You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.31 | বাহাদুরাবাদ ঘাট যুদ্ধ (দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

বাহাদুরাবাদ ঘাট যুদ্ধ (দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর)

বাহাদুরাবাদ ঘাট যুদ্ধ (দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর) সংঘটিত হয় ৩১শে জুলাই। এতে বহু পাকিস্তানি সৈন্য, আধাসামরিক বাহিনী, রেঞ্জার্স ও রাজাকার সদস্য নিহত হয়। তাদের ব্যবহৃত নৌযান ও স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়। অপরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং একজন আহত হন। পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের জন্যই কৌশলগত দিক থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যমুনা নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত এ ঘাটটি যেমনি ছিল নৌ-বন্দর, তেমনি উত্তরের সর্বশেষ রেলওয়ে স্টেশন। এ ঘাটে ছিল ৫টি জেটি যার ২টি যাত্রীবাহী স্টিমারের জন্য, ২টি রেলওয়ে ওয়াগন অয়েল ট্যাঙ্ক এবং সামরিক-বেসামরিক যানবাহন ও আর্টিলারি গান পারাপারের জন্য। বাকি ১টি ছিল সি-ট্রাক, লঞ্চ, স্টিমার এবং সামরিক যানবাহন পারাপারের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাহাদুরাবাদ ঘাট ছিল দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম, যে কারণে এ স্থান হয়ে উঠেছিল ঢাকা থেকে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধসরঞ্জাম তথা অস্ত্র, গোলাবারুদ, খাদ্যসামগ্রী, জ্বালানি তেল এবং সৈন্য পাঠানোর অন্যতম মাধ্যম। একই সঙ্গে এ ঘাট থেকে নৌ-টহলের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরে যাতায়াত নজরদারি করা হতো। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীন এ ঘাটের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত রাজাকার বাহিনী। সামরিক দিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ স্থান আক্রমণের সিন্ধান্ত নেয়া হয় জেড ফোর্স বিগ্রেডের পক্ষ থেকে। তখন ১১ নম্বর সেক্টরের এ অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বীক্রম।
বাহাদুরাবাদ ঘাটে অবস্থানরত পাকবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের জন্য মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জহুরুল হক মুন্সি এবং হাবিবুর রহমানকে প্রাথমিকভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৬শে জুলাই সেক্টর গোয়েন্দা সেকশনের সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি রেকি দল পাকবাহিনীর সৈন্য সংখ্যাসহ কৌশলগত বিভিন্ন স্থাপনা চিহ্নিত করেন। তথ্য সংগ্রহের কাজে সময় লেগেছিল তিনদিন। এরপর চূড়ান্তভাবে বাহাদুরাবাদ ঘাটে রেকি সম্পন্ন করেন লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান, নায়েক ….. সুবেদার করম আলী, নায়েক সুবেদার আলী আকবর, নায়েক সুবেদার ভুলু মিয়া, জহুরুল হক মুন্সি এবং হাবিবুর রহমান। যুদ্ধ জয়ে অধিকতর কৌশল নিতে রেজিমেন্ট অধিনায়ক শাফায়াত জামিল চৌধুরী মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার গাজী নাসির উদ্দিনকে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেন।
তেলঢালাতে আক্রমণের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও দায়িত্ব বণ্টন করা হয় ২৮শে জুলাই। মেজর শাফায়াত জামিল কোম্পানি কমান্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট নূরন্নবী খানের ওপর বাহাদুরাবাদ ঘাটের অপারেশনের মূল দায়িত্ব দেন। অপারেশন পারিচালনায় সহায়তার জন্য ‘এ’ কোম্পানির ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাহাদুরাবাদ ঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকা কালুরচর ও সবুজপুর ঘাটের প্রতিরক্ষার পাশাপাশি ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স, কালুরচর ও বাহাদুরাবাদ ঘাট পারের মধ্যবর্তী মাদ্রাসা এলাকায় অবস্থান নেন। আক্রমণের পূর্বমুহূর্তে কাঠারবিল হাইস্কুল মাঠে সমবেত হওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া গাজী নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে দুটি দল ছিল ‘ডি’ এবং ‘এ’ কোম্পানির সঙ্গে।
৩০শে জুলাই বিকেলে তেলঢালা থেকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’, ‘ডি’ এবং হেডকোয়ার্টার্স কোম্পানি মহেন্দ্রগঞ্জ এসে পৌঁছে। সেখান থেকে তাঁরা শাহ কামাল মাজারের পাশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এরপর ডিগ্রিরচর হয়ে নদী পার হয়ে কাঠারবিল হাইস্কুল মাঠে পৌঁছেন রাত ১১টায়। সেখানেই প্রত্যেক দলকে আক্রমণের চূড়ান্ত নির্দেশ দেন মেজর শাফায়াত জামিল।
গাজী নাসির উদ্দিন এবং স্থানীয় অধিবাসীদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা ১২টি নৌকায় কাঠারবিলের মহারানী ঘাট থেকে কালুরচরে যাত্রা শুরু করে। এ ঘাটে ১ প্লাটুন সৈন্য রেখে বাকিরা এগিয়ে যান পরবর্তী অবস্থান মাদ্রাসার দিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখান থেকে যোদ্ধারা ৩১শে জুলাই রাত চারটার দিকে আক্রমণের জন্য পজিশন নেন।
পাকবাহিনীর অবস্থান বিবেচনায় আক্রমণের সূচনা করেন সুবেদার করম আলী। তিনি মালগাড়িতে রাখা জেনারেটর এবং চলন্ত সান্টিং ইঞ্জিনে রকেট নিক্ষেপ করেন। সঙ্গে-সঙ্গে পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। তারপর চলে গোলাবর্ষণ। অতর্কিত আক্রমণে অপ্রস্তুত হলেও পাকবাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তবে তা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এদিকে নায়েক সুবেদার ভুলু মিয়া তাঁর প্লাটুন নিয়ে সৈন্যদের আবাসিক কোয়ার্টার্স হিসেবে ব্যবহৃত যাত্রীবাহী ওয়াগনে রকেট লঞ্চার ও গোলাবর্ষণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ আক্রমণে বহু পাকিস্তানি সৈন্য, আধাসামরিক বাহিনী, রেঞ্জার্স এবং রাজাকার সদস্য নিহত হয়। আত্মরক্ষা করতে যারা পানিতে লাফ দিয়েছিল বা দেওয়ানগঞ্জ শহরের দিকে যাচ্ছিল, তারাও রক্ষা পায়নি আক্রমণ থেকে। রাত ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত স্থায়ী এ অপারেশনে শত্রুদের ব্যবহৃত নৌযান ও স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়। অপারেশনের শেষদিকে নায়েক সুবেদার ভুলু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন এবং মুক্তিবাহিনীর অপর একজন সদস্য শহীদ হন। [সজীব মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড