মুক্তিযুদ্ধে ফুলবাড়িয়া উপজেলা (ময়মনসিংহ)
ফুলবাড়িয়া উপজেলা (ময়মনসিংহ) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান একতরফাভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সারা বাংলার মতো ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়ার সর্বস্তরের মানুষও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত ফুলবাড়িয়ার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এ এন এম নজরুল ইসলাম এমএনএ, মো. মোসলেম উদ্দিন এমপিএ প্রমুখের নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণ আন্দোলন- সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর ফুলবাড়িয়াতে সংগ্রাম কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ফুলবাড়িয়ার পাঁচকুশমাইল প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, সাব রেজিস্ট্রার অফিস মাঠ, ভবানী ইউনিয়নের শিমুল বাজার ও থানা ভবনের পেছনের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সহ এলাকার যুবকরা অংশ নেয়। ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু থাকে। ২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী ময়মনসিংহ শহর দখলে নিলে ফুলবাড়িয়ায় প্রশিক্ষণরত ছাত্র- যুবকরা দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে উথুরা নামক স্থানে তাদের কার্যক্রম চালায়। ফুলবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে- এ এন এম নজরুল ইসলাম এমএনএ, মো. মোসলেম উদ্দিন এমপিএ, মকবুল হোসেন (~ন্যাপ~), রিয়াজ উদ্দিন (কৃষক নেতা), হেলাল উদ্দিন (আওয়ামী লীগ), আব্দুর রাজ্জাক (নাসিরাবাদ কলেজের জিএস) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
২৫শে জুন পাকবাহিনী ফুলবাড়িয়াতে প্রবেশ এবং ফুলবাড়িয়ার সিএন্ডবি করে ডাকবাংলোতে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে রাঙ্গামাটি বাজারে আরো একটি ক্যাম্প স্থাপন করে।
ফুলবাড়িয়ায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল ছিল পিডিপি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী। এসব দলের নেতাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। এসব বাহিনীর কুখ্যাত সদস্যদের মধ্যে মৌলভী শাহাবুদ্দিন আহমেদ (আছিম), নুরুল ইসলাম মাস্টার (এনায়েতপুর), আমজাদ হাজি (কেশরগঞ্জ, রাজাকার কমান্ডার), অধ্যাপক আব্দুস ছোবহান (বৈদ্যবাড়ি), হাজি রোস্তম আলী (ভবানীপুর), মোকসেদ আলী (ফুলবাড়িয়া পূর্বপাড়া), মোকসেদ আলী (বৈলাজান, আলবদর কমান্ডার), আব্দুস সাত্তার মাস্টার (চানপুর), ফজলুল বারী (ফুলবাড়িয়া পূর্বপাড়া), আব্দুস সামাদ মাস্টার ওরফে টিক্কা খান (চৌদার), আব্দুল আজিজ ওরফে আজিখুড়া (বালিয়ান), শাহান খাঁ (বাক্তা), মেহের মৌলভী (বাক্তা দক্ষিণপাড়া), ময়েজ উদ্দিন (বগাকৃষ্টপুর, আলশামস বাহিনীর প্রধান), রিয়াজ ফকির ওরফে কসাই রিয়াজ (ভালুকজান), মোহাম্মদ হাবেজ (বালিয়ান), ইয়াকুব চেয়ারম্যান (তেলিগ্রাম) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারআলবদররা ফুলবাড়িয়ার লক্ষ্মীপুর, রাঙ্গামাটিয়া, কৈয়ারচালা, পুটিজানা, চৌদার দাসপাড়া, নাথপাড়া, বিদ্যানন্দ ও আছিম তিতারচালা গ্রামে হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। ১৩ই জুলাই পাকবাহিনী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ লক্ষ্মীপুর ও আশপাশের গ্রামের ১৬ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, যা লক্ষ্মীপুর গণহত্যা- নামে পরিচিত। ঐদিন দেওখোলা থেকে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত প্রায় ৭০০ ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ২৬শে জুন জোরবাড়িয়া গ্রামে পাকবাহিনী অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় কৈয়ারচালা গ্রামের মালেকা খাতুনসহ বেশ কয়েকজন নারীর সম্ভ্রমহানি করে।
ফুলবাড়িয়ার তৎকালীন জিন্নাহ হল (বর্তমান বঙ্গবন্ধু হল) এবং সিএন্ডবি অফিস ডাকবাংলো পাকবাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র ছিল।
ফুলবাড়িয়া উপজেলায় একটি বধ্যভূমি ও দুটি গণকবর রয়েছে— ভালুকজান ব্রিজ বধ্যভূমি, ফুলবাড়িয়া সিএন্ডবি ডাকবাংলো গণকবর এবং লক্ষ্মীপুর গণকবর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১১ নং সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি ভালুকা-ত্রিশাল এলাকায় গড়ে ওঠা আফসার বাহিনী এবং টাঙ্গাইল অঞ্চলে গড়ে ওঠা কাদেরিয়া বাহিনী ফুলবাড়িয়াও সক্রিয় ছিল।
১৩ই জুলাই লক্ষ্মীপুর বাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়, যা লক্ষ্মীপুর বাজার যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ২২ জন পাকসেনা নিহত হয়। এমতাবস্থায় পাকবাহিনী পিছু হটে। ৬ ও ৭ই আগস্ট পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে ফুলবাড়িয়ার রাঙ্গামাটিয়া স্থানে কাদেরিয়া বাহিনীর যুদ্ধ হয়। রাঙ্গামাটিয়া যুদ্ধ-এ বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। ৮ই ডিসেম্বর ফুলবাড়িয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ফুলবাড়িয়া উপজেলায় ১১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন- হযরত আলী (পিতা সাবু মণ্ডল, রাঙ্গামাটিয়া), জমসেদ আলী (পিতা সবুর আলী, কুশমাইল), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা রুস্তম আলী, নাওগাঁও), অছিম উদ্দিন মোল্লা (পিতা চাঁন মামুদ মোল্লা, এনায়েতপুর), আব্দুল মালেক (পিতা জুবেদ আলী, এনায়েতপুর), আব্দুল কাদের (পিতা কমির উদ্দিন মণ্ডল, এনায়েতপুর), আব্দুল করিম (পিতা কমির উদ্দিন মণ্ডল, এনায়েতপুর), রুস্তম আলী (পিতা আমানী মেস্তরী, কালাদহ), গিয়াস উদ্দিন (পিতা নাছির সরকার, দুরদুরিয়া), আয়ুব আলী (পিতা কুরবান আলী, আছিম পাটুলী) ও আব্দুল কাশেম (পিতা মোহাম্মদ আলী, আছিম পাটুলী)। ফুলবাড়িয়া উপজেলা পরিষদের দক্ষিণপাশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, আখিলা নদীর ভালুকজান ব্রিজ-সংলগ্ন বধ্যভূমির স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ ও স্মৃতিফলক এবং লক্ষ্মীপুর গণকবরের পাশে স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনীর হাতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার কৈয়ারচালা গ্রামের বীরাঙ্গনা মালেকা খাতুনের কবর স্বাধীনতার পর সরকারি উদ্যোগে বাঁধাই করা হয়। [মোত্তালিব দরবারী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড