You dont have javascript enabled! Please enable it! পিলখানা গণহত্যা - সংগ্রামের নোটবুক

পিলখানা গণহত্যা

পিলখানা গণহত্যা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশের বড়বড় শহর এবং ঢাকায় তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও শহরের বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ করে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তারা পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করলেও পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। নির্বাচনের ফলাফলকে বানচাল করতে একই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর লারকানাস্থ বাসভবনে আতিথেয়তা গ্রহণ করে। এর পূর্বে তারা গণমাধ্যমকে বলে যে, তারা পাখি শিকার করার জন্য সেখানে যাচ্ছে। আসলে পাখি শিকার নয়, সেখানে রাতভর তারা বাঙালি শিকারের ষড়যন্ত্র করে। এখানে বসেই তারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালিদের চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা স্থায়ী করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। একই নীলনকশার অংশ হিসেবে ‘বালুচিস্তানের কসাই’ হিসেবে পরিচিত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। ২৭শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১লা মার্চ পর্যন্ত বিমানে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ২২ বালুচ রেজিমেন্টকে ঢাকায় এনে ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত করে যথাক্রমে ঢাকা সেনানিবাস ও ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানায় মোতায়েন করা হয়। সমুদ্রপথে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসা চলতে থাকে। একদিকে মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা লোকদেখানো আলোচনা চালিয়ে যায়, অন্যদিকে বাঙালিদের হত্যার পরিকল্পনা অপারেশন সার্চলাইট সাজায়।
মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ২২ বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানায় নিয়ে আসা হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে ল্যান্স নায়েক আবুল বাশারসহ কয়েকজন বাঙালি ইপিআর সদস্য পিলখানায় একটি বিশাল গাছের ওপর স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এ ঘটনার পর থেকে পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। ২৪শে মার্চ বিকেল ৩টার দিকে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের নির্দেশে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোতে মজুত রেখে চাবি উইং কমান্ডারদের কাছে জমা করা হয়। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে যে-সকল বাঙালি ইপিআর সদস্য মোতায়েন ছিলেন, তাঁদের ২৫শে মার্চ পিলখানায় ফেরত আনা হয়। তবে গভর্নর হাউজ, প্রেসিডেন্ট হাউজ প্রভৃতি স্থানে দায়িত্বরত ইপিআর সদস্যরা সেখানেই থেকে যান। ২৫শে মার্চ দুপুরের দিকে পিলখানায় অবস্থানরত ২২ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য সমগ্র পিলখানা এলাকা পর্যবেক্ষণ পরিদর্শন করে। বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যদের পিলখানা এলাকা পরিদর্শন করা, বাঙালি ইপিআর সদস্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা নেয়া এবং পিলখানার বাইরে দায়িত্বরত ইপিআর সদস্যদের পিলখানায় ফেরত আনার কারণে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা বুঝতে পারেন যে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
২২ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানায় আসার পর থেকে নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ২-৩ জন করে সৈন্য পিলখানার অভ্যন্তরে ঘোরাফেরা করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি ইপিআর সদস্যদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করা। ২৫শে মার্চ পিলখানার বিভিন্ন গেটে যে-সকল পাকিস্তানি ইপিআর সদস্য দায়িত্বরত ছিল, তাদের প্রত্যাহার করে বাঙালি সদস্যদের নিয়োগ করা হয়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টার গার্ডে পাকিস্তানি জেসিও-র পরিবর্তে বাঙালি জেসিও নিয়োগ করা হয়।
পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তরে ঢাকা সেক্টরসহ ৫টি উইং যথা ১৩, ১৫ ও ১৬ নম্বর উইং, হেডকোয়ার্টার উইং, সিগন্যাল উইং ও অফিস স্টাফ মিলে আনুমানিক ২,২০০ জন সদস্যের মধ্যে বাঙালি ছিলেন প্রায় ২,০০০ জন। পিলখানার ৬টি গেটে স্বাভাবিক নিয়মে গার্ড মোতায়েন থাকলেও মার্চ মাসের শুরু থেকে প্রতিটি গেটে গার্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৮ জনে উন্নীত করে ২৪ ঘণ্টার জন্য নিয়োগ করা হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি। তবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে যে-কোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনার সম্ভাবনা থাকার পরও প্রত্যেক গার্ডকে মাত্র ২০ রাউন্ড (কোনো- কোনো ক্ষেত্রে তারও কম) গুলি বরাদ্দ করা হয়।
২৫শে মার্চ বিকেলের দিকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে পিলখানায় গুজব রটায় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব দাবি মেনে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। আরো শোনা যায় যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাসে ফিরে যাবে এবং বাঙালি অফিসার ব্রিগেডিয়ার এম আই করিম ইপিআর-এর মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করবেন। তাই সে-রাতে পিলখানায় অবস্থানরত ২২ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যদের চলাফেরাকে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা সহজভাবে মেনে নেন। ওদিকে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক কর্তৃপক্ষকে পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে বিকেল ৪টার দিকে গোপনে বিমানযোগে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে করাচির পথে যাত্রা করেন। ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগের খবর রাত ৮টার দিকে জানাজানি হয়।
এর প্রায় দুঘণ্টা পরই ঢাকা সেনানিবাস থেকে জিপ ও ট্রাক বোঝাই করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ, সাঁজোয়া ও পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে থাকে।
২৫শে মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে ২২ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানার সব কয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়ে আক্রমণের জন্য নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকে। তাছাড়া ৩ নম্বর গেটের সামনের রাস্তায় ২টি পাকিস্তানি ট্যাংক (প্রতিটি ট্যাংকে কামানসহ ১৫-২০ জন করে পাকিস্তানি সৈন্য) অবস্থান নেয়। রাত ১২টার দিকে প্রথমে একটি গুলির শব্দ হয়। তারপরই ২২ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা সমগ্র পিলখানায় একসঙ্গে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টার গার্ডের ১৮ জন বাঙালি ইপিআর সদস্য তাঁদের সামান্য গুলি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা কোয়ার্টার গার্ডে আক্রমণ করে গার্ড কমান্ডার বাঙালি নায়েব সুবেদার শামসুল হককে হত্যা করে। ৩ নম্বর গেট থেকে নায়েক মো. জহিরুল হকের নেতৃত্বে বাঙালি সদস্যরা ইপিআর-এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নিসার আহমেদ খানের বাসভবন লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করেন। একই সঙ্গে বাঙালি সদস্যরা অন্যান্য গেট থেকেও পাল্টা আক্রমণ করতে থাকেন। ২ নম্বর গেটে দায়িত্বরত গার্ড কমান্ডার নায়েক মহিউদ্দিন পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে শহীদ হন। পাকিস্তানি সৈন্যদের পরিকল্পিত আক্রমণ ও ভারী অস্ত্রের বিপরীতে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। পাকসেনাদের ব্যাপক আক্রমণের মুখে বেশকিছু বাঙালি ইপিআর সদস্য অস্ত্র নিয়ে আবার অনেকে অস্ত্র ফেলে পিলখানা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা সে-রাতেই সমগ্র পিলখানা এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং অনেক বাঙালি ইপিআর সদস্য তাদের গুলিতে শহীদ ও অনেকে বন্দি হন।
২৬শে মার্চ সকাল ৭টার সময় বাঙালি ইপিআর সদস্যদের আলাদা করে ইপিআর-এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নিসার আহমেদ খান বলেন, যে-সকল বাঙালি ইপিআর সদস্যকে বন্দি করা হয়েছে তারা সবাই মুক্ত। কিন্তু অফিসে যাওয়ার পরপরই বাঙালি ইপিআর সদস্যদের বন্দি করে পিলখানার একটি দ্বিতল ব্যারাকে ৪-৫ দিন পর্যন্ত নাওয়া-খাওয়া ব্যতিরেকে আটক রাখা হয়। ২৯শে মার্চ সকাল ১০টার দিকে কয়েকজন বাঙালি ইপিআর সদস্য ব্যারাকের বারান্দায় বসে কথা বলার সময় সিপাহি মো. আবদুল মতিন একটু উঠে দাঁড়ালে একজন পাকিস্তানি সৈন্য তৎক্ষণাৎ তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। ৯ই এপ্রিল সুবেদার মো. ফজলুর রহমানকে গুলি করে এবং সুবেদার মেজর মো. শওকতকে গাড়ির চাকার সঙ্গে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে পিলখানা এলাকা ঘুরিয়ে হত্যা করা হয়। ১১ই এপ্রিল ইপিআর-এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নিসার আহমেদ খান সেক্টর সদর দপ্তর মাঠে পুনরায় ইপিআর সদস্যদের জানান যে, একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল এবং সরকারিভাবে এর সমাধানও করা হয়েছে। ইপিআর সদস্যরা পূর্বের মতোই নিজ-নিজ দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু ১৫-২০ মিনিট পরই নির্দেশ আসে যে, কোনো বাঙালি ইপিআর সদস্য ডিউটি করতে পারবে না এবং তারা বন্দিই থাকবে। বন্দিদের ১২-১৩ই এপ্রিল মোহাম্মদপুরস্থ সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। মে মাসের শেষের দিকে কাজের অজুহাতে বন্দিদের মধ্য থেকে এনসিওদের আলাদা করে ঢাকা সেনানিবাস ও নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়, যাঁরা আর কোনো দিন ফিরে আসেননি। এভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা অনেক বাঙালি ইপিআর সদস্যকে হত্যা করে। তবে মোহাম্মদপুরস্থ সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে বাঙালি কিছু ইপিআর সদস্য পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
২৫শে মার্চ রাতে পিলখানা আক্রমণের পর যে-সকল বাঙালি ইপিআর সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, তাঁরা বুড়িগঙ্গা নদী অতিক্রম করে জিঞ্জিরায় গিয়ে সুবেদার গণির নেতৃত্বে একত্রিত হন। তাঁরা পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণে তাঁদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেলে একটি দল নরসিংদীর দিকে এবং আরেকটি দল মানিকগঞ্জের দিকে চলে যায়। পরবর্তীকালে তাঁদের অনেকে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সেক্টরে যোগদান করেন। আবার অনেকে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর সৈন্যদের অবদান অবিস্মরণীয়। অন্যান্য স্থাপনা ও মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর শহীদদের স্মরণে একাধিক সড়কের নামকরণসহ পিলখানার অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের সুউচ্চ একটি স্মৃতিস্তম্ভ, উত্তর দিকে ৪নং গেইট সংলগ্ন স্থানের ‘স্মৃতি অম্লান’ ভাস্কর্য, একই গেইটের বাহিরে দেয়ালে একটি ম্যুরাল চিত্রকর্ম রয়েছে। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড