You dont have javascript enabled! Please enable it! বাতেন বাহিনী (নাগরপুর, টাঙ্গাইল) - সংগ্রামের নোটবুক

বাতেন বাহিনী (নাগরপুর, টাঙ্গাইল)

বাতেন বাহিনী (নাগরপুর, টাঙ্গাইল) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ছিলেন খন্দকার আব্দুল বাতেন (১৯৪৬-২০১৯)। তাঁর নামানুসারেই এ বাহিনীর নাম হয় বাতেন বাহিনী। খন্দকার আব্দুল বাতেন ১৯৪৬ সালের ১৭ই মে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার কনোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খন্দকার সিরাজুল ইসলাম এবং মাতার নাম হাজেরা খাতুন। করটিয়া সা’দত কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে তিনি ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। খন্দকার আব্দুল বাতেন ১৯৭১ সালে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগ এর একাংশের সভাপতি, ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের এক নম্বর সহ-সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির ৩নং সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ টাঙ্গাইল শহরের আদালত পাড়ার এডভোকেট নুরুল ইসলামের বাসায় সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হলে, খন্দকার আব্দুল বাতেন এ পরিষদে একজন গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। একই সময়ে তিনি টাঙ্গাইল জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন। মার্চ মাসের শুরু থেকেই তিনি সা’দত কলেজসহ জেলার বিভিন্ন থানার কলেজে ‘জয় বাংলা বাহিনী’, ‘জয় বাংলা ক্যাপ’ ও “স্বাধীনতার ইস্তেহার’ প্রচার করতে শুরু করেন। ২৬শে মার্চ সকালে ইপিআর বাহিনীর ওয়ারলেস কর্তৃক ট্রান্সমিট করা বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি এস এম রহমান নামে খন্দকার আব্দুল বাতেনের হস্তগত হয়। এরপর তিনি পূর্ণ উদ্যমে মুক্তিবাহিনী গঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন।
৩০শে মার্চ সখিপুর উপজেলার আছিমতলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে সাদত কলেজের ছাত্র জুমারত নিহত এবং ৩রা এপ্রিল টাঙ্গাইল শহর পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে তিনি নিজ থানা নাগরপুরের কনোড়া গ্রামে চলে আসেন এবং এ গ্রামকে কেন্দ্র করেই গড়ে তোলেন তাঁর বাহিনী।
করটিয়া সা’দত কলেজের বাংলা বিভাগের বিএ ১ম বর্ষের ছাত্র ও মির্জাপুর থানার পাকুল্লা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া (পরবর্তীতে অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), মুরাদ আলী সরকার (সাধারণ সম্পাদক, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ), ইসমাইল হোসেন প্রমুখসহ প্রায় ৬০ জনের একটি দল বাতেন বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। এছাড়া বাতেন বাহিনীকে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন আলী আকবর খান ডলার (পরবর্তীতে বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ)। তিনি বহুসংখ্যক যুবককে নিয়ে এ বাহিনীতে যোগ দেন। খন্দকার আব্দুল বাতেন মুক্তিবাহিনী গঠন করছেন শুনে ছাত্র-যুবক, কৃষক, ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, পুলিশ, আনসার প্রভৃতি শ্রেণি-পেশার মানুষ এ বাহিনীতে যোগ দেন। ফলে এ বাহিনী শুরু থেকেই একটি শক্তিশালী বাহিনীতে রূপ নেয়।
বাতেন বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। এ বাহিনী ২১টি কোম্পানি, ৬৩টি প্লাটুন এবং ১০০টি সেকশনের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। এ বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারগণ ছিলেন— মেজর আবু তাহের, নায়েক হুমায়ুন কবীর খান, নায়েক আবদুস সামাদ, নায়েক ওয়াজেদ আলী খান, নায়েক আবুল খায়ের, সুবেদার আলমগীর, মো. দেলোয়ারর হোসেন হারিচ, মো. হুমায়ুন কবীর খান, মো. ইন্তাজ আলী, মো. আবদুস সামাদ, মো. ওয়াজেদ আলী খান, মো. আবদুর রশীদ, মো. বেলাল হোসেন, মো. নূরুল ইসলাম, আমিনুর রহমান খান, মো. আফজাল হোসেন, মো. আল্লাদ হোসেন, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. আবু কায়সার ও মো. কফিল উদ্দিন। সুবেদার মেজর আব্দুল বারীকে এ বাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লী গ্রাম, টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি, নাগরপুর উপজেলার শাহজানির চর ছিল বাতেন বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন সুবেদার মেজর আবু তাহের, সুবেদার আবদুল বারী, নায়েক ওয়াজেদ আলী খান, নায়েক আবুল খায়ের ও সুবেদার আলমগীর। কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন খন্দকার আবদুল করিম।
খন্দকার আব্দুল বাতেনের গেরিলা বাহিনী গঠনের প্রাক্কালে অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ ছিল খুবই কম। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতোয়ার রহমান খান প্রথম ম্যাগাজিনবিহীন ৪টি রাইফেল দিয়ে এ বাহিনীকে সহায়তা দেন। এ রাইফেল দিয়ে যুবকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এরপর একই জেলার দেলদুয়ার থানার গজিয়াবাড়ি গ্রামের ফজলুল হক মল্লিক, সুবেদার আবদুল বারী, নায়েক আজহারুল ইসলাম, নায়েক মজিবর রহমান তালুকদার, কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন, ইসমাইল হোসেন ঠাণ্ডু প্রমুখের দেয়া বিপুল পরিমাণ চাইনিজ এলএমজি, গ্রেনেড ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাতেন বাহিনীতে যোগ দিলে এ বাহিনীর ভিত আরো সুদৃঢ় হয়। তাছাড়া ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা সেনাসদস্যের কাছে থাকা চাইনিজ রাইফেল ও গোলাবারুদ নিয়ে ধীরে-ধীরে এ বাহিনীর অস্ত্রাগার গড়ে ওঠে। বিভিন্ন থানা আক্রমণ করে প্রাপ্ত অস্ত্র ও সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রই ছিল এ বাহিনীর অস্ত্রের মূল উৎস। ‘শত্রুর অস্ত্রই আমার অস্ত্র’ এটি ছিল তাঁদের অস্ত্র সংগ্রহের মূল নীতি।
সামরিক বাহিনীর কায়দায় গড়ে তোলা এ বাহিনীতে একটি সামরিক শাখা ছিল, যার প্রধান বা অধিনায়ক ছিলেন খন্দকার আব্দুল বাতেন স্বয়ং। এ বাহিনীতে বেসামরিক বিভাগ নামে একটি প্রশাসন ছিল। আলী আকবর খান ডলার ছিলেন বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান ও সচিব ছিলেন মহিদুর রহমান খান আলমগীর। এ প্রশাসনকে আবার কয়েকটি ভাগে বিভাজন করা হয়েছিল। নিরাপত্তা বিভাগ: দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন- উপেন্দ্রনাথ সরকার বিএসসি, খন্দকার আব্দুল সালাম, মীর শামসুল আলম শাহজাদা, আমিনুল ইসলাম খান, মো. শহিদুল ইসলাম, আবদুল আলীম খান সেলিম, শহিদুল হক মল্লিক, মো. সুলতান উদ্দিন আহমেদ, খালেদ খান যুবরাজ, মো. ইউনুস খান প্রমুখ; খাদ্য বিভাগ: দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন— অরুণ কুমার বোস বরুণ ও আব্দুর রাজ্জাক; অর্থ বিভাগ: খন্দকার আব্দুস সালাম ও আব্দুর রউফ; বিচার ও গণসংযোগ বিভাগ: খন্দকার আব্দুস সালাম, মীর শামসুল আলম শাহজাদা ও সুলতান উদ্দিন আহমেদ; রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বিভাগ: আলী আকবর খান ডলার, খন্দকার আব্দুস সালাম, মীর সামশুল আলম খান শাহজাদা, অধ্যাপক আলী হাসান ও মহিদুর রহমান খান আলমগীর। অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন খান ছিলেন রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বিভাগের উপদেষ্টা। এর বাইরে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত বা অসুস্থ যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বাতেন বাহিনীর একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ছিল। সেখানে চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের চিকিৎসক ডা. জহিরুল ইসলাম, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ডা. বসন্ত কুমার সাহা ও উল্লাপাড়ার ডা. নিখিল চন্দ্র সাহা। সেবিকা হিসেবে ছিলেন আঙ্গুরী রানী সরকার। উল্লেখ্য, অধিনায়ক বাতেনের অনুপস্থিতিতে বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় আবুল কালাম আজাদ (শাহজাহান), মো. দেলোয়ার হোসেন হারিচ ও আব্দুর রশীদের ওপর।
গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল ‘হিট এন্ড রান’ ছিল বাতেন বাহিনীর যুদ্ধের প্রধান কৌশল। প্রায় ৫০টি যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করে এ বাহিনী। তন্মধ্যে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ (৪ঠা মে), দৌলতপুর থানা আক্রমণ (১৭ই মে), ঘিওর থানা দখল (মে মাসের শেষের দিকে), সাটুরিয়া থানা আক্রমণ (দুবার— ১৪ই আগস্ট ও নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি; দ্বিতীয় বারের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা জিয়ারত হোসেন শহীদ হন), সিরাজগঞ্জের চৌহালি থানা অভিযান (মে মাসের শেষের দিকে), ধল্লা ব্রিজ আক্রমণ, জাব্রা ব্রিজ আক্রমণ (মে মাসের শেষের দিকে), ঘাস কাউনিয়ায় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অভিযান (২৮শে জুন), নাগরপুর থানা দখল যুদ্ধ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ৪ঠা মে সিঙ্গাইর থানা আক্রমণের মধ্য দিয়ে এ বাহিনী পাহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান শুরু করে। বাতেন বাহিনীর কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল দক্ষিণ টাঙ্গাইলসহ ঢাকা জেলার কিছু অংশ, গাজীপুরের কিছু অংশ, মানিকগঞ্জের উত্তর অংশ এবং পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের বিরাট অংশ জুড়ে।
বাতেন বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার-এর প্রতি অনুগত থেকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে, .বাংলাদেশ সরকার বা ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে এ বাহিনী কোনো প্রকার সহায়তা পায়নি। খন্দকার আব্দুল বাতেন মুজিবনগর সরকার-এর নির্দেশনা মোতাবেক দুবার ভারত গমন করেন। এ-সময় বাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ শাহজাহান, মো. দেলোয়ার হোসেন হারিচ ও আবদুর রশীদ।
বাতেন বাহিনী নিজস্ব এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধের খবর ও পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান বা সাফল্যসহ রণাঙ্গনের সংবাদ সম্বলিত অগ্নিশিখা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করত। এটি অধিকৃত অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রায়শই বাতেন বাহিনীর সাফল্য প্রচার করা হতো। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে বাতেন বাহিনীর ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ১৯ জন আহত হন। ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারি খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে এ বাহিনী ঢাকা স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নিকট অস্ত্র সমর্পণ করে।
স্বাধীনতার পর খন্দকার আব্দুল বাতেন জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যোগ দেন এবং টাঙ্গাইলে গণবাহিনীর অধিনায়ক হন। ১৯৮৬ সালে তিনি নাগরপুর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, কিন্তু সফলকাম হতে পারেননি। ২০০৮ সালে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৯ম এবং ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কারণে খন্দকার আব্দুল বাতেন ৯ বার কারাবরণ করেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে ৩৯টি মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৯ সালের ২১শে জানুয়ারি ৭৩ বছর বয়সে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী মমতাজ খন্দকার, ১ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তান রেখে যান। [মনিরুজ্জামান শাহীন ও মিথুন সাহা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড