বালুজুড়ি যুদ্ধ (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা)
বালুজুড়ি যুদ্ধ (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা) একাধিকবার সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এসব যুদ্ধে অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
চতুর্থ বেঙ্গলের ‘ব্রাভো’ কোম্পানির একটি প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুগুলো মেরামত করে মহাসড়ক সচল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ৯ই জুলাই সকাল ৮টায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চৌদ্দগ্রামের উত্তরে সড়কের ওপর বালুজুড়ি ভাঙ্গা পুলের কাছে এম্বুশ করে। বেলা ১১টার দিকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা একটি ট্রাক এবং দুটি জিপে করে মেরামতের জন্য ভাঙ্গা পুলের কাছে আসে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশ দল তাদের ওপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। গুলিতে অনেক হানাদার সৈন্য হতাহত হয়। হানাদার বাহিনী পুলের কাছ থেকে হটে গিয়ে পেছনে অবস্থান নেয়। পরে চৌদ্দগ্রাম থেকে আরো পাকিস্তানি সৈন্য এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের দলটিও একটু পিছু হটে উঁচু জায়গায় আরো শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। হানাদার বাহিনী বেলা ৩টার দিকে মর্টার, কামান ও মেশিনগানের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসের সঙ্গে এ আক্রমণ প্রতিহত করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে তিন-চার ঘণ্টা যুদ্ধের পর আক্রমণ বন্ধ করে পিছু হটে। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩০ জন সেনা নিহত ও ছয়জন আহত হয় এবং হানাদারদের সহযোগী ২ জন রাজাকার গুলিবিদ্ধ হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকে মৃতদেহগুলো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ফেলে রেখে তারা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন এবং শত্রুদের ট্রাকটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেন। যুদ্ধ শেষ হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি জঙ্গি বিমান যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করে ও মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। ১০ই জুলাই সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বালুজুড়ি এলাকায় পুনরায় এম্বুশ করে। ১১ই জুলাই বেলা ১১টার দিকে দুটি গাড়িসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি কোম্পানি মিয়াবাজারের দিক থেকে ধীরগতিতে বালুজুড়ি ভাঙ্গা পুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশের মধ্যে পৌঁছানোমাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর প্রচণ্ড বেগে গুলি চালান। এতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। বেলা ৩টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পুনরায় পিছু হটে। এরপর লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বালুজুড়ির ভগ্নপ্রায় সেতুটি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করে নিজেদের ঘাঁটিতে চলে আসেন। পথে তাঁরা চৌদ্দগ্রাম- লাকসাম রোডের ওপর বাঙ্গরার পশ্চিমে অ্যান্টি-পার্সোনাল মাইন পুঁতে রাখেন। মাইন পোঁতার সময় দুর্ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডো প্লাটুনের দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। [মোতাহার হোসেন মাহবুব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড