে প্রাণ হারান কালিবরের আমই।
বিয়ানীবাজারের অধিবাসী কিন্তু পেশাগত কিংবা অন্য কোনো কারণে যাঁরা অন্যত্র শহীদ কিংবা নিখোঁজ হন, তাঁরা হলেন- লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্ৰ দেব (জি সি দেব)। তিনি ২৫শে মার্চ রাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রাক্কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ক্যাম্পাসে শহীদ হন। কালাইউরা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সেনাকর্মকর্তা লে. কর্নেল এম এ হাসিব মুক্তিযুদ্ধকালে নিখোঁজ হন। বাহাদুরপুরের আতিক উদ্দীন চৌধুরী ছিলেন আর্মির সিগন্যাল রেজিমেন্টের ল্যান্স নায়েক। ৩১শে মার্চ পাকসেনারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ব্যারাকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। চারখাই ইউনিয়নের নাটেশ্বরের সন্তান কুদরত এলাহী চৌধুরী রাজশাহী-সিরাজগঞ্জের এডিসি জেনারেল ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর পর সেখান থেকে তিনি নিখোঁজ হন। দুবাগ ইউনিয়নের সাদিমাপুর-বাঙ্গালহুদার সন্তান ইরশাদুর রহমান চৌধুরী পুলিশের হাবিলদার হিসেবে যশোর পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিখোঁজ হন। তাঁর সন্ধানে গিয়ে তাঁর পুত্র কলেজ ছাত্র রুহুল আমীন চৌধুরী এবং এক জামাতাও নিখোঁজ হন। শেওলা ইউনিয়নের শালেশ্বর গ্রামের সন্তান পুলিশ অফিসার আব্দুর রহমান চৌধুরী (পংকী মিয়া) লালমনিরহাটে কর্মরত অবস্থায় বিহারিদের হাতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাকসেনাদের হাতে শহীদ হনে। পংকী মিয়ার দ্বিতীয় পুত্র কলেজ ছাত্র তোহফা এলাহী চৌধুরী তোফায়েল ও ভাতিজা স্কুলছাত্র আবুল হাসনাত রাজনও বিহারিদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। শেওলা ইউনিয়নের দেউল গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা বাবরুল হোসেন বাবুলের দুই ভাই পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন। পাকবাহিনী বাবুলকে খুঁজতে এসে তাঁর ভাই নূরুল হুদা গউসকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। ছাত্রলীগ নেতা আবুল হোসেন ঢাকা থেকে ছাত্রলীগের লিফলেট নিয়ে ফেরার পথে সিলেট বিমানবন্দরে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন। আঙ্গুরা মোহাম্মদপুরের আব্দুর রহমান তাঁর কৃষিকাজের স্থল সিলেটের জাফলং-এর বাড়িতে পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হনে। বিয়ানীবাজার ইউনিয়নের খাসাড়ীপাড়ার ইউসুফ আলী শেখের পুত্র আতর আলী শেখ সিলেট শহরে অবস্থানকালে হত্যার শিকার হন। ঘুঙ্গাদিয়া- মাঝরবাড়ির মিছির আলীর ব্যবসা ছিল জগন্নাথপুর থানার রাণীগঞ্জ বাজারে। সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরো অনেকের সঙ্গে তাঁকেও পাকবাহিনী ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। ঘুঙ্গাদিয়ার আব্দুল আজিজ নিজাম হবিগঞ্জ মহকুমার কৃষি কর্মকর্তার গাড়িরচালক ছিলেন। অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। মুড়িয়া ইউনিয়নের নয়াগ্রামের আব্দুল খালিক সিলেটের সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাকবাহিনীর বিমান হামলায় শহীদ হন। তিলপারা ইউনিয়নের মনোহর আলী খুলনায় বিহারিদের হাতে শহীদ হন।
পাকবাহিনীর কয়েকজন স্থানীয় দালাল ডাকবাংলো ক্যাম্পে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের মনোরঞ্জনের দায়িত্ব পালন করত। তাদের অন্যতম সিতাই বিবি বিভিন্ন এলাকার যুবতী ও গৃহবধূদের সন্ধান এনে শান্তি কমিটির সদস্য আব্দুল হক কুটুমনাকে দিত। তার নির্দেশে নারীদের ক্যাম্পে ধরে এনে ধর্ষণ করা হতো। একে তথাকথিত বৈধতা দেয়ার জন্য কুটুমনার সঙ্গে ঐসব নারীর প্রহসনমূলক বিয়ে দেয়া হতো। একইভাবে জলঢুপ-পাড়িয়াবহর হাকাইতির অঞ্জলি বিশ্বাসকে জোরপূর্বক ধরে এনে কুটুমনা বিয়ে করে। এরপর সুপাতলার মহানন্দ ঘোষের বাড়িতে আটকে রেখে অনেকে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে অঞ্জলিকে মুসলমান বানিয়ে ক্যাপ্টেন গন্ডলের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। কিছুদিন পর আবার তাকে বিয়ে করে কুটুমনা। জ্যোৎস্না এবং কল্পনা নামে দু’জন নারীকে স্থানীয় রাজাকার শামসউদ্দিন ধরে এনে গণ্ডলের কার্যালয়ে দুদিন আটকে রাখে। একদিন আওয়ামী লীগ সমর্থক জনৈক ব্যক্তির যুবতী কন্যাকে জোর করে ধরে আনতে যায় আব্দুল হক কুটুমনা। অসহায় ব্যক্তি তার কন্যাকে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে দুদিনের সময় চায়। তারপর সে রাতেই সে মেয়েকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। কিন্তু এর আগে ঐ ব্যক্তির আরেক মেয়েকে রাজাকাররা ধরে এনে কসবা গ্রামের এক মক্তবঘরে একরাত আটকে রাখে। গোবিন্দ্রশ্রী গ্রামের এক যুবতী মেয়েকে পাকসেনারা জোরপূর্বক চারখাই ক্যাম্পে ধরে এনে ৩-৪ দিন আটকে রাখে। মে মাসের দিকে চারখাই ক্যাম্পের দুজন পাকসেনা জালালনগর-ফরগ্রামে হানা দেয়। তারা যৌনলালসা মেটানোর জন্য গ্রামের এক মহিলাকে অপহরণের চেষ্টা চালায়। স্থানীয় যুবক আবদুল খালিক কৌশলে তাদের আটকে ফেলেন। তারপর মাফ চেয়ে তারা ছাড়া পায়। সৈন্যরা ক্যাম্পে গিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে আবার ফিরে এসে আবদুল খালিকের বাড়িতে আক্রমণ চালায়। সেখান থেকে তিনজন পুরুষকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আবদুল খালিক পালানোর চেষ্টা করলে গুলিবিদ্ধ হয় এবং কয়েকদিন পর মারা যায়। চারখাই এলাকার একজন নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। শেওলা ক্যাম্পে নারীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন করা হতো। তাদের ছাড়িয়ে নিতে আসা নারী স্বজনরাও নির্যাতনের শিকার হতেন। পাতন এলাকার একজন নারী পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের শিকার হয়ে যুদ্ধকালীন সময়েই আত্মহত্যা করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে পূর্ব মুড়িয়া এলাকা দখল করার পর পাকিস্তানি নরপিশাচরা সারপারসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে এক বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন এলাকা ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। সাধারণ পরিবারের পুরুষরাও ভয়ে এলাকা ছাড়ে। পুরুষশূন্য এলাকায় পাকসেনারা গণধর্ষণ চালায়। এভাবে যে কত রমণীর সভ্রম নিয়ে হায়নারা ছিনিমিনি খেলেছে, তার কোনো হিসাব নেই। ২৫০ জনের মতো নারীকে স্বাধীনতার পর ভারতে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়।
পাকবাহিনী ডাকবাংলোতে অবস্থান নেয়ার পর বাংলোর রান্নাঘরকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্বাধীনতাকামীদের ধরে এনে এ ঘরের বিমের সঙ্গে পা ওপরের দিকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হতো। রান্নাঘরে জায়গা না হলে বাংলোর আমগাছ ও কাঁঠাল গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হতো। শারীরিক নির্যাতনের আগে মঈনউদ্দিন আহমদ নামে একজন ডাক্তার সময় নির্ধারণ করে দিত। এ ক্যাম্পে ধুঁকে-ধুঁকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে অনেক যুবক, পৌঢ় এবং বৃদ্ধ। এখানকার সবচেয়ে লঘুদণ্ড ছিল প্রখর রোদে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা। নির্যাতন শেষে যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো, তাদের পাঠিয়ে দেয়া হতো নিকটস্থ কাঁঠালতলা বধ্যভূমিতে।
পাকবাহিনীর ডাকবাংলো ক্যাম্প সংলগ্ন কাঁঠালতলা (বর্তমান উপজেলা কমপ্লেক্স) এবং নিকটস্থ রাধুটিলা (বর্তমান কেন্দ্ৰীয় স্মৃতিসৌধের স্থান) এ দুটি ছিল বধ্যভূমি। স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী- কাঁঠালতলা বধ্যভূমি পরিদর্শন করেন এবং সেখান থেকে উদ্ধারকৃত কঙ্কালের প্রতি সামরিক নিয়মে অভিবাদন জানান। চারখাই ইউনিয়নের গদারবাজার গ্রামের গোরস্তানে পাকবাহিনী একটি গণকবর তৈরি করেছিল। বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে যাদের হত্যা করা হতো, তাদের লাশ এখানে এনে পুঁতে রাখা হতো।
বিয়ানীবাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি বড় যুদ্ধ হয় – সুতারকান্দির যুদ্ধ ও সারপারা যুদ্ধ। ২৪শে মে সংঘটিত সুতারকান্দির যুদ্ধে ২৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ক্রসফায়ারে পড়ে একজন বাঙালি রাখাল বালক প্রাণ হারায়। এছাড়া দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। আগস্ট মাসে সংঘটিত সারপারার যুদ্ধে উভয় পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং পাকবাহিনী ঐ এলাকা দখল করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালায়।
৬ই ডিসেম্বর রাতের আঁধারে পাকবাহিনী ডাকবাংলো ছেড়ে পালিয়ে গেলে ঐদিনই বিয়ানীবাজার হানাদারমুক্ত হয়। এরপর কুকিল সাবসেক্টর-এর মুক্তিযোদ্ধারা বিয়ানীবাজারে প্রবেশ করে এবং পুলিশ স্টেশনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হারুন আহমেদ চৌধুরী, বীর উত্তম- (পিতা বিচারপতি আব্দুস সোবহান চৌধুরী, আদিনাবাদ), মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, বীর উত্তম- (পিতা আলহাজ্জ্ব শরাফত আলী), তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম (পিতা শাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী, নাটেশ্বর) ও ইমাম-উজ-জামান, বীর বিক্রম (পিতা ডাক্তার মোছাদ্দের আলী চৌধুরী, উজানঢালী)।
বিয়ানীবাজার উপজেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। তাঁদের মধ্যে ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- আলীনগর ইউনিয়নের ছালিক উদ্দিন চৌধুরী (পিতা জলিল উদ্দিন চৌধুরী, আলীনগর; ইপিআর- এর নায়েক সুবেদার, ২৫শে মার্চ ঢাকার পিলখানা প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ), আবদুল খালিক চৌধুরী (ছালিক উদ্দিন চৌধুরীর ছোটভাই; ইপিআর সদস্য, রংপুর সীমান্তে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), আরব আলী (পিতা মোহাম্মদ কালা, আলীনগর; ইপিআর সদস্য, ২৫শে মার্চ ঢাকার পিলখানা প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ), মুজম্মিল আলী (পিতা মজিদ আলী, উত্তরভাগ নসিরখানী; ইপিআর সদস্য, হরিপুরের মানিগঞ্জ বাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আবদুল মানিক (পিতা তেরা মিয়া, খলাগ্রাম; দিনমজুর, জৈন্তাপুরের হরিপুর সিকনাগুলে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ); চারখাই ইউনিয়নের আবদুস শহীদ (পিতা মনির = আলী, মান্দারগাঁও; ছাত্র, বড়লেখার সুজানগরে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আতর আলী (পিতা হামিদ আলী, মান্দারগ্রাম; কৃষক, জকিগঞ্জের রাজনীগ্রামে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মতিউর রহমান মছন (পিতা কুতুব আলী, পইলগ্রাম; বড়লেখার সুজানগরে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ); দুবাগ ইউনিয়নের মাসুম আহমদ চৌধুরী ওরফে চুনু মিয়া (পিতা ময়না মিয়া, দক্ষিণ চরিয়া; ছাত্রলীগ কর্মী, কুলাউড়ার দিলকশা চা-বাগানে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মানিকুর রহমান (পিতা ফয়জুর রহমান, দক্ষিণ চরিয়া; কৃষক, জকিগঞ্জের আটগ্রামে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আবদুল গণি (পিতা মিছির আলী, সাদিমাপুর সিলেটীপাড়া; ছাত্রলীগ কর্মী, ঐ), আবুল হোসেন (পিতা ইমরান আলী, গজুকাটা; রাজমিস্ত্রী, জৈন্তাপুরের হরিপুর সিকনাগুলের যুদ্ধে শহীদ); কুড়ারবাজার ইউনিয়নের রাগিব আহসান মামুন (পিতা আবদুল মুনিম, আঙ্গুরা; ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী, রাঙ্গামাটিতে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), বিয়ানীবাজার ইউনিয়নের এম এ মুমেন মানিক (পিতা রইছ উদ্দিন, কসবা নয়াবাড়ি; মেকানিক, ফেঞ্চুগঞ্জে অপারেশন শেষে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ), আফতাবউদ্দিন আতাই (পিতা মবারক আলী, শ্রীধরা; ইপিআর-এর সিপাহি, ২৫শে মার্চ ঢাকার পিলখানা প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ), আকদ্দস আলী (পিতা নাজির আলী, শ্রীধরা ফকিরের গোষ্ঠী; ইপিআর-এর সিপাহি, চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে নিখোঁজ), আজিজুর রহমান বলু (পিতা তৈয়ব আলী, শ্রীধরা; ইপিআর-এর নায়েক, জকিগঞ্জের আটগ্রামে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ); মাথিউরা ইউনিয়নের নামর আলী (মাথিউরা পশ্চিমপাড়/বহরগ্রাম-বানীগ্রাম, জুড়ির লাঠিটিলা অপারেশনে শহীদ), আবদুল মতিন (পিতা মুবশ্বির আলী, খলাগ্রাম; ছাত্রলীগ কর্মী, ময়মনসিংহে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ); মুল্লাপুর ইউনিয়নের রবি চক্রবর্তী (পিতা রাধারমণ চক্রবর্তী, নিদনপুর; ছাত্র, যুদ্ধশেষে ফেরার অপেক্ষায় মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে শহীদ), ইব্রাহিম আলী (পিতা ছফর আলী, নিদনপুর; ট্রাক ড্রাইভার, শায়েস্তাগঞ্জে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ); মুড়িয়া ইউনিয়নের ছমির উদ্দিন (পিতা তৈয়ব আলী, আস্টঘরি; কৃষক, কুলাউড়ার মেরিনা চা- বাগানে অপারেশন শেষে পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হন, পরে সিলেট কারাগারে বিমান হামলায় শহীদ), জালাল উদ্দিন (পিতা মহরম আলী, টেকইকোনা; পুলিশের সিপাহি, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ), আবদুল খালিক (পিতা নিমার আলী, তাজপুর; ছাত্র, জুড়ির দিলকশা চা-বাগানে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), তৈয়ব আলী (তাজপুর; কৃষক, গোলাপগঞ্জের আমুড়ার সুন্দিশাইলে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ); লাউতা ইউনিয়নের মেজর আবদুল হাসিব (পিতা মনফর আলী মিয়া, কালাইউরা; সেনাকর্মকর্তা, কুমিল্লায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), আবদুর রব (পিতা সমর আলী, টিকরপাড়া; সেনাকর্মকর্তা, ঐ), কুটুচান্দ (পিতা লাল মিয়া, নন্দিরফল; দিনমজুর, ভারত থেকে দেশের অভ্যন্তরে অপারেশনে এসে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), খতিব আলী (পিতা মছই মিয়া, গাঙ্গপাড়; কৃষক, ভারত থেকে দেশের অভ্যন্তরে অপারেশনে এসে বড়লেখার নিজবাহাদুরপুরে রাজাকারদের হাতে শহীদ), আবদুর রহিম (পিতা আবদুর রশিদ আলী, বারইগ্রাম; কৃষক, সিলেটের হরিপুর বাগরখান জঙ্গলে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), হাবিলদার কুতুব উদ্দিন (গুলাটিকর; ইপিআর সদস্য, বড়লেখার লাতুযুদ্ধে শহীদ) এবং আতিক উদ্দীন চৌধুরী (পিতা রশিদ উদ্দিন চৌধুরী, বাহাদুরপুর; সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক, কুমিল্লায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ)।
বিয়ানীবাজারের বাইরের দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার একজন হলেন মোহাম্মদ ইউনুস (চট্টগ্রাম, সারপার যুদ্ধে শহীদ)। অপরজনের নাম জানা যায়নি, তবে চারখাই ইউনিয়নের পল্লীশাসন গোরস্তানে তাঁর কবর আছে। বাইরের দুজনসহ ৩৪ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ২৬ জনের বয়স ছিল ১৫- ৩০ বছরের মধ্যে, আর ৮ জন ছিলেন ত্রিশোর্ধ্ব। তাঁদের মধ্যে রণাঙ্গণে প্রাণ দিয়েছেন ২২ জন, বাকিরা হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসোরদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে ৮ জন ছিলেন ইপিআর, ২ জন সেনাসদস্য এবং ২ জন পুলিশ। বাকিদের মধ্যে ১০ জন ছিলেন কৃষক, ২ জন গাড়িচালক, ২ জন দিনমজুর, ১ জন রাজমিস্ত্রি এবং ৭ জন ছাত্র।
উপজেলার শহীদদের স্মরণে কাঁঠালতলা বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ এবং রাধুটিলা বধ্যভূমিতে কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া ড. জি সি দেবের লাউতা গ্রামের বাড়িতে, মাথিউরায় বাউলশিল্পী কমরউদ্দিনের কবরে, দুবাগ ইউনিয়নের দক্ষিণ চরিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ আহমদ চৌধুরীর কবরে এবং বৈরাগীবাজার-সড়কভাংনী গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বার্তাবাহক জামালউদ্দিনের স্মরণে একটি করে স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [আজিজুল পারভেজ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড