বাগেরহাট শহর যুদ্ধ (বাগেরহাট সদর)
বাগেরহাট শহর যুদ্ধ (বাগেরহাট সদর) সংঘটিত হয় ১০ই জুলাই। এতে ২ জন রাজাকার নিহত এবং রাজাকার প্রধান রজ্জব আলী ফকির মারাত্মকভাবে আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণপদ ঘোষ গুলিবিদ্ধ হন। বাগেরহাট শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সব যুদ্ধ হয় পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বনকারী পুলিশ বাহিনী ও রাজাকারের বিরুদ্ধে। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার খবর পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে বাগেরহাটের নাগেরবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। প্রথমদিকে এখানে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার একটি দল তৈরি হয়। এ ক্যাম্প ধ্বংস করার জন্য ২৪শে এপ্রিল খুলনা থেকে এসে পাকবাহিনীর একটি দল বাগেরহাট আক্রমণ করে। খুলনা থেকে কয়েকটি গানবোট নিয়ে তারা পুঁটিমারী খালের পূর্ব তীরে মির্জাপুর গ্রামে আসে। সেখান থেকে হেঁটে এবং মানুষ হত্যা করতে- করতে বাগেরহাটের দিকে অগ্রসর হয়। নাগেরবাড়ি ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী আসার খবর পূর্বেই পেয়েছিলেন। তাই হানাদার বাহিনী যাতে নাগেরবাড়ি ক্যাম্প আক্রমণ করতে না পারে, সেজন্য কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে একটি দল কাড়াপাড়া রাস্তার পাশে এবং রজ্জব আলী শিকদারের নেতৃত্বে অন্য একটি দল বাসাবাটি ব্রিজের কাছে এম্বুশ নেয়। কিন্তু পাকবাহিনীর শক্তি বুঝতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা কোনো আক্রমণে যাননি। অন্যদিকে পাকবাহিনী সেদিন নাগেরবাড়ি ক্যাম্পে না গিয়ে বাগেরহাট শহরের নাগেরবাজারে গিয়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সন্ধ্যার আগে ফিরে যায়।
বাগেরহাট শহরে ৩০শে এপ্রিল পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বাগেরহাট থানা আক্রমণ- নামে পরিচিত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এরপর বাগেরহাট শহরে ১০ই জুলাই রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা একটি অপারেশন পরিচালনা করেন।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে বাগেরহাটে বেশ বড় একটি রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয় এ ক্যাম্প স্থাপনের পর রাজাকারদের আহ্বানে পাকবাহিনীর একটি দল বাগেরহাট শহরের মদনের মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প থেকে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাকবাহিনী বাগেরহাটের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামে গণহত্যা ও নির্যাতন চালায়। এছাড়া রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে বাগেরহাটের রাজাকাররা নিয়মিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের বিশেষ করে হিন্দুদের নানাভাবে নির্যাতন করত। রাজাকারদের এ অপতৎপরতা বন্ধ করার জন্য ১০ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলীকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপরারেশন চালায়। এ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ যুবায়ের নোমা, কৃষ্ণপদ ঘোষ কেষ্ট, ইসমাইল হোসেন মেঝে এবং সিরাজুল ইসলাম। এ আক্রমণে রজ্জব আলী ফকিরের ২ সহযোগী নিহত এবং রজ্জব আলী ফকির মারাত্মকভাবে আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণপদ ঘোষ গুলিবিদ্ধ হন।
বাগেরহাট জেলার অধিকাংশ যুদ্ধ হয় বিভিন্ন থানা সদরে, বন্দরে এবং সুন্দরবনে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বাগেরহাট জেলার সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন যুদ্ধে রাজাকাররা পরাজিত হয়ে ক্রমে বাগেরহাট রাজাকার ক্যাম্পে এসে জড়ো হয়। এভাবে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে জেলার প্রায় সব রাজাকার বাগেরহাটে রজ্জব আলী ফকিরের ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। অনুসারীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে রজ্জব আলী ফকির আত্মহত্যা করে। ১৭ই ডিসেম্বর দুপুর ২টা ৩৭ মিনিটে মদনের মাঠের ওয়াপদা রেস্ট হাউজের সামনে সকল রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। [স্বরোচিষ সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড