বাকেরগঞ্জ থানা দখল যুদ্ধ (বাকেরগঞ্জ, বরিশাল)
বাকেরগঞ্জ থানা দখল যুদ্ধ (বাকেরগঞ্জ, বরিশাল) ৫ থেকে ৭ই ডিসেম্বর সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং বাকেরগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। অপরদিকে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
নদীবেষ্টিত বাকেরগঞ্জ উপজেলায় হানাদার বাহিনী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পে দারোগা আবদুল মালেকের নেতৃত্বে তাদের দোসর রাজাকার এবং পুলিশ বাহিনী অবস্থান করত। বাকেরগঞ্জ থানা ক্যাম্প ছিল হানাদারদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। দারোগা আবদুল মালেকের নেতৃেত্বে পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের এখানে ধরে এনে নির্যাতন করত। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে বিভিন্ন স্থানের ক্যাম্প গুটিয়ে পালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা এ- সময় বাকেরগঞ্জ থানা হানাদারমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪ঠা ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর স্থানীয় নাসির বাহিনী, জাফর বাহিনী ও সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর পার্শ্ববর্তী পাদ্রীশিবপুরে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নির্দেশ অনুযায়ী বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গৌরনদীর নিজাম উদ্দীন বাহিনী, বাবুগঞ্জের ওহাব খান বাহিনী, রতন শরীফ বাহিনী, মুলাদীর কুদ্দুস মোল্লা বাহিনী এবং উজিরপুরের ওয়াদুদ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাদ্রীশিবপুর স্কুল মাঠে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধারা আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে থানায় অবস্থানরত পুলিশ-রাজাকাররা তা প্রত্যাখ্যান করে। ৫ই ডিসেম্বর ভোর ৫টায় ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নির্দেশনা অনুযায়ী বাকেরগঞ্জকে হানাদারমুক্ত করার দুর্জয় সংকল্প নিয়ে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাঁচশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা থানা আক্রমণ করেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কুখ্যাত মালেক দারোগা (টেডা মালেক)-এর নেতৃত্বে পুলিশ-রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ করে। ৩ দিনব্যাপী সংঘর্ষ চলে। ভারী অস্ত্র দিয়ে দারোগা মালেক ও তার বাহিনী থানার ছাদের ওপর বাংকার তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ৭ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা থানার কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে ওসির বাসার ভেতরের বাংকার লক্ষ করে আক্রমণ করেন। প্রথমবারের আঘাতে বাংকারের কোনো ক্ষতি না হওয়ায় দ্বিতীয় আক্রমণে বাংকারের অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে দারোগা মালেক ও তার সঙ্গীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা থানার মধ্যে প্রবেশ করেন এবং পুলিশ- রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর পতন এবং বাকেরগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এদিন সকাল ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। অপরদিকে এ যুদ্ধে বরিশাল শহরের মীর মোস্তাক হোসেন সেন্টু, গৌরনদীর শাহজাহানসহ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বাকেরগঞ্জের শতশত নিরীহ মানুষজনকে হত্যা করার অপরাধে দারোগা মালেক এবং রাজাকার কমান্ডার শাহুকে জল্লাদ গৌরাঙ্গ কালিগঞ্জ ব্রিজের ওপর জবাই করে শ্রীমন্ত নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এ-যুদ্ধে রফিকুল আহসান (দুর্গাপাশা) যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দেন এবং পরবর্তীতে তিনি ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড