You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.14 | বড়িবাড়ি নীলকুঠি যুদ্ধ (মনোহরদী, নরসিংদী) - সংগ্রামের নোটবুক

বড়িবাড়ি নীলকুঠি যুদ্ধ (মনোহরদী, নরসিংদী)

বড়িবাড়ি নীলকুঠি যুদ্ধ (মনোহরদী, নরসিংদী) সংঘটিত হয় ১৪ই জুলাই। এতে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্তে বেলাব বাজার তথা বেলাব উপজেলা সদরের অল্প পশ্চিমে বড়িবাড়ি নীলকুঠি অবস্থিত। এখানকার যুদ্ধের পরিকল্পনা করা হয় ১২ই জুলাই রাতে এক গোপন বৈঠকে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সুবেদার বাসার, ইপিআর সুনীল, হাফিজুর, নূরুল হক, মো. আব্দুল আওয়াল বিএসসি সহ আরো কয়েকজন। সিদ্ধান্ত হয়, বড়িবাড়ির নীলকুঠি নামক স্থানে অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীর লঞ্চবহর আক্রমণ করা হবে। বার্তাবাহক জয়নাল আবেদীন এবং আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগমনের খবর পাওয়া যায়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিন মাইল দূরে ডুমরাকান্দা বাজারে পাক-দখলদার বাহিনীর তিনটি লঞ্চ টোক থেকে এসে নোঙ্গর করে। মুক্তিবাহিনী দ্রুত নীলকুঠিতে অবস্থান নেয়। ১৩ই জুলাই রাতে এলাকাবাসীকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে অবস্থান করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। পুলিশ, আনসার ও বাঙালি সেনাসদস্যের প্রায় ২৫ জনের প্লাটুনকে তিনটি সেকশনে বিভক্ত করে আড়িয়াল খাঁ নদী বরাবর প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করা হয়। উক্ত দলের সঙ্গে ভারত ফেরত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এফএফ দলও যুদ্ধে অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১টি এমজি, ২টি ব্রিটিশ এলএমএফ, ৩টি চায়না রাইফেল, ১টি রকেট লাঞ্চার, ১টি ২ক্ষ্ম মর্টার, বাকি ৩০৩ রাইফেল ও ভারতীয় এসএলআর, এমজিটি প্রভৃতি। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার জন্য সীমিত পরিমাণ গোলাবারুদ বরাদ্দ ছিল। পক্ষান্তরে হানাদার বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল দু-শতাধিক এবং তাদের ছিল ভারী অস্ত্র।
নদী তখন বর্ষার পানিতে কানায়-কানায় পূর্ণ। ১৪ই জুলাই সকালে ডুমরাকান্দা থেকে পাকবাহিনীর আধুনিক ভারী অস্ত্র সজ্জিত লঞ্চগুলো পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ বরাবর অগ্রসর হয়ে আড়িয়াল খাঁ নদীতে পড়ে বেলাব বাজারের দিকে এগুতে থাকে। সকাল ৯টার দিকে ধীরে-ধীরে লঞ্চগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের সামনে চলে আসে। কয়েকটি ছৈওয়ালা নৌকা সামনে ও পেছনে রেখে লঞ্চগুলো আসছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্দেশ ছিল, নদী বরাবর অগ্রসরমাণ লঞ্চ বহরের সামনেরটি যখন রকেট লাঞ্চারের অবস্থানের সামনে চলে আসবে, তখনই লঞ্চে রকেট ছুড়ে আক্রমণের সূচনা করতে এবং সম্মিলিতভাবে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে দক্ষিণ দিকের পজিশনের দিকে অগ্রসরমাণ লঞ্চের সামনে একটি ছৈওয়ালা নৌকাকে দ্রুত ঘাটের দিকে আসতে দেখে স্বীয় পজিশন থেকে আনসার কমান্ডার মোমতাজ নৌকার গতিবিধি সন্দেহ করে মাঝিকে ঘাটের দিকে আসতে নিষেধ করেন। সঙ্গে-সঙ্গে ঐ নৌকা থেকে আকস্মিক গুলিবর্ষণে মোমতাজ গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ শাহাদাহৎ বরণ করেন। মোমতাজের আকস্মিক মৃত্যু ও রকেট লাঞ্চার ফায়ার করছে না দেখে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাগণ লঞ্চগুলোকে লক্ষ করে ফায়ার করতে থাকেন। লঞ্চগুলোর দরজা-জানালা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রকেট চালক সিরাজ বারবার চেষ্টা করেও রকেট লাঞ্চার ফায়ার করতে পারছিলেন না। ফলে গোটা প্লাটুনের ওপর নেমে আসে বিপর্যয়। নৌকাটির ছৈয়ের ভেতর আত্মগোপনকারী পাকসেনারা নদীর ঘাটে ভিড়ে মুক্তিযাদ্ধাদের অবস্থানের বামদিক দিয়ে দ্রুত স্থলভাগে উঠে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে ও ভারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে তাঁদের অবস্থান লক্ষ করে এলোপাতারি ফায়ার করতে থাকে। ঠিক একই সময়ে দক্ষিণ দিকে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ডান পাশে আরো একটি ছৈওয়ালা নৌকার ভেতর আত্মগোপনকারী পাকসেনারা দ্রুত ঘাটে এসে তীরে উঠে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে ফায়ার করতে থাকে এবং সঙ্গে-সঙ্গেই স্থানীয় কমান্ডার সুবেদার আবুল বাশার, নুরু মিয়া, সোহরাব হোসেন ও আ. বারিক শহীন হন। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা বেলাব থেকে তিন মাইল দূরে বটেশ্বর স্কুলে গিয়ে সমবেত হন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল, সুবেদার আবুল বাশার ধরা পরেছেন। যুদ্ধের দুদিন পর তাঁর মৃতদেহ ঘটনাস্থল থেকে পাঁচশত গজ দূরে হলুদ ক্ষেতে পাওয়া যায়। অন্যান্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ স্ব-স্ব আত্মীয়-স্বজনরা নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাওয়ার পর পাকবাহিনী তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামে প্রবেশ করে। প্রথম দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উত্তরে ভাংগার ঘাট থেকে ঈদগাহ হয়ে, দ্বিতীয় দলটি আনর আলী গোদারঘাট থেকে এবং তৃতীয় দলটি নামা বাজার থেকে বেলাব বাজারের ভেতর দিয়ে পশ্চিম রাস্তা বরাবর গ্রামের ভেতর প্রবেশ করে নারী, পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ, দুগ্ধপোষ্য শিশু যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সে স্থানে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তারা ৩৬০-৩৬৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে হাত, পা ও চোখ বেঁধে বড়িবাড়ি কুঠি সংলগ্ন নদীর কিনারায় দাঁড় করিয়ে হত্যা শেষে লাশ নদীর পাড় ও নীচে পানিতে ফেলে দেয়। তাদের মধ্যে ৭০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে কাছাকাছি স্থানে গণকবর দেয়া হয়। বাকি লাশ নদীস্রোতে ভেসে যায়। [এম আর মাহবুব]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড