বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১২ই আগস্ট, সোমবার, ২৬শে শ্রাবণ, ১৩৮১
শিক্ষার হার যেন কমে না যায়
এবার উচ্চশিক্ষালাভের ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীরা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। পত্রিকান্তরে বিশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। এডমিশন কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির শর্ত হলো এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় ন্যূনতম শতকরা ৫০ নম্বর পেয়ে পাশ করলে তবেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবে। যতটা স্মরণ করা যায় গত বছরও এমনই একটা শর্ত ছিল। তবে পরে সেই শর্ত শিথিল করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য ইচ্ছুক প্রার্থীদের যোগ্যতা দ্বিতীয় বিভাগ হলেই চলবে ঘোষণা করা হয়। এবার এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ঘোষণা করা হয়নি। এবং প্রতিবেদন সূত্রে বলা হয়েছে যে, এ যাবৎ প্রাপ্ত ভর্তির আবেদনপত্র গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক কম।
একথা সত্য যে, গত কয়েক বছর ক্রমবর্ধমান ছাত্র ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনা প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ক্লাসঘরে শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা দেয়া যেত না। অথচ ভর্তির জন্য চাপ ছিল বেশি। ওই বছরগুলোতে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হারও ছিল বেশি। ওদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতার সাথে উত্তীর্ণও হতো। এবং ভর্তির দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ছাত্র-ছাত্রীর এবং একটা উদ্দাম প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত।
এবছর বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে প্রাণ তরঙ্গের সে জোয়ার যেন আর নেই। এর প্রধান কারণ এইচএসসি পরীক্ষার পাশের হার। চারটি বোর্ডেই পাশের শতকরা হার এবার হঠাৎ করে খুব বেশি নিচে নেমে গেছে। ঢাকায় ৪১.৪, রাজশাহী ৪২.৩, কুমিল্লায় ৪১.০১ ও যশোর ৫০.০৬ ভাগ ছাত্র পাস করেছে। প্রথম বিভাগের সংখ্যা খুবই কম। এবং দ্বিতীয় বিভাগে পাস করা ছাত্র ছাত্রী ও শতকরা ৫০ ভাগ নম্বর খুব বেশি জনে পায়নি। অতএব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য আবেদন পত্র অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম পড়ছে। এডমিশন কমিটির সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর জন্য যে আসন সংখ্যার কথা ঘোষণা করেছেন সম্ভবতঃ তাও পূরণ হবে না।
একথা সত্য যে, আমাদের দেশের বহু গরিব মেধাবী ছাত্র অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যায় যথেষ্ট মেধা থাকা সত্তেও প্রাকৃতিক ও জাগতিক নানা বিপর্যয়ের মোকাবিলা করে তাদেরকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষায় শতকরা ৫০ নম্বর না পেলেও অনেকের চেয়ে তারা অনেক বেশি জানতে পারে বৈকি! গত বছরগুলোতে এমনও দেখা গেছে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করা শিক্ষার্থীদের চেয়ে সাধারণভাবে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করা ছাত্র ছাত্রীই বেশি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। এবারেও হয়তো অনেক গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী শতকরা ৫০ নম্বরের ছাকনিতে অনেক যোগ্যতা নিয়েই বাদ পড়ে যাবে। তাদের উচ্চশিক্ষালাভের ঐকান্তিক বাসনার সমাপ্তি ঘটবে। কাজেই চেষ্টা করে আর ছাত্র ভর্তি রোধ করতে হবে না–বহুৎ কারণসহ অর্থনৈতিক কারণেই তা হ্রাস পাবে।
এবছরের সার্বিক বন্যায় হাজার হাজার স্কুল-কলেজ বিধ্বস্ত হয়েছে । স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির না পূরণ হতেই এই আঘাত যে কত তা বলাই বাহুল্য। তার উপর লেখাপড়ার খরচ বেড়ে গেছে বহুগুণ। অর্থনীতি কারণে ছাত্র জায়গীর রাখা প্রায় উঠেই গেছে। সীমিত আয়ের লোকেরা অর্থনৈতিক কারণে হল বা হোস্টেলে রেখে আর ছেলে বা মেয়ে পড়াতে পারছেন না। সার্বিকভাবে সাধারণ লোকের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে ফলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য বিদ্যা ক্রয়ের সামর্থ্য তাদের প্রায় শেষ। দেশের শিক্ষার হার বাড়ানোর পরিকল্পনার মুখে এই সমস্ত সমস্যা আমাদের সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে।
অতএব শিক্ষিত সমাজ সহ ছাত্রসমাজ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষিত সমাজকে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে স্কুল-কলেজকে চালু রাখা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশাগ্রস্ত বিদ্যায়তন গুলোর সংস্কার সাধনের জন্য মানবিক চেতনাকে সক্রিয় রাখতে হবে। ইউনেস্কোর তরফ থেকেও আমরা সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করি। অর্থাৎ আমাদের লক্ষ্য তথা শিক্ষার হার বাড়ানোর প্রয়াস সফল করে তোলার জন্য সকল অন্তরায় মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং শিক্ষার হার যেন কোন ক্রমেই কমে না যায় সেদিকে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আমাদেরই।
ত্রাণ কার্য ও সাহায্যের পরিমাণ
তিন সপ্তাহ আগে যে প্রলয়ংকারী ভয়াবহ বন্যা বাংলাদেশের উপর সর্বগ্রাসী ঔদ্ধত্য থাবা বিস্তার করেছিল, এখনও সেই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধীরে ধীরে জলমগ্ন হয়ে যাচ্ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গুটি কয়েক জায়গায় অবস্থার উন্নতির খবর আমরা গতকাল পেয়েছি, কিন্তু সেই সাথে চোখের সামনে দেখছি এবং শুনতে পাচ্ছি আরো নতুন নতুন এলাকা বন্যাকবলিত হচ্ছে। সুতরাং দুর্ভোগের মাত্রা আমাদের জন্য আরো কি পরিমান অপেক্ষা করছে এই মুহুর্তে আমরা কেউ তা ভাবতে পারছিনা। দুর্গত এলাকার লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ আজ অর্ধাহারে এবং অনাহারে দিনাতিপাত করছে। সরকার তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী গত ১০ই আগস্ট নওগাঁয় ঐ একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, দুর্গত এলাকার জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য সরকার তার সীমিত সম্পদ নিয়ে সম্ভাব্য সব কিছু করবেন। কিন্তু কথা হলো সুবিধা সাধের ত্রাণ তৎপরতা যে দুর্গত এলাকার জনগণের জন্য পর্যাপ্ত সে কথা সরকারও হয়তো বলবেন না এবং সেজন্য আমাদের সাহায্য প্রয়োজন। সে সাহায্য দেশের বিত্তশালী ও বহির্বিশ্ব যেখান থেকে আসুক না কেন আমাদের প্রধান কথা হলো ব্যাপক আকারে সাহায্যের প্রয়োজন এবং সে সাহায্য দেশের বন্যা কবলিত লক্ষ লক্ষ অর্ধাহারে-অনাহারে ক্লিষ্ট মানুষের জন্য। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপক আকারে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু একটা জিনিস আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি -সাহায্যের আবেদনের প্রতি সারা তেমন পড়েনি। কেন পড়ে নি সেটা অবান্তর কথা। আসল কথা আমাদের দুর্গত এলাকার লোকদের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য প্রয়োজন। গত ১০ই আগস্ট বিকেল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে মোট সাহায্য দানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২ লাখ ২৮ হাজার ৬৯৬ টাকা, অথচ বাংলাদেশের বন্যা দুর্গত এলাকার লোকসংখ্যার পরিমাণ প্রায় তিন কোটি। হিসাব বলে ত্রাণ তহবিলে দান এর টাকা মাথাপিছু চার আনার একটু বোধ হয় বেশি পড়বে। বহির্বিশ্ব থেকে সাহায্য তেমন পাওয়া যায়নি এবং যা পাওয়া গেছে তা নিয়েই এ ৮২ লক্ষ হয়েছে।
বন্যার পানির হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথেই প্রতিটি এলাকার সর্বস্বহারা কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বীজধান, বলদ ও লাঙ্গল সরবরাহের ব্যবস্থা এবং সেইসাথে সংক্রামক ব্যাধি রোধের জন্য ব্যাপক আকারে কার্যকরী ব্যবস্থা দরকার। সুতরাং সবকিছুর জন্য অর্থের প্রয়োজন! বহির্বিশ্ব আমাদেরকে সাহায্য দান করবে এবং সেই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা অপেক্ষা করবো সেটা বাতুলতা মাত্র। মানবিক দিক বিবেচনা করে যদি কেউ সাহায্যের হাত প্রসারিত করে আমরা তাকে স্বাগতঃ জানাবো। গত পরশু মার্কিন সিনেটের শরণার্থী সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের বন্যার ‘ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করেছেন এবং অবিলম্বে ত্রাণ সামগ্রী প্রদান করার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা জানি না বাংলাদেশের বন্যা দুর্গতদের কথা মার্কিন সরকার কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছেন। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর যেকোনো দেশের তরফ থেকে বাংলার লক্ষ লক্ষ দুর্গত মানুষের জন্য সাহায্য সম্প্রসারিত হস্তকে আমরা আন্তরিকভাবে স্বাগতঃ জানাবো।
কিন্তু কথা হল, আমরা দেশবাসী, যারা বন্যাকবলিত হইনি, তারা কি করছি? বাংলার ভবিষ্যৎ দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা আমাদের সামান্যতম শক্তিটুকুও কাজে লাগিয়ে এবং প্রত্যেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক সাহায্য দিয়ে বাংলাকে দুর্যোগ মুক্ত করতে পারি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক