বগাদিয়া যুদ্ধ (সোনাইমুড়ি, নোয়াখালী)
বগাদিয়া যুদ্ধ (সোনাইমুড়ি, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ২৫শে এপ্রিল। এতে ৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালীর ইতিহাসে বগাদিয়া গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পাকিস্তানি সেনারা জায়গাটিকে উচ্চারণ করত ‘বোগদাদ’ নামে। বাংলাদেশের যেকটি স্থানে প্রায়শ যুদ্ধ হতো, তার মধ্যে বগাদিয়া অন্যতম। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বগাদিয়ার যুদ্ধ নিয়মিত প্রচারিত হতো।
বগাদিয়া মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর নিকট সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত ছিল। এখানে রয়েছে দুটি সেতু। একটি সড়কসেতু অপরটি রেলসেতু। সেতু দুটির নিচ দিয়ে মুক্তিবাহিনী নৌকায় করে ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করত। অপরদিকে পাকিস্তানি বাহিনী সড়ক ও রেলপথে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা হয়ে ঢাকার সৈন্যদের জন্য রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করত। এ কারণে পাকিস্তানি সেনারা বগাদিয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইত। আর মুক্তিযোদ্ধারা চাইতেন তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এ কারণে বগাদিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর মধ্যে অসংখ্যবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
২৫শে এপ্রিল সংঘটিত বগাদিয়ার যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। ফেনাকাটা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সফল হওয়ায় তাঁদের মনোবল ও সাহস বহুগুণে বেড়ে যায়। সুবেদার লুৎফর রহমান- সকল মুক্তিযোদ্ধাকে একত্রিত করেন এবং তাঁদের মধ্যে দেশপ্রেমমূলক বক্তৃতা দিয়ে যুদ্ধের জন্য মনোবল জাগিয়ে তোলেন। তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্য। অনেকে ছুটিতে এবং পালিয়ে আসা সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষিত সৈনিক। সুবেদার লুৎফর রহমান তাঁদের নিয়ে শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। ইতোমধ্যে তাঁদের কাছে ভারত থেকে কিছুকিছু অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের চালান এসে পৌঁছায়। এর ফলে তাঁর বাহিনীর সদস্যদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে লুৎফর রহমান তাঁর বাহিনীকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার কৌশল শিক্ষা দেন।
লুৎফর রহমান নায়েক সুবেদার ওয়ালী উল্ল্যাহ ও সুবেদার শামছুল হককে বগাদিয়ায় এম্বুশের জন্য পাঠান। নায়েক সুবেদার জাবেদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে শত্রুবাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে চৌমুহনী যান। বগাদিয়া এম্বুশের স্থানটিতে পৌঁছার সামান্য কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি দেখতে পান পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকখানা সাঁজোয়া যান একজন জেসিও-সহ বহু শত্রুীসন্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তারা ফায়ার রেঞ্জের মধ্যে এসে পড়ামাত্র সুবেদার লুৎফর রহমান তাঁর বাহিনীকে শত্রুর প্রতি ফায়ার করার নির্দেশ দেন। এই অতর্কিত আক্রমণে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে; গর্জে ওঠে মুক্তিবাহিনীর সকল অস্ত্রশস্ত্র। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শত্রু পক্ষের সৈন্যসহ জেসিও ধরাশায়ী হয়; ৩টি সাঁজোয়া যান ফুলতোলা রাস্তার এক পাশে উল্টে পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে সৈন্যবোঝাই শত্রুবাহিনীর আরো দুটি জিপ গাড়ি অকুস্থলে এসে পৌঁছায়। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে নতুন করে প্রচণ্ড গোলাগুলি। পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। অবশেষে শত্রুরা আহত ও নিহত সৈন্যদের নিয়ে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় টেকনিক্যাল হাইস্কুলে তাদের ক্যাম্পের দিকে পলায়ন করে। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার ওয়ালী উল্ল্যাহ সামান্য আহত হন। [মো. ফখরুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড