পিঁপরাইল চারাবাড়ি ঘাট বধ্যভূমি (ফুলতলা, খুলনা)
পিঁপরাইল চারাবাড়ি ঘাট বধ্যভূমি (ফুলতলা, খুলনা) খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলায় অবস্থিত। উপজেলার ৩নং ইউনিয়নের অন্তর্গত পিঁপরাইল গ্রামের পাশে পিঁপরাইল খাল অবস্থিত। এ খালের তীরে জামিরা বাজারে ছিল রাজাকার ক্যাম্প। বাজারের কাছেই খাল পারাপারের ঘাট, যা চারাবাড়ি ঘাট নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার কর্তৃক বহু বাঙালিকে চারাবাড়ি ঘাটে ধরে এনে হত্যা করা হয় এবং হত্যার পর লাশ খালে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
পিঁপরাইল চারাবাড়ি ঘাট বধ্যভূমির সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা হলো ধামালিয়া ইউনিয়নের শতাধিক যুবককে প্রতারণার মাধ্যমে ধরে এনে হত্যা করা। এপ্রিল মাস থেকে খুলনার বিভিন্ন উপজেলার জনসাধারণ পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারআলবদর বাহিনী কর্তৃক হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের শিকার হয়। এরূপ প্রতিকূল পরিবেশেও ডুমুরিয়ার ধামালিয়া ইউনিয়নের প্রতিরোধযোদ্ধারা আগস্ট মাস পর্যন্ত হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব থেকেই ডুমুরিয়ায় নকশালদের অবস্থান ছিল। তারা এলাকায় ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ করত। এতে এলাকার মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য সংগঠিত হয়। শান্তি কমিটি- ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হলে তাদের সঙ্গে নকশালদের সংঘাত ঘটে। নকশালদের বাধার কারণে রাজাকাররা আগস্ট মাস পর্যন্ত ধামালিয়ায় প্রবেশ করতে পারেনি। অবশেষে ডুমুরিয়ার রাজাকার কমান্ডার গাউসুল আযম হাদীর নেতৃত্বে রাজাকার ও পাকসেনাদের বিশাল যৌথবাহিনী ধামালিয়ায় আক্রমণ চালায়। তারা গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এরপর রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা প্রতারণামূলক কৌশলের আশ্রয় নেয়। তারা বিভিন্ন স্থানে সভা করে জনগণকে আশ্বস্ত করে যে, গ্রামবাসী আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে। আর যদি তা না করা হয়, তাহলে একের পর এক অভিযান চালিয়ে সব কিছু ধ্বংস করে দেয়া হবে। ফলে গ্রামবাসী স্বাভাবিক জীবন যাপন ও সহায়-সম্পদ রক্ষাকল্পে তাদের এ মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন করে। গ্রামের সকল অধিবাসী একত্র হয়ে জামিরা বাজারে রাজাকার ক্যাম্পে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এসময় রাজাকাররা তাদের মধ্য থেকে শতাধিক যুবককে বেছে নিয়ে বাকি গ্রামবাসীকে ছেড়ে দেয়। বিশ্বাসঘাতক রাজাকাররা এরপর যুবকদের পিঁপরাইল চারাবাড়ি ঘাটে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- সবুর বিশ্বাস (পিতা দুলু বক্কার, ধামালিয়া), ছোট বুড়া মোল্লা (পিতা ফকির আহম্মেদ মোল্লা, ধামালিয়া), গনি মোল্লা (পিতা জব্বার মোল্লা, ধামালিয়া), আব্দুল জোয়াদ্দার (পিতা ফ্যালাই জোয়াদ্দার, ধামালিয়া), শফিউদ্দিন জোয়াদ্দার (পিতা রাঙা মিয়া, ধামালিয়া), আহাদ আলী মোড়ল (পিতা অনু মোড়ল, ধামালিয়া), মোজাহার তরফদার (পিতা ইয়াকুব তরফদার, ধামালিয়া), জামাল সরদার (পিঁপরাইল), জালাল বিশ্বাস (পিঁপরাইল), ওহাব আলী গাজী (পিঁপরাইল), আবু বকর মোল্লা (পিঁপরাইল), আলী গাজী (পিঁপরাইল), আহম্মদ ফকির (পিঁপরাইল), আজহার মোল্লা (পিঁপরাইল), আব্দুল জলিল (পিঁপরাইল), আলী হাফেজ গাজী (পিঁপরাইল), সরব মোল্লা (পিঁপরাইল), গোলাম মোস্তফা আকুঞ্জি (পিঁপরাইল), খোকা মোল্লা (পিঁপরাইল), যশোরত খাঁ (পিঁপরাইল), আফছার চৌধুরী (কাটেঙ্গা), সিদ্দিক মোল্লা (কাটেঙ্গা), নুরুদ্দিন মোড়ল (কাটেঙ্গা), বাবর আলী হালদার (কাটেঙ্গা), হাজের হালদার (কাটেঙ্গ), গোলাম নবী (ডাউকোনা) ও ইমান আলী (ডাউকোনা)। চারাবাড়ি ঘাটে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। [পারভীন সুলতানা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড