মুক্তিযুদ্ধে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা (ঠাকুরগাঁও)
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা (ঠাকুরগাঁও) বালিয়াডাঙ্গী থানা ঠাকুরগাঁও জেলা সদর থেকে ২১ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত। এ থানায় রয়েছে ৮টি ইউনিয়ন। সেগুলো হলো- পাড়িয়া, চারোল, ধনতলা, আমজানখোর, দুওসুও, ভানোর, বড় পলাশবাড়ী ও বড়বাড়ী। এ থানার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তীরনই, কুলিক, নাগড় প্রভৃতি নদী। বালিয়াডাঙ্গী একটি সীমান্তবর্তী থানা। এর উত্তর ও পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। সীমান্তের নিকটবর্তী অবস্থানের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ থানার বিশেষ গুরুত্ব ছিল।
“বালিয়াডাঙ্গীর মানুষ ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীনচেতা ও বিদ্রোহী। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এ এলাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে। ১৯৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ এ এলাকার মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর বালিয়াডাঙ্গীর ছাত্র-যুবকরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-এর প্রথম সভাপতি মো. দবিরুল ইসলাম (পিতা তমিজউদ্দীন সরকার)-এর বাড়ি বালিয়াডাঙ্গী থানার পাড়িয়া ইউনিয়নের বামুনিয়া গ্রামে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বারবার জেল-জুলুম-নির্যাতনের ফলে তিনি ১৯৬১ সালের ১৩ই জানুয়ারি মাত্র ৩৮ বছর বয়সে অকাল মৃত্যুবরণ করেন। মো. দবিরুল ইসলামের অবর্তমানে তাঁর চাচাত ভাই মো. হিসাবউদ্দীন (পিতা মো. আজিজুর রহমান) বালিয়াডাঙ্গী থানা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি হন। দবিরুল ইসলামের আপন বড়ভাই মো. সামসুল হুদা বালিয়াডাঙ্গী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ দুজন ছাড়াও মজিদুল হক মাস্টার (পিতা মো. সামসুল হুদা, পাড়িয়া ইউপি), মো. আব্দুর রশিদ মুক্তার (পিতা মো. রহিমউদ্দীন মিয়া), ডা. মো. আব্দুল খালেক (পিতা মো. খতীব উদ্দীন, পারুয়া), মো. সামশুল হক (পিতা জনাব সাখাওয়াত হোসেন, বেলসারা) এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অন্য স্থানীয় নেতারা বালিয়াডাঙ্গীতে মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। এঁদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী বালিয়াডাঙ্গী থানায় অনুপ্রবেশ করে এবং ২০শে এপ্রিল বালিয়াডাঙ্গী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৩শে মে লাহিড়ীহাটে অবস্থিত পশু হাসপাতালের পশ্চিম পার্শ্বে পারিয়া রোডে পাকবাহিনী আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করে। একইদিন তারা দলুয়াহাট, ধনতলা ইউনিয়নের খোচাবাড়ী হাট, বড়বাড়ী ইউনিয়নের আধারদিঘী, বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের খকসায়ও ক্যাম্প স্থাপন করে।
আধারদিঘী ও খকসায় পাকসেনারা কেবল দিনের বেলায় অবস্থান করত। রাতে রাজাকার ও পাকবাহিনীর অন্য দোসররা এসব ক্যাম্পে অবস্থান করত।
বালিয়াডাঙ্গী থানার কুখ্যাত রাজাকারদের অনেকে ছিল বিহারি। গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপকর্মের জন্য এ উপজেলায় সাহেবজান, টিফাইট কশাই, মনসুর, শরীফ, মোক্তাব উদ্দিন ওরফে টেমকই-এর নাম উল্লেখযোগ্য। এদের নেতৃত্বে অন্য রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীরা সমগ্র উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও সাধারণ মানুষের ওপর হত্যা, নির্যাতন ও নানাবিধ তাণ্ডব চালায়।
১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী দুওসুও ইউনিয়নের ছোট পলাশবাড়ী গ্রামের জমিদার সমর কুমার রায় (পিতা বীরেন্দ্র কুমার রায়)-এর বাড়িতে যায়। রাজাকার হায়দার বিহারি সমর কুমার রায়কে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। হানাদাররা তাঁকে গাড়িতে তুলে ছোট পলাশবাড়ী গ্রামের ১ কিমি পশ্চিমে বাঁশঝাড়ের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে। তারা সমর কুমারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পুরো বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়।
থানার ধনতলা ইউনিয়নের মণ্ডল পাড়া ও সুভান পাড়ার অনেক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।’ ফলে এই দুই পাড়ার ওপর পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ক্ষোভ ছিল বেশি। ৫ই জুন স্থানীয় রাজাকার মোক্তাব উদ্দীন ওরফে টেমকইয়ের নেতৃত্বে পাকহানাদার বাহিনী মণ্ডল পাড়ায় ও সুভান পাড়ায় আক্রমণ করে। তারা দুই পাড়ায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করে। তাদের দেয়া আগুনে ১৮৪টি বাড়ি পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। ২রা জুন পাকবাহিনী ও রাজাকাররা কুশলডাঙ্গী হাটে এক ভয়াবহ গণহত্যা চালায়, যা কুশলডাঙ্গী হাট গণহত্যা নামে পরিচিত। এখানে তারা অনেককে হত্যা করে একই কবরে তাদের মাটিচাপা দেয়।
রাজাকাররা ৮ই জুন নেকমরদ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি লুৎফর রহমান মোক্তার (পিতা হাজী ফইজুল্লাহ, যদুয়ার)-কে বাড়ি থেকে ধরে এনে ভানোর এন এইচ হাইস্কুল সংলগ্ন হাইওয়ের পূর্বপাশে গুলি করে হত্যা করে লাশ গর্তে পুঁতে রাখে। ১০ই জুন তারা আওয়ামী লীগ সমর্থক বশিরউদ্দীন (পিতা মেরু মোহাম্মদ, ভানোর নংটিহারা)-কে ধরে ঠাকুরগাঁও নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।
৫ই জুলাই স্থানীয় রাজাকাররা ভানোর বাঙ্গাটলি গ্রামের দেরেম আলী (পিতা দারাবুল্লাহ) ও ঝড়ু মোহাম্মদ (পিতা হাফিজউদ্দীন)-কে ধরে নিয়ে সাপটী হাটের পশ্চিম গোয়াবাড়ী ঝাড়ে বেয়নেট দিয়ে প্রথমে তাদের পেট কাটে। তারপর তাদের গুলি করে হত্যা করে একটি কূপে ফেলে দেয়।
৬ই জুলাই ভানোর বাঙ্গাটলী গ্রামের দারাকুল্লাহ (পিতা করমতুল্লা)-কে সাপটীর বিহারি সাহেবজান, টিফাইট কশাই, মনসুর ও শরীফ বাড়ির উঠানে জবাই করে হত্যা করে লাশ পুঁতে রাখে।
কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. দবিরুল ইসলামকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ১৭ই জুলাই বড়বাড়ী ইউনিয়নের বড়বাড়ী গ্রামে যায়। বাড়ি তল্লাশি করে তাঁকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা তাঁর পিতা মো. আকবার আলী, ভাই মো. কামরুজ্জামান এবং ভগ্নীপতি আলিম উদ্দীন (পিতা বশত আলী, ঠুমনিয়া লাহিড়ী)-কে ধরে বালিয়াডাঙ্গী থানা নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে যায় এবং তাদের ওপর তিনদিন অমানবিক নির্যাতন চালায়। পরে কামরুজ্জামান ও আলীম উদ্দীনকে ছেড়ে দিলেও আকবর আলীকে এক সপ্তাহ ধরে নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করে।
২২শে জুলাই তফিল (পিতা রমযান আলী, পাটাগড়া ধর্মগড়, রানীশংকৈল)-কে বিহারি রাজাকাররা তার শশুর বাড়ী ভানোর সরকারপাড়া থেকে ধরে গুলি করে হত্যা করে তার লাশ মাটিচাপা দেয়।
৫ই সেপ্টেম্বর বামুনিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে ব হয়ে পাকবামুনিয়া (বাদমিছিল) গ্রামে এলোপাথারি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তাদের গুলিতে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। এ ঘটনা বামুনিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত।
বালিয়াডাঙ্গী থানা ও সিও ডেভলপমেন্ট অফিস পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। বালিয়াডাঙ্গী থানায় কয়েকটি গণকবর রয়েছে। বামুনিয়া গ্রামের গণকবরে ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭ জনকে একত্রে সমাহিত করা হয়। এছাড়া থানার কুশলডাঙ্গী হাট, সাপটী হাট, বাঙ্গালী, খাদেমগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে পাকসেনা ও রাজাকারদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের গণকবর রয়েছে।
২৩শে মে মুক্তিযোদ্ধারা হরিনমারি হাটের পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। হরিনমারি হাট যুদ্ধে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১ জন পথচারী শহীদ হন। ২৫শে মে রাতে খকসাই-এ বিহারি ও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ পরদিন ভোরবেলা পর্যন্ত চলে। যুদ্ধে কোনো পক্ষেই কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে দিনের বেলা বিহারি ও পাকসেনারা মিলে খকসার হিন্দুপল্লিটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
২২শে জুন মুক্তিযোদ্ধারা কেরিয়াতিতে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব থেকে গ্রামের একটি পুকুর পাড়ের বাঁশঝাড়ে আত্মগোপন করেছিলেন। বালিয়াডাঙ্গী থেকে পাকসেনাদের একটি দল তাঁদের কাছাকাছি এলে তাঁরা গুলিবর্ষণ করেন। পাকবাহিনী পুকুরের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। এ যুদ্ধ “সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে। যুদ্ধে ১ জন পাকসেনা নিহত হয়।
৩রা সেপ্টেম্বর বামুনিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ১৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। এটি বামুনিয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। গ্রামের পূর্ব পার্শ্বে ঈদগার কাছাকাছি রাস্তার দুই ধারে মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকে অবস্থান নেন। লাহিড়ী থেকে আসার পথে পাকসেনাদের একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের ১০০ গজের মধ্যে এলে তাঁরা ব্রাশফায়ার করেন। এতে ঘটনাস্থলেই ১ জন অফিসারসহ ১৩ জন পাকসেনা নিহত হয়।
৫ই সেপ্টেম্বর বামুনিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছিলেন। পাকবাহিনী বৃষ্টির মধ্যে বামুনিয়া গ্রামে এসে পৌঁছলে সকাল ৯টায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের তীব্র যুদ্ধ বাঁধে। এ-যুদ্ধ বিকেল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা বামুনিয়া গ্রামে এলোপাথারি গুলিবর্ষণ করতে থাকলে ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭ জন শহীদ হন।
১৭ই সেপ্টেম্বর কাশুয়া খাদেমগঞ্জ রতনদিঘীর পাড়ে বিহারি পল্লীতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে বিহারি ও ধর্মগড় থেকে আসা পাকসেনাদের সঙ্গে তাদের তীব্র যুদ্ধ বাঁধে। এ-যুদ্ধে কয়েকজন বিহারি ও পাকসেনা নিহত হয়। এখানে ২ জন . মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- মো. আ. করিম (পিতা সুভান ভূইঁয়া, রংপুর) এবং মো. শরীফ (পঞ্চগড়)। এঁদের স্থানীয় কবরে দাফন করা হয়।
২৮শে সেপ্টেম্বর সীমান্তবর্তী গ্রাম মরিচপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন আহত হন। আগের রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ধনতলা দলুয়া পাক ক্যাম্পে আক্রমণ শেষে ভারতের থুকরাবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ফেরার পথে সীমান্তবর্তী মরিচপাড়া গ্রামের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ-দলে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ভোরে পাকসেনারা নিদ্রারত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘেরাও করে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধা ফজলু এলএমজি দিয়ে পাকসেনাদের ওপর গুলি ছুড়লে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন তাঁরাও পাকসেনাদের প্রতিহত করতে গুলি শুরু করলে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। ফজলু নামে এক মুক্তিযোদ্ধা বামহাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যান। আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা মতিয়র (পিতা আনিসুর, মণ্ডলপাড়া ধনতলা) ও শাখাওয়াত (কুয়াটল সোনগাঁও) সীমান্তের ওপারে যেতে সক্ষম হন। ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাঁদের দড়ি দিয়ে বেঁধে বালিয়াডাঙ্গী থানার নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। আহতদের দুজন হলেন- মো. বশির উদ্দিন (পিতা আলিমউদ্দিন, ঝাড়গাঁও আখানগর, ঠাকুরগাঁও) ও আমানুউল্লাহ (পিতা পীরবকশ, চৌধুরীপাড়া, চাড়োল)। আমানুউল্লাহকে তাঁর পিতা স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা আ. বারেক মিয়ার সাহায্যে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হলেও অপর ৩ জনকে হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করে। ঠাকুরগাঁও থেকে বালিয়াডাঙ্গীর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ১০ই নভেম্বর রাতে কাদশুকা ব্রিজটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিতে সেখানে যায়। কিন্তু পাকসেনাদের একটি দল তখন ব্রিজ পাহারায় থাকায় তাঁরা ফিরে আসেন। আসার পথে মণ্ডলপাড়া ও বাঠুপাড়ার কাছাকাছি এলে তাঁরা পাকবাহিনীর মুখোমুখি হন। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। ৮ ঘণ্টা ধরে এ-যুদ্ধ চলে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর সদস্য খলিলুর রহমান (মলানী, ঠাকুরগাঁও) শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম (পিতা আফতাব উদ্দিন সরকার, মণ্ডলপাড়া, ধনতলা) আহত হন। এ-যুদ্ধের পর মরিচপাড়া, বন্দরপাড়া, দিঘলবস্তী, মোডানপাড়া, হরিপাড়া বাঠুপাড়া, মণ্ডলপাড়া, আনছারহাট- সহ ধনতলা ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। তখন থেকে সুভানপাড়া, মণ্ডলপাড়া ও বাঠুপাড়ায় ৬০/৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা সারাক্ষণ অবস্থান করে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন। ৩০শে নভেম্বর বালিয়াডাঙ্গী থানা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়।
বালিয়াডাঙ্গীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবদুল করিম (পিতা সোবহান ভূঁইয়া, বড় পলাশবাড়ী), মো. শরিফ উদ্দিন (পিতা দুন্দি মোহাম্মদ, নাগেশ্বরবাড়ী, ধনতলা), বশির উদ্দীন (পিতা আলিমুদ্দীন, ঝাড়গাঁও), খলিলুর রহমান (ইপিআর সদস্য, মলানী), দীনেশ (ধলই হাট, রুহিয়া), 5 যতীন্দ্রনাথ সিংহ (পিতা সাবুলাম সিংহ, বানাগাঁও, ধনতলা), আমান উল্লাহ (পিতা শশী মোহাম্মদ, হবিপাড়, ধনতলা),। আমানুল্লাহ (চারোল), আমীর আলী (পিতা গফুর উদ্দিন, বেলহারা) এবং আব্দুর রহমান (পিতা তসলিম উদ্দিন, পশ্চিম হরিনমারি, আমজানখোর)।
মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে বালিয়াডাঙ্গী চৌরাস্তায় একট স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া দুজন শহীদের নামে দুটি সড়ক ও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— শহীদ সমর কুমার রায় সড়ক, শহীদ আকবর আলী সড়ক ও শহীদ আকবর আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়। [মো. আব্দুল ওয়াহাব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড