পুটিমারি-পূর্বপাড়া যুদ্ধ (কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী)
পুটিমারি-পূর্বপাড়া যুদ্ধ (কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী) সংঘটিত হয় ১৪ ও ১৫ই ডিসেম্বর। কিশোরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পুটিমারি ইউনিয়নে এ-যুদ্ধ হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্বে ব্রাহ্মণপাড়া, পশ্চিমে বকশিপাড়া, উত্তরে সাতপাইপাড়া ও দক্ষিণে কাছারিপাড়া। মিত্রবাহিনীর মেজর ছাওয়াল, মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন ইকবাল এঁদের নেতৃত্বে আব্দুল মোতালেব, এছারুল সাহা, সামসুল হক, অনিল, মফিজুল ইসলাম, আমিন ও জামালসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পুটিমারি-পূর্বপাড়া যুদ্ধ শুরু করে। এরপর ক্যাপ্টেন ছাতোয়ান সিংহের নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর একটি দল এ যুদ্ধে যোগ দেয়। যুদ্ধে পুটিমারি গ্রামের যতিন, মহেন্দ্র ও সুকুমারসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন।
পুটিমারি ইউনিয়নের সাদুরারপুলে পাকবাহিনীর ক্যাম্প থেকে পাকসেনা ও তাদের সহযোগী জহুর মুন্সি, কাশেম ও কুদ্দুস ডাক্তারের নেতৃত্বে রাজাকাররা আশেপাশের হিন্দুপাড়াগুলোতে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও নির্যাতন করত। কাশেম রাজাকারের সহযোগিতায় পাকবাহিনী খোকা বাবুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। রাজাকাররা চাঁদখানা ইউনিয়নের রমেশ বাবুর পুত্রকে কুপিয়ে হত্যা করে। পাকসেনাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিরীহ মানুষরা দেশত্যাগ করে। পাকসেনাদের এই অত্যাচার-নির্যাতনের খবর সীমান্ত পেড়িয়ে ভারতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে যায়। ফলে পাকবাহিনীর হাত থেকে নিরীহ মানুষদের বাঁচানোর জন্য মুক্তিবাহিনী মাঝে-মধ্যে আকস্মিকভাবে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করত। তবে ১৪ই ডিসেম্বর পুটিমারি-পূর্বপাড়ায় একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে যৌথবাহিনীর তীব্র আক্রমণে টিকতে না পেরে জলঢাকা, ডিমলা ও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে পাকসেনারা কিশোরগঞ্জ হাই স্কুলে ক্যাম্প গড়ে তোলে। যৌথবাহিনীর মেজর ছাওয়ালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ও ক্যাপ্টেন ছাতোয়ান সিংহের নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর অন্য একটি দল জলঢাকা থেকে এসে যোগ দিলে কিশোরগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ক্যাপ্টেন ইকবালের নেতৃতে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। আক্রমণে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা ক্যাম্প থেকে রকেট লঞ্চার নিক্ষেপের মাধ্যমে এর জবাব দেয়। ফলে, মুক্তিবাহিনীর ঐ দল প্রথমে কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর পাকবাহিনী ঐ গ্রামে প্রবেশ করে ব্যাপক হারে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন করে।
কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল ক্যাম্প থেকে পাকসেনাদের একটি দল ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা পাঁচ-ছয়টি জিপে করে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুটিমারি-পূর্বপাড়ার দিকে রওনা হয়। একই সময় যৌথবাহিনীর একটি দল ঐ এলাকায় আসে তাদের উপর আক্রমণ করার জন্য। ফলে, পুটিমারি- পূর্বপাড়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৫ই ডিসেম্বর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। পুটিমারি-পূর্বপাড়া যুদ্ধ হয়েছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ-যুদ্ধে পাকসেনাদের ছোড়া রকেট লঞ্চারের আঘাতে ৭ জন ভারতীয় সৈন্য শহীদ হন। কিন্তু যৌথবাহিনীর আক্রমণের মুখে বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটে সৈয়দপুর চলে যায়। ১৫ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে পাকবাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে পুটিমারি-পূর্বপাড়া যুদ্ধ শেষ হয়। এ-যুদ্ধে যৌথবাহিনী বিজয়ী হওয়ায় কিশোরগঞ্জ থানা শত্রুমুক্ত হয়। [আহম্মেদ শরীফ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড