পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার যুদ্ধ (বদলগাছী, নওগাঁ)
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার যুদ্ধ (বদলগাছী, নওগাঁ) সংঘটিত হয় ৭ই অক্টোবর। এতে ১১৫ জন পাকসেনা ও ২৬ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার যুদ্ধ এ এলাকার রক্তক্ষয়ী ও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর একটি।
বদলগাছী উপজেলা সদর থেকে ৮ কিমি দূরে ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার অবস্থিত। অক্টোবর মাসে এখানে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। অক্টোবরের প্রথম অর্ধে পাহাড়পুরস্থ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পটিকে প্রায় ১৫০ পাকিস্তানি সেনা ও সশস্ত্র রাজাকার দুদিক থেকে ঘিরে ফেলে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার পাকসেনাদের একটি অংশ পাহাড়পুর ইউনিয়নের রনাহার নামক গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও গ্রামবাসীর ওপর ব্রাশফায়ার করে। তারা নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। আক্রান্ত হওয়ার সময় পাহাড়পুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তখন ৩০-৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন ৭ নম্বর সেক্টরের ১৩নং বাহিনীর কমান্ডার ফরমুজুল হক পান্না। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎক্ষণাৎ দুই ভাগে ভাগ করে আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়। প্রথম দলের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে থাকে। এ অবস্থায় দ্বিতীয় দল পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের বাধা দেয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের আওতায় এসে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা অটোমেটিক মেশিনগান, এসএলআর ও রাইফেল দিয়ে তাদের ওপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। পাকসেনারা জবাব দিলে দুপক্ষের মধ্যে প্রায় ৬ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এমন অবস্থায় পাকবাহিনীর সঙ্গে থাকা সিগন্যাল কোরের সদস্যরা পালিয়ে জয়পুরহাট ডিভিশনাল কোয়ার্টার্সে খবর দেয়। কিছুক্ষণ পর তাদের অপর একটি দল পাহাড়পুরে এসে বৌদ্ধ বিহারের পাশে সমাজকল্যাণ দপ্তরের কার্যালয় সংলগ্ন রেস্টহাউজের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পাকসেনাদের এ দলও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার কাছে কাবু হয়। কিন্তু শত্রুসেনাদের সঠিক সংখ্যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। পাকবাহিনীর সদস্য ছিল ৩ শতাধিক। এক পর্যায়ে শত্রুবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের পেছন থেকে ঘেরাও করে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের রসদও শেষ হয়ে আসে। পাকসেনাদের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের কমান্ডার এ কে এম ফজলুল করিম (পিতা আলহাজ আব্দুর রহিম, আক্কেলপুর বাজার, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট) ধরা পড়েন। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে-করতে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- আফজাল হোসেন (পিতা আব্দুল আজিজ সরদার, উত্তর রামপুর, থানা বদলগাছী; জয়পুরহাট কলেজের মানবিক শাখার ছাত্র), শরিফ উদ্দিন (পিতা সামির উদ্দিন মোল্লা, শিবপুর, আদমদিঘী, বগুড়া; মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ লিডার, পুলিশে চাকরি করতেন), আব্দুল গণি (পিতা নাসির উদ্দিন মণ্ডল, বদলগাছী, নওগাঁ), ফরিদ উদ্দিন (পিতা কিসমত উদ্দিন মল্লিক, থানাপাড়া, দর্শনা, কুষ্টিয়া) ও আছির উদ্দিন প্রামাণিক (পিতা বসির উদ্দিন মণ্ডল, সেনাপাড় বদলগাছী, নওগাঁ; আনসার বাহিনীতে চাকরি করতেন)। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১১৫ জন পাকিস্তানি সেনা ও ২৬ জন রাজাকার নিহত হয়।
পাকসেনারা এ-যুদ্ধের পরপর নিকটবর্তী গ্রামের ৭ জন নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। নিহত গ্রামবাসীরা হলেন— কাজেম সরদার, আজিম উদ্দিন, কিনা মণ্ডল, গিয়াস উদ্দিন, আক্কাস আলী ও অপর দুজন। বন্দি মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম ফজলুল করিমকে পাকসেনারা জয়পুরহাট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারা তাঁকে একটি ট্রাকে উঠিয়ে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালানো শুরু করে। এক পর্যায়ে ফজলুল করিম তাদের কাছ থেকে মাউথপিস কেড়ে নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘বন্ধুগণ, আমার এলএমজির গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় আমি ধরা পড়েছি। আমি স্বেচ্ছায় ধরা দেইনি। আপনারা আমার জন্যে কোনো কিছু ভাববেন না। আমার জীবনের জন্য আমি একটুও চিন্তিত না। আমার লাখ লাখ ভাই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আপনারা এইটুকু বিশ্বাস রাখুন, অল্পদিনের মধ্যেই এ দেশ স্বাধীনতা লাভ করবে।’ পাকবাহিনীর মেজর আফজাল হোসেন আত্মসমর্পণের বিনিময়ে তাঁকে প্রাণভিক্ষা দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। মেজর আফজাল হোসেনের জবাবে ফজলুল করিম বলেন, ‘আত্মসমর্পণ করার জন্য আমি যুদ্ধ শিখিনি। তোমাদের মতো নিকৃষ্ট পশুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে ঘৃণাবোধ করি।’ এরপর পাকসেনারা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়ে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ক্যাম্পে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কয়েকশ গজ দূরে এ- যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর রয়েছে। তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্মৃতিফলক বা সৌধ নির্মিত হয়নি। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড