মুক্তিযুদ্ধে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ
বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক, চারুকলা প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের শিল্পীরা এতে সংগঠিতভাবে যোগ দিয়েছিলেন। ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ নামে তাঁরা একটি সংগঠন গড়ে তুলে তার পতাকাতলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। শিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ করার তাগিদ থেকে প্রথমে প্রেসক্লাবে একটি সভা আহ্বান করা হয়। সেখানে প্রথমে “শিল্পী সমিতি’ নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়, যার সভাপতি হন লায়লা আর্জুমান্দ বানু ও সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দ আবদুল হাদী। দুজনই সংগীতশিল্পী হওয়ায় পরে সভাপতির বাড়িতে একটি সভা ডেকে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ নামে নতুন সংগঠন সৃষ্টি করা হয়। এর আহ্বায়ক হন সৈয়দ হাসান ইমাম, যুগ্ম-আহ্বায়ক হন আতিকুল ইসলাম (বুলবুল ললিতকলা একাডেমির শিক্ষক) ও ওয়াহিদুল হক (ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা) এবং কোষাধ্যক্ষ হন সুফিয়া কামাল। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের ৬ই মার্চ বাংলা একাডেমির বটতলায় উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় শিল্পীরা স্বাধীনতার জন্য যে-কোনো ত্যাগ স্বীকারের শপথ গ্রহণ করেন। লায়লা আর্জুমান্দ বানুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। সৈয়দ হাসান ইমামসহ এতে আরো বক্তৃতা করেন মোস্তফা জামান আব্বাসী, আনোয়ার হোসেন, ওয়াহিদুল হক, গোলাম মোস্তফা, আতিকুল ইসলাম, নায়ক রাজ্জাক, খান আতাউর রহমান, শামসুল হুদা চৌধুরী, সিরাজুল মজিদ মামুন (সংবাদ পাঠক), তাজুল ইসলাম (সংবাদ পাঠক) প্রমুখ। বক্তারা শিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁরা বলেন, দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে শিল্পীরাও এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেন। দেশের শিল্পীদের এখন সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে সমস্ত রকম বন্ধন-মুক্তির গান শোনাতে হবে। বেতার- টিভি-চলচ্চিত্র-সংগীত আর অঙ্কন শিল্পীদের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে গৃহীত প্রস্তাবে জাগ্রত বাংলার মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, শিল্পী সমাজও আজ বিক্ষুব্ধ। তারা এই মর্মে শপথ নেয়— কণ্ঠশিল্পীরা গণসংগীত স্কোয়াড বের করবে, যন্ত্রশিল্পীরা তবলা ছেড়ে ধরবে দামামা, অভিনেতা- অভিনেত্রীরা সংগ্রামের সংলাপ উচ্চারণ করবে আর চিত্রশিল্পীরা আঁকবে সংগ্রামী ছবি। বেতার-টিভিতে সরকারি কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধের তীব্র নিন্দা করে বলা হয়, রাজপথে যখন ব্যাপক গণহত্যা চলছে, আমাদের ভাইয়েরা যখন স্বাধিকার আন্দোলনে রাজপথ প্রকম্পিত করছে, তখন বেতার-টিভির মনোরম পরিবেশে আমরা প্রেমের সংগীত, চটুল বাক্য ব্যয় আর মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করতে পারি না। তাই আমরা জনতার কাতারে ফিরে এসেছি। এখন থেকে আমাদের গান হবে শিকল ভাঙার, আগুন জ্বালার। সমাবেশ শেষে শিল্পীদের এক বিরাট মিছিল রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। মিছিল বেতার-টিভি ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে প্রেস ক্লাবে গিয়ে শেষ হয়। পরদিন ছিল ৭ই মার্চ ঐদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতার-টিভিতে প্রচারের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপিত হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে এ বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, বেতার-টিভির অধিকাংশ শিল্পীই ১লা মার্চ থেকে অনুষ্ঠান বর্জন করে আসছিলেন। সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে নির্দেশনা চান। কর্তৃপক্ষ তাঁদের কথা অনুযায়ী কাজ করলে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। শিল্পীরা তখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। কর্তৃপক্ষ শিল্পীদের দাবি মেনে নেন, তবে দুটি শর্ত দেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ৮ই মার্চ বেতার-টিভির শিল্পীরা এ মর্মে এক ঘোষণা দেন যে, বেতার-টিভির সকল অনুষ্ঠান পূর্ব বাংলার বর্তমান গণ আন্দোলনের অনুকূল হবে এ শর্তে বিক্ষুব্ধ শিল্পীরা ১০ই মার্চ থেকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে।
এ-সময় বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলার ন্যায্য অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি প্রদান করা হয়। ৩৩ জন চলচ্চিত্র শিল্পী এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন- আবদুল জব্বার খান, সালাউদ্দীন, ইফতেখারুল আলম, খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদ, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, মুস্তাফিজ, আবুল খায়ের, আনোয়ার হোসেন, নায়ক রাজ্জাক, শবনম, রোজী সামাদ, কবরী, সুচন্দা, সুজাতা, আজিম, সুলতানা জামান, কিউ এম জামান, ই আর খান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, সত্য সাহা, আলমগীর কুমকুম, সুবল দত্ত, হায়দার আলী, আখতার হোসেন, নুরুল হক বাচ্চু প্রমুখ।
১৫ই মার্চ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের উদ্যোগে ‘সংগ্রাম চলবে’ শীর্ষক গণসংগীতের আয়োজন করা হয়। ঐদিন গঠিত হয় ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ সংগ্রাম পরিষদ’। এর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- আবদুল আহাদ, ধীর আলী, গোলাম মোস্তফা, হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, নায়ক রাজ্জাক, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, কামরুল হাসান, এমদাদ হোসেন, আমিনুল ইসলাম, মোস্তফা মনোয়ার, আতিকুল ইসলাম, বারীণ মজুমদার, ওয়াহিদুল হক, ফেরদৌসী রহমান, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, সৈয়দ আবদুল হাদী, আবদুল আলীম, আলতাফ মাহমুদ, জাহেদুর রহিম, সুচরিতা, রোজী, সুচন্দা, কবরী, সুজাতা প্রমুখ।
বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পী প্রতিনিধিদের পৃথক-পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা গণসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। তাঁরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বেতার-টিভির প্রচারিত সংবাদ, সংগীত ও অনুষ্ঠানের নীতি হবে জনতাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রয়োজনে কঠোর সংগ্রামের জন্য জাগ্রত করা।
১৬ই মার্চ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের উদ্যোগে কবিতা পাঠ, গণসংগীত পরিবেশন ও ‘ভোরের স্বপ্ন’ শীর্ষক একাঙ্কিকা নাটক পরিবেশন করা হয়। কবিতা পাঠ ও গণসংগীত পরিবেশন করেন খান আতাউর রহমান, গোলাম মোস্তফা, জাহেদুর রহিম, আলতাফ মাহমুদ, অজিত রায় প্রমুখ। ১৮ ও ২১শে মার্চ বিকেলে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গণসংগীতের আয়োজন করা হয়। ২২শে মার্চ সকাল ৭টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের পক্ষে ছায়ানট গণসংগীত পরিবেশন করে। ঐদিন সন্ধ্যা ৭টায় বাহাদুর শাহ পার্কে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের উদ্যোগে গণসংগীতের আয়োজন করা হয়। বাহাদুর শাহ পার্কে এটি ছিল বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের পঞ্চম আয়োজন। এভাবে ১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকালে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ বেতার-টিভি ও রাজপথে সংগ্ৰামী সংগীত, নাটক ও কবিতা পাঠের আয়োজন করে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। [সৈয়দ আজিজুল হক]
তথ্যসূত্রঃ সৈয়দ হাসান ইমাম, আকাশ আমার ভরলো আলোয়, ঢাকা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি: ২০১৯, পৃ. ১৮২, ১৮৪-১৮৫; আরো দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও আজাদ পত্রিকায় পরিবেশিত খবর
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড