বক্তরমারা রেলব্রিজ অপারেশন (কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ)
বক্তরমারা রেলব্রিজ অপারেশন (কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ) পরিচালিত হয় আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলায় সংঘটিত এ অপারেশনের ফলে রেলব্রিজটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এতে কুলিয়ারচর, ভৈরব ও ময়মনসিংহের মধ্যে পাকবাহিনীর রেল যাতায়াত মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এ কারণে অপারেশনটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ভৈরব-কুলিয়ারচর রেলপথে কুলিয়ারচর সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণে ব্রিজটির অবস্থান। সে-সময় পাকবাহিনী ভৈরব, কুলিয়ারচর ও ময়মনসিংহ এলাকায় সাধারণত রেলপথেই যাতায়াত করত। তারা যেখানে-সেখানে ইচ্ছেমতো ট্রেন থামিয়ে আশপাশের গ্রাম-বাজার-জনপদে আক্রমণ চালাত এবং হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও লুটতরাজ করত। এজন্য কুলিয়ারচরের মুক্তিযোদ্ধারা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ভৈরব থেকে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে বক্তরমারা ব্রিজটি ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এ কাজটি করা মোটেই সহজ ছিল না, কারণ ভৈরব- ময়মনসিংহ পথের সকল ব্রিজে পাকবাহিনীর দোসর রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। সশস্ত্র রাজাকাররা এসব ব্রিজ পাহারা দিত। পাকবাহিনী আশেপাশে হামলা করার সময় রাজাকাররা তাদের সহযোগিতা করত। বক্তরমারা ব্রিজে রাজাকারদের বেশ শক্তিশালী একটি দল ছিল। তাদের হটিয়ে বা ফাঁকি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ব্রিজ ভাঙ্গা অত্যন্ত কঠিন ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিজ্ঞা ছিল, যেভাবেই হোক ব্রিজটি ভাঙ্গতে হবে। অন্যথায়, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, সরারচর, মানিকখালি, গচিহাটা, কিশোরগঞ্জ-সহ অত্র এলাকা নিরাপদ হবে না। তাই এসব এলাকা নিরাপদ রাখার স্বর্থে মুক্তিযোদ্ধারা এ কঠিন কাজটি করতে দৃঢ়
সংকল্পবদ্ধ হন।
অপারেশনের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, বিস্ফোরক দিয়ে খামসহ ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়া হবে। এজন্য নরসিংদী থেকে দাহ্য পদার্থ এনে বিস্ফোরক বানানো হয়। অপারেশনে অংশ নেয়ার জন্য মুদ্ধিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ডুমরাকান্দা বাজারস্থ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে একত্রিত হন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সৈয়দ মো. মুছা (পালটিয়া), আবদুল গণি মিয়া (বরখারচর), রেহমত আলী প্রধান (দোয়ারিয়া), মকবুল আহমদ (ফরিদপুর) প্রমুখ নিজেদের মধ্যে পরামর্শক্রমে গ্রুপ কমান্ডার জসিম উদ্দিন (গোবরিয়া), সহকারী কমান্ডার মেসবাহ উদ্দিন (ভিটিগাঁও), আব্দুল আজিজ মুন্সি (বীর কাশিমনগর), আবু তাহের (বীর কাশিমনগর), শামসুদ্দিন আহম্মদ ওরফে কাসু মিয়া (মধুয়ারচর), নূরুল ইসলাম খান (বড় ছয়সূতি), জীবন মিয়া (সালুয়া), আবদুল আওয়াল (খিদিরপুর), মঞ্জুর আহমদ (ফরিদপুর), বজলুর রহমান (লক্ষ্মীপুর), মাহবুবুল আলম ওরফে করিম মাস্টার (ফরিদপুর), আফাজ উদ্দিন ভূঁইয়া (গফরগাঁও, ময়মনসিংহ; তিনি তাঁর দলসহ এ এলাকায় থেকে যুদ্ধ করেন), সিরাজুল ইসলাম ওরফে আবিরাজ মাস্টার (কান্দুলিয়া), শামসুদ্দিন ইলিয়াস (কান্দুলিয়া), নুরুজ্জামান আঙ্গুর (নলবাইদ) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা এ অপারেশনে অংশ নেন। তাঁরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে এক দল বিস্ফোরক নিয়ে নৌকায় করে নির্ধারিত জায়গায় যায়, অপর দল স্থলপথে অস্ত্রসহ গিয়ে ব্রিজে পাহারারত রাজাকারদের ওপর হামলা চালায়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাশ ফায়ার করার পর বিস্ফোরক বহনকারী দলটি ব্রিজের নিচে বিস্ফোরণ ঘটায়। রাতের অন্ধকারে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটলে ব্রিজটি ভেঙ্গে পড়ে। এ অপারেশন সফল হওয়ায় ভৈরব থেকে উপর্যুক্ত অঞ্চলসমূহে গিয়ে আক্রমণ চালানো পাকবাহিনীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। বক্তরমারা রেলব্রিজ অপারেশনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। [শাদমান শাহিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড