You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বিজয়নগর উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়নগর উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

বিজয়নগর উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০১০ সালে ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে এ উপজেলা গঠিত হয়। এটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা, যা জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে অবস্থিত। ১৯৫২ সালের ভাষা- আন্দোলন- থেকে শুরু করে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এ উপজেলার মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বিজয়নগরের মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরপর ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিলে এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান এডভোকেট হামিদুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর সদস্য)-এর নেতৃত্বে ২০০ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে রেসকোর্স ময়দানে যোগদান করেন। ৮ই মার্চ তিনি ঢাকা থেকে ফিরে বিজয়নগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ২০শে মার্চ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের নিয়ে এখানে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন হামিদুর রহমান। মহকুমা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উপ-প্রধান আখতারুজ্জামানসহ থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আবুল কালাম ভূঁইয়া ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ৪০-৫০ জন সদস্য এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে এখানকার প্রতিটি ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মেরাশানি হাইস্কুল মাঠ ও সিঙ্গারবিলে মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। মুক্তিযুদ্ধ জেলা কমিটির সদস্য আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া মেরাশানিতে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। সেখানে তিনি বহু মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত করে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে আগরতলা যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন শাহবাজপুরের নেপাল নাগ ও হামদু মিয়া। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করতেন।
বিজয়নগর উপজেলা ছিল ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহর অধীনে। এ উপজেলা মুকুন্দপুর অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট সায়ীদ আহমেদ। তাঁর নেতৃত্বে এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। লেফটেন্যান্ট সায়ীদ আহমেদের নেতৃত্বে এখানে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছাড়াও এলাকার বহু ছাত্র- যুবক ও কৃষক-শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— আবদুল মন্নাফ, (কান্দিপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া), গাজীউর রহমান (উলচাপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মো. রফিকুল ইসলাম (সেজামুড়া, মুকুন্দপুর), মোতালেব মিয়া, মো. দবির আহমদ ভূঁইয়া, মো. আলী আজগর ভূঁইয়া, আবদুল বাছির, মো. শামসুদ্দিন ভূঁইয়া, আবদুল মোতালেব, আব্দুল জব্বার, মো. ধন মিয়া, মো. ফিরোজ মিয়া, মো. ফুল মিয়া, সহিদ মিয়া, মো. নূর মিয়া শেখ, মো. বজলু মিয়া, মো. নূরুল ইসলাম, মো. ফিরোজ মিয়া, মো. নূরুল ইসলাম, মো. শাহ আলম ভূঁইয়া, মাজহারুল হক ওরফে মোজাম্মেল হক (রূপা, মুকুন্দপুর), রইছ মিয়া (মণিপুর), ময়দ মিয়া (আম্বাবিয়া, হরষপুর), মো. তাজুল ইসলাম এলুমিয়া (কামালমুড়া, মুকুন্দপুর), কুদ্দুছ মিয়া, জয়নাল আবেদীন, মো. আবদুল খালেক ভূঁইয়া, তাজুল ইসলাম মীর (ছুতরপুর, বিষ্ণুপুর), মো. জয়নাল আবেদীন (মহেশপুর), মোজাম্মেল হক (বক্তারমুড়া), হামদু চৌধুরী (চম্পকনগর), মো. বেনু মিয়া, আবদুল জব্বার, মো. মস্ত ভূঁইয়া, মো. হরমুজ মিয়া প্রমুখ। পথ-ঘাট, ঝোপ-জঙ্গল, জংলা সব ভেদ করে এঁরা অন্ধকার রাতেও চলতে পারতেন। মুকুন্দপুর মুক্ত করার যুদ্ধে এঁদের বিশেষ অবদান রয়েছে। ১৮ই এপ্রিল বিজয়নগরের আজমপুর ও সিঙ্গারবিল এলাকায় অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সিঙ্গারবিলে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। একটানা দুদিন প্রতিরোধের পর তৃতীয় দিন বিজয়নগর উপজেলা পাকসেনাদের দখলে চলে যায়।
১৮ই এপ্রিল আখাউড়া উপজেলার আজমপুর এলাকা দিয়ে পাকবাহিনী সর্বপ্রথম সিঙ্গারবিলে অনুপ্রবেশ করে এবং পর্যায়ক্রমে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তারা ক্যাম্প স্থাপন করে। এখানকার স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল রোস্তম আলী (অলিপুর, মুকুন্দপুর) ও হাফিজ উদ্দিন (অলিপুর, মুকন্দপুর)। এ বাহিনীর অন্য সদস্যরা হলো- মিয়ার আলী (নয়নপুর, পাহাড়পুর), আবু জাহের (নয়নপুর, পাহাড়পুর), শাহজাহান মিয়া (ঘিলামূড়া, পাহাড়পুর), অহিদ মিয়া (মাদরাইল, উত্তর ইয়াপুরা), অহিদ মিয়া (হরষপুর), ফুল মিয়া (নিদারাবাদ, হরষপুর), সলিমউল্লাহ (বুধন্তী, ইসলামপুর), সোলেমান (কেনা, বুধন্তী), চুন্নু মিয়া (বারঘরিয়া, ইসলামপুর), সুরের রহমান ( বেরুইন, ইসলামপুর), মোসলিম মিয়া (ইসলামপুর), আবদুল কাদির মেম্বার (খাটিংগা, পাহাড়পুর), মোবারক হোসেন (ইসলামপুর), আব্দুল লতিফ ওরফে কাঁচার বাপ (চেয়ারম্যান, শ্রীপুর, বিষ্ণুপুর), আবদুল মান্নান জমাদার (ছুরপুর, বিষ্ণুপুর)। এ উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল দেলোয়ার হোসেন (খাদুরাইল, ইছাপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), পাহাড়পুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আবদুল মালেক খন্দকার (মুকুন্দপুর) এবং সদস্য ছিল জিয়াউদ্দিন সরকার (খাটিংগা), হাবিবুর রহমান খন্দকার (খাটিংগা), আফছার উদ্দিন (কচুয়ামুড়া) প্রমুখ। হরষপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্য ছিল শামসুজ্জামান (নিদারাবাদ) ও নূরুল হক খান (পাঁচগাঁও)। বুধন্তী ইউনিয়ন শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিল আবদুল হেলিম মাতু মিয়া এবং সদস্য ছিল মাজু মিয়া ও সেকান্দর আলী।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে ইছাপুর (উত্তর) ইউনিয়নের আড়িয়ল বাজারে পাকসেনারা ১১ জনকে হত্যা করে, যা আড়িয়ল বাজার গণহত্যা নামে পরিচিত। ২৭শে এপ্রিল বীরপাশা ও ইসলামপুর গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে ১৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিঙ্গারবিলে পাকসেনারা ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে, যা সিঙ্গারবিল গণহত্যা নামে পরিচিত। ১৮ ও ১৯শে কামালমুড়া গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে ৯ জন নারী শিশু ও পুরুষ নিহত হয়। দাড়িয়াপুরে তারা ৩ জনকে হত্যা করে কবর দেয়।
অক্টোবর মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত এলাকা মালুহাজি মুড়াতে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী তাদের ঘাঁটি ছেড় দিতে বাধ্য হয়। এটি মালুহাজি মুড়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯শে নভেম্বর মুকুন্দপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে অনেক পাকসেনা হতাহত হয় এবং ২৮ জন আত্মসমর্পণ করে। তাদের বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ৩০শে নভেম্বর সিঙ্গারবিল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কর্নেল সফিউল্লার নেতৃত্বে এ-যুদ্ধ চলে। এতে ২০ জন পাকসেনা নিহত এবং একজন বন্দি হয়। পাকসেনাদের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। অন্যদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এদিনই বিজয়নগর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— অনারারী লেফটেন্যান্ট জনাব আলী, বীর বিক্রম (পিতা মোহাম্মদ আলী, নোয়াবদী) ও আব্দুল আউয়াল সরকার, বীর প্রতীক (পিতা আফতাব উদ্দিন সরকার, মাদগাঁও)। এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোজাম্মেল হক (পিতা মো. চান মিয়া, মুকুন্দপুর, পাহাড়পুর; মুকুন্দপুর যুদ্ধে শহীদ), মো. মহেব আলী (পিতা আব্দুল মান্নান মিয়া, মোজামুড়া, পাহাড়পুর), মো. রফিকুল ইসলাম (পিতা সৈয়দ আলী, ফুলবাড়িয়া, পত্তন; মালিহাজি মুড়ার যুদ্ধে শহীদ; বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কলাছড়া চা বাগানে তাঁর কবর রয়েছে), মো. দারু মিয়া চৌধুরী (পিতা মো. দুদু মিয়া চৌধুরী, কামালমুড়া, পাহাড়পুর), মো. দারু মিয়া (পিতা আব্দুল গফুর, মাধবের বাগ, মুকুন্দপুর, পাহাড়পুর; হবিগঞ্জ এলাকায় শহীদ; পাহাড়পুর ইউনিয়নের আউলিয়া বাজার এলাকায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়), আবু মিয়া (পাহাড়পুর ইউনিয়নের আউলিয়া বাজার এলাকায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়), মোজাম্মেল হক মতি (সেজামুড়া, পাহাড়পুর), সিদ্দিকুর রহমান (বক্তারমুড়া, বিষ্ণুপর), বজলুর রহমান (বক্তারমুড়া, বিষ্ণুপুর), দানা মিয়া (বক্তারমুড়া, বিষ্ণুপর), আবদুল মালেক (পেট্টাজুড়ি, সাটিরপাড়া, চম্পকনগর), আবদুর রহমান (মুকুন্দপুর যুদ্ধে শহীদ), মো. ইউনুছ মিয়া (সাটিরপাড়া, চম্পকনগর), হাবিলদার রফিক উদ্দিন (ফরিদপুর জেলার অধিবাসী, ৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ; চান্দুরা ডাকবাংলোর পাশে তাঁর কবর রয়েছে), ইয়াসিন খান (পিতা ইউনুছ খান, আখাউড়া যুদ্ধে শহীদ; পাহাড়পুর ইউনিয়নের ধোরানাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে তাঁর কবর রয়েছে), তালেব আলী (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ; পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিংগা গ্রামে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়), আবদুল আলিম (মালুহাজি মুড়ার যুদ্ধে শহীদ; বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কলাছড়া চাবাগানে তাঁর কবর রয়েছে) ও সিপাহি রুহুল আমিন (সিঙ্গারবিল, আখাউড়ার আজমপুর যুদ্ধে শহীদ; আজমপুরে তাঁর কবর রয়েছে)।
উপজেলার রামপুর থেকে লক্ষ্মীমোড়া বাজার পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী সড়ক। তাঁর নামে চর ইসলামপুর ইউনিয়ন ও উত্তর ইছাপুর ইউনিয়নে দুটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া কয়েকজন শহীদের কবর রয়েছে। [মানিক রতন শর্মা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড