পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ যুদ্ধ (পাবনা সদর)
পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ যুদ্ধ (পাবনা সদর) সংঘটিত হয় ২৮শে মার্চ। পুলিশ লাইন্সের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ সফলভাবে প্রতিরোধ করার পর পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আশ্রয় নেয়া পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক জনতাসহ প্রতিরোধযোদ্ধাদের ঘেরাও ও প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়। অর্ধদিবস ধরে যুদ্ধ চলার পর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ৩০ জন পাকসেনা জনতার হাতে নিহত হয় এবং পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়।
৭১-এর ২৮শে মার্চ সকাল প্রায় ৯টা। ইতোমধ্যে পুলিশ লাইন্স মুক্ত হয়েছে। বিজয়ের এ খবর দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তেই লোকজন পুলিশ লাইন্সে এসে সমবেত হতে থাকে। আর আই আবুল খায়েরের সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যগণ অস্ত্রাগার থেকে ৩০৩ রাইফেল ও গুলি নিজেদের মধ্যে বিতরণ করেন। জেলাখানার তালা ভেঙ্গে কয়েদিদের মুক্ত করা হয়। এ-সময় খবর আসে পাকসেনারা পুলিশ লাইন্স থেকে পালিয়ে এসে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে। পাকসেনারা ২৫শে মার্চ রাতে এসেই টেলিফোন এক্সচেঞ্জ তাদের দখলে নিয়েছিল। খবর পেয়েই ছাত্র, যুবক, জনতা, চরের কৃষক, পুলিশ বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যগণ পাকসেনাদের দখলকৃত টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনটি ঘেরাও করে সম্মুখ যুদ্ধে নেমে পড়ে। এ জনযুদ্ধ-এ গ্রামের অসংখ্য সাধারণ মানুষ তাদের লাঠিসোঁটা, বর্শা, বল্লম, তীর-ধনুকসহ বিভিন্ন হাতিয়ার নিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাকসেনারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ভেতরে সুরক্ষিত অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে যুদ্ধ করে। পাকসেনাদের মেশিনগানের অনবরত গুলিবর্ষণের মধ্যেও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল চরম দুঃসাহসিক কাজ। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ছাদের ওপর থেকে পাকসেনারা জনতার গুলিবর্ষণের পাল্টা জবাব দিচ্ছিল। এ-সময় রফিকুল ইসলাম বকুল পাকসেনাদের লক্ষ করে গুলি করলে একজন পাকসেনা নিহত হয় এবং অন্যরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে এক্সচেঞ্জের ভেতরে আশ্রয় নেয়। রহিম নামে বানী সিনেমা হলের একজন কর্মচারী এক্সচেঞ্জের পেছনের আমগাছ দিয়ে ছাদের ওপর গিয়ে খুব সহজেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসে। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য হাবুল এসকল অস্ত্র চালানো শিখিয়ে দিয়ে তিনি একটি এলএমজি নিয়ে বানী সিনেমা হলের ছাদের ওপর উঠে এক্সচেঞ্জ লক্ষ করে গুলি করতে থাকেন। রহিমও অন্য একটি অস্ত্র দিয়ে অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলেন। এদিকে দামাল ছেলেরা পেট্রোল বাল্ব ছুড়ে এক্সচেঞ্জের ঘরের দরজা- জানালায় আগুন লাগিয়ে দিলে পাকসেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এ-সময় পাকসেনাদের কিছু গোলাবারুদ বারান্দায় পড়ে থাকায় বকুল অনেক কষ্ট করে একটি টমিগান নিয়ে এসে সহযোদ্ধা ইকবালকে দিয়ে আবার অস্ত্র আনতে যান। দ্বিতীয়বার অস্ত্র নিয়ে ফিরে আসার সময় পাকসেনারা বুঝতে পেরে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ-সময় একটি গুলি তাঁর কাঁধের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ায় কিছুটা আঘাত প্রাপ্ত হন। তবুও তিনি পিছু না হটে এসএমজি-টি নিয়ে এক্সচেঞ্জের পেছনে চাকীবাড়ির ছাদে স্থাপন করে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে এবং সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে পাকবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা। হাজার-হাজার লোকের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে পাকসেনাদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের গুলির শব্দ স্তিমিত হয়ে আসে। উপায়ান্তর না দেখে ভীত-সন্ত্রন্ত পাকবাহিনী শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুক্তিপাগল জনসাধারণ দলে-দলে ঢুকে পড়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মধ্যে। পাকসেনাদের টেনে-হিঁচড়ে এনে দাঁড় করায় জনতার কাতারে। যে যার মতো আক্রমণ করে মুহূর্তেই টুকরো- টুকরো করে ফেলে তাদের দেহ। এভাবে দুপুর ২টা থেকে ২.৩০টার মধ্যে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। হাজারো কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সমগ্র পাবনা শহর। যারা রুদ্ধশ্বাসে ঘরে বসেছিল, তারাও সবাই রাস্তায় নেমে আসে। গৃহবধূরা খিচুড়ি, নাস্তা, ডাব, রুটি, মিষ্টি পাঠাতে থাকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের জন্য। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ যুদ্ধে ৩০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে অস্ত্রহাতে এ-যুদ্ধে অংশ নেন। শিরিন বানু মিতিল ছিলেন একমাত্র মহিলা যিনি পুরুষের বেশে এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। [মো. হাবিবুল্লাহ্]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড