You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ফুলছড়ি উপজেলা (গাইবান্ধা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ফুলছড়ি উপজেলা (গাইবান্ধা)

ফুলছড়ি উপজেলা (গাইবান্ধা) ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামে ফুলছড়ি উপজেলার জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. লুৎফর রহমান ও ডা. মফিজুর রহমান যথাক্রমে এমএনএ ও এমপিএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন-এও তাদের জোরালো ভূমিকা ছিল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তা সারা বাংলার মানুষের মতো তাদেরও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের যে আহ্বান জানান, তাতে সাড়া দিয়ে তারা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রণের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর উপজেলার ছাত্র- যুবকরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। থানা খাদ্য পরিদর্শক আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে ফুলছড়ি হাইস্কুলে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রশিক্ষণে ব্যবহারের জন্য ম্যাগাজিন ছাড়া রাইফেল প্রদান করেন। সেনাবাহিনীর সদস্য আফছার আলী, আনসার প্রশিক্ষক আফছার আলী ও ময়েজউদ্দিন এবং পুলিশ সদস্য মানিক প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনায় আবুল হোসেন, সিরাজ মাস্টার, আব্দুল মান্নান মণ্ডল, জোবেদ আলী সরকার, ডা. রফিকুল ইসলাম, আব্দুল জলিল তোতা, শামসুল আলম প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন। ভাঙ্গামোড়ে পরিত্যক্ত একটি জিপে পাওয়া চারটি ৩০৩ রাইফেল, কিছু গুলি এবং দুই বস্তা চাল দিয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরের কার্যক্রম শুরু হয়।এ প্রশিক্ষণ শিবিরে কয়েকশ ছাত্র-যুবক প্রশিক্ষণ নেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ফুলছড়ি উপজেলায় মো. লুৎফর রহমান এমএনএ ও ডা. মফিজুর রহমান এমপিএ-সহ উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকার ও মাহবুব এলাহী রঞ্জু, বীর প্রতীক- এবং প্লাটুন কমান্ডার শামসুল আলম, মহসিন আলী, নাজিম উদ্দিন, আব্দুল জলিল তোতা, আবু বকর সিদ্দিক ও তসলিমউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গাইবান্ধা জেলায় ছয়টি কোম্পানি গঠন করা হয় রোস্তম আলী খন্দকার কোম্পানি, মাহবুব এলাহী রঞ্জু কোম্পানি, এম এন নবী লালু কোম্পানি, আমিনুল ইসলাম কোম্পানি, খায়রুল আলম কোম্পানি এবং সাইফুল ইসলাম সাজু কোম্পানি। এর মধ্যে রোস্তম, রঞ্জু, লালু ও সাজু কোম্পানি ফুলছড়িতে সক্রিয় ছিল।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর পর হানাদাররা যাতে ফুলছড়িতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য রাস্তায় গর্ত করে এবং গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু সব প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে পাকবাহিনী ২৩শে এপ্রিল ফুলছড়িতে প্রবেশ করে এবং মে মাসের প্রথম দিকে সিও (ডেভলপমেন্ট) অফিস সংলগ্ন থানা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তিস্তামুখ ঘাট ও কাইয়ারহাট ওয়াপদা ডাকবাংলোতে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকহানাদার বাহিনীর সমর্থনে ভোলা, খাকসার মৌলভী, বাকী মাস্টার, ইজারত মুন্সী, ফজল, বিলাত আলী, আমজাদ, শওকত আলী প্রমুখ এখানে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। নভেম্বর মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী বাউসী গ্রামে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে মোজাম্মেল হক ও ইজার আলীসহ কয়েকজনকে হত্যা করে। ফুলছড়ি ঘাট (তিস্তামুখ ঘাট) এলাকায় বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে এবং ট্রেন থেকে নামিয়ে সহস্রাধিক লোককে হত্যা করে। তাদের কাউকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কাউকে গুলি করে, কাউকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো পার্শ্ববর্তী স্থানে মাটিচাপা দেয়। অনেককে কুপিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় পুঁতে রাখা হয়। তাই এ স্থানটি ফুলছড়ি বধ্যভূমি ও গণকবর- নামে পরিচিত। স্বাধীনতার পর এখানে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। বধ্যভূমিটির অবস্থান ভরতখালী-তিস্তামুখঘাট রেল লাইন সংলগ্ন হওয়ায় যাতায়াতের সময় প্রতিটি ট্রেন শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য ১ মিনিট দাঁড়াত। এ নিয়ম তিস্তামুখঘাট চালু থাকা পর্যন্ত কার্যকর ছিল। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে এ উপজেলায় অর্ধশতাধিক সাধারণ লোক শহীদ হন। কাইয়ারহাটে আরেকটি বধ্যভূমি ও গণকবর ছিল। যুদ্ধের নয়মাস এখানকার ডাকবাংলো ক্যাম্পে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অনেককে হত্যা এবং অনেক নারীকে নির্যাতন করে। ক্যাম্প থেকে অর্ধকিলোমিটার দক্ষিণে নিহতদের কবর দেয়া হয়। বর্তমানে তার কোনো চিহ্ন আর নেই।
থানা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তিস্তামুখ ঘাট এবং কাইয়ারহাট ওয়াপদা ডাকবাংলো ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র বন্দিশিবির। এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি যুদ্ধ, আক্রমণ ও অপারেশন পরিচালনা করেন। সেগুলো হলো- উড়িয়ারচর যুদ্ধ, তিস্তামুখ ঘাটে পাকবাহিনীর জাহাজ আক্রমণ, রসুলপুর সুইস গেট যুদ্ধ, – কালাসোনা যুদ্ধ- এবং ফুলছড়ি থানা অপারেশন। উরিয়ারচর যুদ্ধ সংঘটিত হয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এ-সময় রাজাকারদের একটি দল কালাসোনার চরে লুটপাট করতে আসে। এ খবর পেয়ে কমান্ডার মাহবুব এলাহী রঞ্জুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ারচরে তাদের ঘেরাও করেন এবং ১২ জনকে আটক করেন। দুজনকে গ্রামের মানুষ কুপিয়ে হত্যা করে এবং অপর দুজন অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ১৬টি রাইফেল হস্তগত করেন। এ ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পরদিন পাকবাহিনী উড়িয়া গ্রামে এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ঐদিন দুপুরে আরো ১০- ১৫ জন পাকসেনা নৌকাযোগে উড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করার সময় মাহবুব এলাহী রঞ্জু সহযোদ্ধাদের নিয়ে তাদের আক্রমণ করেন। নৌকার ছইয়ের ওপর বসা একজন পাকসেনা অস্ত্রসহ পানিতে পড়ে যায়। বাকিরা গুলি চালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। উভয় পক্ষে তুমুল গোলাগুলি হয়। যুদ্ধে কয়েকজন হানাদার নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তযোদ্ধারা বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন।
তিস্তামুখ ঘাটে পাকবাহিনীর জাহাজ আক্রমণ পরিচালিত হয় ১৬ই অক্টোবর রাতে। এর আগে রৌমারী ও চিলমারীর মুক্তাঞ্চল দখল করার জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই পাকবাহিনীর তিনটি জাহাজ তিস্তামুখ ঘাটে আসে। অস্ত্র ও গেলাবারুদ ট্রেনযোগে রংপুর সেনানিবাসে নেয়ার জন্য আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর ৭২ ব্রিগেড রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তিস্তামুখ ঘাটে আসে। ঘাটের কর্মচারীদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকার মানকারচর সাবসেক্টর কমান্ডার ফ্লাইট লে. হামিদুল্লাহ খানকে তা জানান। তিনি তৎক্ষণাৎ জাহাজ আক্রমণের নির্দেশ দেন। তাঁদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর গৌহাটি থেকে তিনজন নৌকমান্ডো পাঠানো হয়। রোস্তম ও রঞ্জু কোম্পানির যোদ্ধাদের সহায়তায় নৌকমান্ডোরা জাহাজ তিনটি রেকি করেন এবং ১৬ই অক্টোবর রাতে সাঁতার কেটে জাহাজে মাইন স্থাপন করতে যান। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত স্থানে পজিশন নেন। নদীতে প্রচণ্ড স্রোত ও প্রবল বৃষ্টির কারণে কমান্ডোরা ঠিকমতো মাইন স্থাপন করতে ব্যর্থ হন। এমতাবস্থায় একজন কমান্ডো নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ফিরে আসতে পারলেও অপর দুজন জাহাজের প্রপেলারে আটকে শহীদ হন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের এ অপারেশন ব্যর্থ হয়।
রসুলপুর সুইস গেট যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫ই অক্টোবর। গেট রক্ষার দায়িত্বে ছিল কয়েকজন পাকসেনা, মুজাহিদ ও রাজাকার। তারা প্রায়শই গেটের আশপাশের বাড়িঘরে হামলা ও নির্যাতন চালাত। এলাকার লোকজনদের বাড়ি থেকে জোর করে চাল-ডাল, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ইত্যাদি নিয়ে আসত। রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী লোকজনদের মারধর করে তাদের টাকা-পয়সা কেড়ে নিত। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুজা কোম্পানির বিস্ফোরক দলের সহায়তায় লালু কোম্পানি সুইস গেট আক্রমণ করে। উভয় পক্ষে প্রায় দুঘণ্টা যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে হানাদাররা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে তিনজন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন মুজাহিদ বন্দি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ৪টি এলএমজি উদ্ধার করেন।
কালাসোনা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩রা নভেম্বর। এ-যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পাকসেনারা পালিয়ে যায়। ফুলছড়ি থানা অপারেশন পরিচালিত হয় ৪ঠা ডিসেম্বর। এতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় বিনাযুদ্ধে থানা দখল ও ২২টি রাইফেল হস্তগত করেন। এর পরের একটি যুদ্ধে ২৩ জন পাকসেনা নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়। অপরপক্ষে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২৫ জন আহত হন। এদিনই ফুলছড়ি উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ফুলছড়ি উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শহীদুল্লাহ (পিতা সাহেব আলী, গজারিয়া), হাবিবুর রহমান (পিতা জয়নাল উদ্দিন সরকার, গজারিয়া), হালিম উদ্দিন (পিতা কমর উদ্দিন, হরিপুর), জবেদ আলী (পিতা বাদল উদ্দিন, উড়িয়া), শহীদুল ইসলাম (ফুলছড়ি) এবং মসির আলী (ঘরভাঙ্গা)। এছাড়া ৪ঠা ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানা যুদ্ধে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার জাহেদুর রহমান বাদল (পিতা মো. মোস্তাফিজুর রহমান, উনচরখি) এবং গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার আফজাল হোসেন (পিতা আলহাজ্ব করিম উদ্দিন মণ্ডল, থৈকেপাড়া), আব্দুস সোবহান (পিতা ইয়াসিন ব্যাপারী, আমদারীপাড়া), কাবেজ আলী (পিতা মোহাম্মদ করম উদ্দিন, কালপানি) এবং আনছার আলী প্রধান (পিতা আব্দুল মজিদ প্রধান, বাদিনারপাড়া) শহীদ হন।
ফুলছড়ি থানা বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিমের নামানুসারে কালাসোনা ইউনিয়নের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ফজলুপুর ইউনিয়ন। কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকার ফুলছড়ি থানা যুদ্ধে ৫ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর পাকা করেছেন এবং কবরের পাশে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছেন। ২০১৪ সালে এখানে একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি পাঠাগার নির্মিত হয়েছে। [মো. আব্দুল জলিল তোতা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড