You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে পোরশা উপজেলা (নওগাঁ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে পোরশা উপজেলা (নওগাঁ)

পোরশা উপজেলা (নওগাঁ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর সারাদেশের মতো পোরশা থানায়ও সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম শুরু হয়। ডা. আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে পোরশা থানা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল আলী শাহ, নুর মোহাম্মদ, খয়ের উদ্দিন, জমির উদ্দিন, খোদা বক্স, আজিজার রহমান মাস্টার এবং আব্দুর রহমান। ডা. বশিরুল হক শাহ্ চৗধুরীর নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রহমান, এস এম একরামুল হক, আকবর আলী মাস্টার, মজিবুর রহমান, ডা. আবু তাহের ও ডা. শামসুল হক। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও উপদেষ্টা পরিষদ পোরশা থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
পোরশা থানার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে সাপাহার থানার হাট সাউলিতে অবস্থিত ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি মেজর নাজমুল হকের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে ভারতের নদিয়া ও কান্দুয়ায় মেজর চন্দ্র শেখরের অধীনে অনেককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া ভারতের রায়গঞ্জ ও শিলিগুড়ি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও পোরশার মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
পোরশায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ডা. বশিরুল হক শাহ্ চৌধুরী। অন্য যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে কমান্ডার হিসেবে ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন- আব্দুল ওয়াহেদ শাহ্ (পিতা আব্দুল লতিফ শাহ্, ছাওড়), ইউনুছ আলী (পিতা ইসমাইল সরকার, গণপতিপুর), মোদাচ্ছের হোসেন (পিতা মোজাফ্ফর হোসেন, মোল্লাপাড়া), তাইজুল ইসলাম (পিতা নজির উদ্দিন, ছাওড়), আব্দুল বারি (পিতা আজিজার রহমান, মহাডাংগা) প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকবাহিনী পোরশা উপজেলার সরাইগাছি ও নিতপুরে প্রবেশ করে। ১৯শে মার্চ তারা পোরশা থানা দখল করে। ২১শে মার্চ নিতপুরে অবস্থিত ডাকবাংলোয় তারা সভা করে। ২২শে মার্চ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে তাদের একটি জরুরি সভা হয়। এতে নেতৃত্ব দেয় পাকবাহিনীর মেজর খোরশেদ আলম। সে-সময় হানাদাররা পোরশা থানায় কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট হাফিজার রহমানকে নানা হুমকি প্রদান এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের পক্ষে কাজ করার কথা বলে।
২৭শে এপ্রিল ডা. খালেকের নির্দেশে ১০-১১ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধাদানের জন্য মশিদপুর ইউনিয়নের মার্টিনন্দর খাড়ির ওপর নির্মিত ব্রিজটি বিস্ফোরক দিয়ে ভেঙ্গে দেয়।
পোরশা প্রবেশের পথে সাপাহারের মধইল এলাকায় পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এসব চেষ্টা সত্ত্বেও পাকবাহিনী সমগ্র পোরশা উপজেলায় তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করে। তারা নিতপুর ডাকবাংলো, উপজেলা পরিষদ হলরুম, সরাইগাছি ও শিশায় নিজেদের এবং রাজাকারদের ক্যাম্প স্থাপন করে।
পোরশায় শান্তি কমিটি-র প্রধান ছিল জিলুর রহমান শাহ্ (পিতা ইব্রাহীম শাহ্, পোরশা)। তার অন্যতম সহযোগী ছিল আব্দুল আজিজ শাহ্ (নিতপুর)। এছাড়া রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল ডা. হাবিবুর রহমান, রাজ্জাক শাহ্ (পোরশা), নূরুল হক শাহ্ (পোরশা), কলিমদ্দিন মাস্টার (নিতপুর), ইব্রাহীম কাঁড়া (ছাওড়), শমসের আলী (নিতপুর), ইউনুছুর রহমান (ছাওড়), আছর উদ্দিন (দেউলিয়া বোরাম), গুল মোহাম্মদ (নিতপুর মাস্টারপাড়া), দিলদার (নিতপুর), রসুল (নিতপুর), আব্দুল কুদ্দুস (নিতপুর বাঙ্গালপাড়া), মনুয়া (নিতপুর), মোহাম্মদ আলী (নিতপুর), জলিল (নিতপুর), শমসের আলী বক্সী (নিতপুর) প্রমুখ।
পোরশা থানার ছাওড় দিঘিপাড়ার আদিবাসী রবিদাসের স্ত্রী পাকবাহিনী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। নিতপুর পশ্চিম দিয়াড়াপাড়ার যমুন মহাজনের স্ত্রীও একই রকম নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা নারীনির্যাতন, ধান, সোনা, নগদ অর্থ এবং গবাদি পশু লুট করে। পোরশা গবিরা কুড়ির কাদের খলিফাকে শারীরিক নির্যাতন করে এবং তার মেয়ের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে পঙ্গু করে দেয়।
নিতপুর বাঙ্গালপাড়া বদিউজ্জামানের বাড়ি, শোভাপুর ললিত বর্মণের বাড়ি, জসিম হাড়ির বাড়ি, নিতপুর মাস্টারপাড়া, শিশা, ভবানীপুর হিন্দুপাড়া, শরিয়ালার বিভিন্ন বাড়িতে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ করে।
পাকবাহিনী ১৬ই জুলাই ২১ জন সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে নিতপুর ডাকবাংলোর কূপে ফেলে দেয়। এ হত্যাকাণ্ড নিতপুর গণহত্যা নামে পরিচিত।
১৭ই নভেম্বর ভারতে যাওয়ার পথে ছাওড় ইউপির বাঁকইল রাস্তা পার হওয়ার সময় গণপতিপুর গ্রামের ফয়েজ উদ্দিন (পিতা কে সরদার) ও ইয়াকুব আলী (পিতা শুকুর মোহাম্মদ) সন্দুরা গ্রামে (সাপাহার থানা) পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পাকসেনারা এ দুজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকবাহিনী শিশা গ্রামে ইমাম উদ্দিন, গস মোহাম্মদ, ছহির মণ্ডল, বশির আমিন ও আকরাম সরদারকে হত্যা করে। এ থানার আদিবাসী সিদু ওরাও, রামা ওরাও, উকিল ওরাও এবং সামারা ওরাও পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে প্রাণ হারায়। এছাড়া থানার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়।
নিতপুর বাঙ্গালপাড়ায় রাজাকার আব্দুল কুদ্দুসের বাড়ি, উপজেলা হাসপাতাল ও অডিটোরিয়ামে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। পোরশা উপজেলার নিতপুর মহিলা হাফেজিয়া মাদ্রাসা চত্বরে একটি এবং শিশা গ্রামে শিশা গণকবর রয়েছে।
অক্টোবর মাসের শেষদিকে ছাওড়ের মুক্তিযোদ্ধা ওয়াহেদ শাহ ও তাঁর দলের আফসার আলী, গোল্লা রহমান, ওহাব, তাইজুল ইসলাম, ইব্রাহীম, মোসলেম উদ্দিন, আবু বক্কার, আব্দুস ছাত্তার, আব্দুর রাজ্জাক-সহ অন্যরা সরাইগাছিতে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। সরাইগাছি পাকিস্তানি ক্যাম্প অপারেশন – যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার মারা যায় এবং ৮-১০ জন বন্দি হয়।
নভেম্বর মাসে ডা. খালেকের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল শিশা বাজারস্থ রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন চালায়। সেখানে ১৩ জন রাজাকার ধরা পড়ে। এখান থেকে বেশকিছু থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল এবং অন্য অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর পোরশা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
পোরশার একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁর নাম মজির উদ্দিন (পিতা বছির আমিন, খরপা, শিশা বাজার)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে পোরশায় দুটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। একটি উপজেলা সদরে নির্মিত শহীদ মিনার, অপরটি সরাইগাছি মোড়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ। [এম রইচ উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড