মুক্তিযুদ্ধে পুঠিয়া উপজেলা (রাজশাহী)
পুঠিয়া উপজেলা (রাজশাহী) রাজশাহী জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কটি পুঠিয়া দিয়ে চলে যাওয়ায় ভৌগোলিক দিক থেকে এ অঞ্চলের গুরুত্ব অধিক। পুঠিয়ার রাজনীতি-সচেতন মানুষ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. মো. আলাউদ্দিনকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপিএ নির্বাচিত করে। সারা বাংলায় আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। পুঠিয়ার ছাত্র-জনতা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর পুঠিয়া থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি কাজী আব্দুল আওয়াল, আব্দুস সোবহান মণ্ডল, আব্দুর রহিম প্রমুখের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন নজরুল ইসলাম, ওয়াজেদ আলী শাহ, আব্দুল কাদের, ওমর আলী, আব্দুল ওয়াহেদ হেনা, ওবায়দুল গণি চাঁদ প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে পুঠিয়ার বিভিন্ন স্থানে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। একই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে পুঠিয়ার পাঁচানি মাঠে উৎসাহী ছাত্র-যুবকরা লাঠি ও তীর-ধনুক নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সংগ্রাম কমিটির উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ পুঠিয়ায় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
পুঠিয়ায় পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর যোদ্ধারা ৩১শে মার্চ থেকে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তাঁরা এ-সময় বিভিন্ন আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। ৩রা এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনী রাজশাহী সেনানিবাসে আশ্রয় নেয় এবং সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তখন সেনানিবাস ছাড়া পুরো রাজশাহী এলাকা মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিরোধকারী জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ অবস্থা কিছুদিন বজায় থাকলেও রাজশাহী শহর পুনর্দখলের জন্য ঢাকা থেকে দুই ডিভিশন পাকসেনা ১০ই এপ্রিল ফেরি ও স্টিমারযোগে নগরবাড়িঘাট হয়ে মর্টার- কামানসহ বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন তাদের মোকাবেলা করার জন্য সেনানিবাস এলাকায় যুদ্ধরত দুই কোম্পানি প্রতিরোধ যোদ্ধাকে ১১ই এপ্রিল নগরবাড়ির উদ্দেশে প্রেরণ করেন। কিন্তু সেখানে পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রের বিপরীতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পেরে তাঁরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। ১২ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পাবনার দিকে অগ্রসর হন এবং বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের রাজশাহী সেনানিবাসের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। তবে তিনি পাবনার দিকে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। পাকবাহিনী নগরবাড়ি ঘাটে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পর্যুদস্ত ও রাস্তার দুপাশের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১২ই এপ্রিল দুপুর আড়াইটা নাগাদ তারা পুঠিয়ার সন্নিকটস্থ ঝলমলিয়া বাজারে এসে পৌঁছায়। সেখানে সাধারণ জনতা তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে তারা শেষ পর্যন্ত রোধ করতে সক্ষম হয়নি। পাকসেনারা হাটবার উপলক্ষে ঝলমলিয়ায় সমাগত জনতাকে লক্ষ করে শেল নিক্ষেপ করে। এতে ১২ জনের অধিক সাধারণ মানুষ হতাহত হয়। এরপর পাকসেনাদের বহর রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকলে রাস্তার দুপাশে পজিশন নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলগুলো একসঙ্গে গর্জে ওঠে। পাকসেনারাও পাল্টা জবাব দেয়। এক পর্যায়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। তবে ঝলমলিয়া প্রতিরোধযুদ্ধ-এ বীরবিক্রমে লড়াই করে তাঁরা পাকবাহিনীর ৮-৯ জন সৈন্যকে হতাহত করতে সমর্থ হন।
এদিকে পাকবাহিনীর ঝলমলিয়া বাজার পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা বিড়ালদহের লোহারপুল ও তৎসংলগ্ন একাধিক স্থানে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। প্রতিরোধযোদ্ধা ও ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীও লোহারপুলে অবস্থান নেয়৷ তাদের সঙ্গে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও যোগ দেন। রাস্তার দুপাশের বড়বড় গাছ কেটে বিড়ালদহ থেকে কালুশাহর পুকুরপাড় পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। বিড়ালদহ এলাকায় শতশত মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিখা
খনন করে প্রতিরোধযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে বিড়ালদহ প্রতিরোধ যুদ্ধ-এও টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন। এরপর পাকবাহিনী এখানে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়ে এদিনই (১২ই এপ্রিল) পুঠিয়ায় প্রবেশ করে এবং পুঠিয়া রাজবাড়ি ও বানেশ্বর কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে।
পুঠিয়ায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী খুবই সক্রিয় ছিল। এখানে পাকবাহিনীর সহযোগীদের মধ্যে নূরুল ইসলাম (ভালুকগাছি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), আহাদ মোল্লা (পুঠিয়া থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), মোছা রাজাকার (পশ্চিমবাগ), ধোকড়াকুলের আব্দুর রহমান ও মো. তারা, আতাব হোসেন (ঘটিয়া), দমদমার ফনি, মহা ও সামু, তাউসির শাকের, আব্দুল প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ১২ই এপ্রিল পাকবাহিনী পুঠিয়ায় ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন চালায়। ঝলমলিয়া বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তারা বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও আগুন লাগানো হয়। পাকবাহিনী এসময় বিড়ালদহে ১৫টি, টোনাপাড়া গ্রামে ১১টি এবং শেখপাড়া গ্রামে ১৮টি বাড়িতে আগুন দেয়। এভাবে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস নৃশংস গণহত্যা, নির্যাতন ও লুটপাট চালিয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ঝলমলিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধের পর পাকবাহিনী ঝলমলিয়া, কানাইপাড়া ও পাইকপাড়া গ্রামের ১২ জন লোককে হত্যা করে। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ জনতা বিড়ালদহ মাদ্রাসায় আশ্রয় নিলে পাকবাহিনী সেখানে ঢুকে তাদের হত্যা করে। এ ঘটনা বিড়ালদহ মাদ্রাসা গণহত্যা- নামে পরিচিত। পাকবাহিনী ঝলমলিয়া বাজারের পার্শ্ববর্তী হিন্দু অধ্যুষিত পাইকপাড়া ও রায়পাড়া গ্রামদুটি পুড়িয়ে দেয়। একই দিন তারা পুঠিয়া বাজার, রামজীবনপুর, তারাপুর, পূর্ব কাঁঠালবাড়িয়া, বারুইপাড়া, কৃষ্ণপুর ও কান্দ্রা গ্রামে ৪৩ জনকে হত্যা করে, যা পুঠিয়া গণহত্যা- নামে পরিচিত। এরপর তারা পুঠিয়া বাজারসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে। বিড়ালদহ প্রতিরোধযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে পাকবাহিনী বিড়ালদহ, মাইপাড়া (শেখপাড়া), টোনাপাড়া ও ভাড়ুরা গ্রামে ৫৫ জন নারী-পুরষকে হত্যা করে, যা মাইপাড়া- ভাড়ুরা গণহত্যা- নামে খ্যাত। পুঠিয়া থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী আব্দুল আওয়ালের পিতা শেখ মওলানা আব্দুল হাসিব, ভাই শেখ আব্দুল কুদ্দুস ও বোন লতিফা বানু বেণুসহ অত্র এলাকার ১১৮ জনকে পাকবাহিনী হত্যা করে।
১৩ই এপ্রিল হানাদার বাহিনী পুঠিয়ার বানেশ্বরে প্রবেশ করে গণহত্যা চালায়। বানেশ্বর গণহত্যায় ১৩ জন নিরপরাধ মানুষ শহীদ হন। ১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী শিবপুর থেকে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একটি গ্রুপ জায়গীরপাড়ায়, আরেকটি গ্রুপ রঘুনাথপুরে প্রবেশ করে ১১ জনকে হত্যা করে, যা জায়গীরপাড়া-রঘুনাথপুর গণহত্যা – নামে পরিচিত। একই দিন তাদের দ্বারা সংঘটিত বিহারিপাড়া গণহত্যা-য় আরো ১২ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। শহীদদের গণকবরে সমাহিত করা হয়।
১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী পুঠিয়ার সুরেশ্বর কুণ্ডুর বাসায় প্রবেশ করে তাঁর পুত্র প্রদীপ কুণ্ডুর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নির্যাতন করে। ২২শে এপ্রিল পুঠিয়া থানার পার্শ্ববর্তী শিবমন্দির ও রাজবাড়ির গোবিন্দমন্দির লুটসহ মন্দির দুটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে এবং গোবিন্দমন্দিরে আশ্রয় নেয়া নারীদের নির্যাতন করে।
২৮শে নভেম্বর ভোরে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা নন্দনপুরের নজরুল ইসলামের বাড়িতে হামলা চালিয়ে হাঁস- মুরগি ও গরু-ছাগলসহ বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। পরদিন তার পুত্রবধূ রাজাকারদের ভয়ে ৯ দিনের শিশুকন্যাসহ পালিয়ে পিত্রালয়ে যাওয়ার পথে ধোকড়াকুলের রাজাকার আব্দুর রহমান, মো. তারা, তাউসি গ্রামের শাকের, আব্দুল ও নূরুল ইসলাম (ভালুকগাছি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান) লোহারপুলের নিকট তাঁর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
৩রা আগস্ট ইপিআর হাবিলদার শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ঝলমলিয়া সেতুর পাশে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে তাহেরপুরে চলে যান। আগস্ট মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলীর নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে বিড়ালদহ বাজার সংলগ্ন সেতুটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেন। ১৬ই ডিসেম্বর পুঠিয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
পুঠিয়া উপজেলায় চারজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন তৈমুর আলী মুন্সী (পিতা আবু তালেব মুন্সী, কানাইপাড়া), আবুল হোসেন (পিতা অমূল্য ফকির, টোনাপাড়া), আছের আলী (পিতা মেঘাই, রামজীবনপুর) ও বয়েতুল্লাহ (পিতা বয়েন উদ্দিন, তেলিপাড়া)।
পুঠিয়া উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামে সাঁওতাল ও ওঁরাও নৃগোষ্ঠীর শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। তানোর উপজেলার সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা চম্পাই সরেন ২০০৫ সালের ২২শে নভেম্বর এর উদ্বোধন করেন। বিড়ালদহ, ঝলমলিয়া ও অন্যান্য স্থানে গণহত্যার শিকার ১১৮ জনের একটি নামফলক ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক সংলগ্ন শাহ সৈয়দ করম আলী (রা:)-র মাজারের পূর্বপাশে নির্মিত হয়েছে। বিহারিপাড়া গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক ও বিড়ালদহ মাদ্রাসা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে বিড়ালদহ মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [মো. ইলিয়াছ উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড