You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.14 | পানাউল্লারচর গণহত্যা (ভৈরব, কিশোরগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

পানাউল্লারচর গণহত্যা (ভৈরব, কিশোরগঞ্জ)

পানাউল্লারচর গণহত্যা (ভৈরব, কিশোরগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৪ই এপ্রিল। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলায় সংঘটিত এ গণহত্যায় প্রায় তিনশতাধিক নিরপরাধ লোক শহীদ হন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনী কর্তৃক ঢাকার পতনের পর ভৈরবের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ এবং ক্যাপ্টেন নাসিমের নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা স্থল ও নৌপথে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী নৌ, স্থল ও আকাশ পথে একযোগে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ৪টি জঙ্গি বিমান শিলাবৃষ্টির মতো শেল ও বোমা বর্ষণ করে। একই সঙ্গে ভৈরবের দক্ষিণ দিক থেকে গোলন্দাজ ও নৌবাহিনী এবং উত্তর দিক থেকে ছত্রীবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। হেলিকপ্টারের সাহায্যে পাকবাহিনীর সুইসাইড স্কোয়াডের ছত্রীসেনারা শিমুলকান্দি ইউনিয়নের মধ্যেরচর গ্রামের পূর্বদিকের মাঠে অবতরণ করে।
পাকবাহিনীর এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণে হাজার-হাজার নিরস্ত্র গ্রামবাসী এবং গ্রামে আশ্রয়গ্রহণকারী পৌরবাসী প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পশ্চিম দিকে ছুটতে থাকে। ঘাতকদের নির্বিচার গুলি থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা প্রাণভয়ে পার্শ্ববর্তী রায়পুরা থানার ইব্রাহিমপুর, সররাবাদসহ বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয়ের আশায় ব্রহ্মপুত্র নদের হালগড়া খেয়াঘাটের কাছে পানাউল্লারচরে গিয়ে জড়ো হয়। কিন্তু হাজার-হাজার নর-নারী ও শিশুর একটিমাত্র খেয়া দিয়ে পার হওয়া সম্ভব ছিল না। এমতাবস্থায় ইব্রাহিমপুরের জনসাধারণ তাদের উদ্ধারের জন্য কয়েকটি নৌকা নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু এরই মধ্যে পাকবাহিনীর একটি বিশাল দল এলোপাতাড়িভাবে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে এগিয়ে এসে খেয়াঘাটে অপেক্ষমাণ নিরস্ত্র লোকদের ঘেরাও করে ফেলে। ঘাতকদের আগমন টের পেয়ে অসংখ্য নর-নারী সন্তান কোলে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। যারা সাঁতার জানে না তাদের সলিল-সমাধি ঘটে। অনেকে নদী সাঁতারে পাড়ে উঠে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকলে পাকিবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে তারা প্রাণ হারায়। অনেককে নদী থেকে তুলে ক্ষেতের আইলে দাঁড় করিয়ে পাকসেনারা পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা এদিন এখানে তিনশতাধিক নিরপরাধ নর-নারী ও শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করে। তাদের রক্তে ব্রহ্মপুত্রের পানি লাল হয়ে যায়।
পানাউল্লারচর গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে মাত্র ১২ জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- হাছেন আলী (পিতা নাজির হোসেন, লক্ষ্মীপুর), আ. রহিম সর্দার (পিতা আ. আজিজ, লক্ষ্মীপুর), আ. করিম (পিতা ইয়াসিন মিয়া, লক্ষ্মীপুর), অলফতের মা (স্বামী বাদশা মিয়া, লক্ষ্মীপুর), ছমেদ মিয়া (পিতা অছম আলী, লক্ষ্মীপুর), মস্তু মিয়া (পিতা সিরাজ মিয়া, লক্ষ্মীপুর), সুফিয়া বানু (স্বামী নোয়াজ মিয়া, মাইলপাশা), তৈয়ব আলী (পিতা মো. ইসমাইল, লক্ষ্মীপুর), নবী হোসেন (পিতা মো. ইসমাইল, লক্ষ্মীপুর), লাল মিয়া লালু (পিতা তমিজ উদ্দিন, লক্ষ্মীপুর), আ. মালেক (পিতা ওয়াজেদ আলী, তাঁতারকান্দি) এবং সবজান বিবি (স্বামী আ. রশিদ, ভৈরবপুর)। এদেরসহ অন্য শহীদদের স্মরণে খেয়াঘাটের পশ্চিম পাশে একটি স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। [ইমরান হোসাইন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড