পাতিবুনিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)
পাতিবুনিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা) সংঘটিত হয় ৫ই সেপ্টেম্বর। এতে ৯ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের একটি গ্রাম পাতিবুনিয়া। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ঝিলা নদীর তীরে গ্রামটির অবস্থান। এপ্রিল মাস থেকে এ গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সশস্ত্র বামপন্থীরা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান নেন।
তাঁদের স্থানীয় নেতা ছিলেন শেখ আবদুল মজিদ (১৯৩৯- ১৯৮৯)। তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-র খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর নাম অনুসারে এ বাহিনী মজিদ বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। ৪ঠা সেপ্টেম্বর পাতিবুনিয়ায় অবস্থানরত এ বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে ঝিলা নদীতে পাকিস্তানি সেনা, বিহারি ও রাজাকারদের একটি লঞ্চ আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেন। এ আক্রমণে বেশ কয়েকজন রাজাকার মারা যায় এবং কিছু গোলা-বারুদ ও ১১টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরদিন ৫ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদাররা গানবোট নিয়ে পাতিবুনিয়া গ্রাম আক্রমণ করে। ঝিলা নদী থেকে তারা গ্রামের ওপর গুলি ও শেল নিক্ষেপ করে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে গোলা নিক্ষেপের পর পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ঢোকে। প্রথমে তারা গোলক রায় ও পুলিন রায়ের বাড়িতে প্রবেশ করে। সেখানে কাউকে না পেয়ে তারা এ বাড়িতে আগুন দেয়। গ্রামের অধিবাসীরা তখন ভয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। বৃদ্ধা অনুমতি রায় তার তিন বছর বয়সী পৌত্রী মলিনা রায়কে কোলে নিয়ে দৌঁড়ে পালাচ্ছিলেন। রাজাকাররা তার পিছু ধাওয়া করে শিশুটিসহ তাকে গুলি করে। প্রথম গুলি লাগে মলিনা রায়ের গায়ে। অনুমতি রায় শিশুটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় বুকে চেপে ধরেন। সঙ্গে-সঙ্গে রাজাকাররা তাকে গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণ পর মারা যান। মারা যাওয়ার সময়ও তার কোলে মলিনা রায়ের রক্তাক্ত মৃতদেহটি ছিল।
পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা এরপর গ্রামের উত্তর পাড়ার সরদার বাড়িতে প্রবেশ করে। এ বাড়ির লোকজন তখন বাড়ির পশ্চিম পাশের ধানক্ষেত এবং খালের ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। রাজাকাররা গুলি করতে- করতে ধানক্ষেতে ঢুকে এবং সেখান থেকে সরকার বাড়ির ৩ জন এবং মন্টু কুমার নামের একজনকে গুলি করে হত্যা করে। এদের হত্যা করে চলে যাওয়ার সময় রাজাকাররা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সরদার বাড়ির মহেন্দ্র সরকারকে দেখামাত্র গুলি করে। মহেন্দ্রনাথ সরকার সেখানেই প্রাণ হারান।
এ গণহত্যার পরে পাকিস্তানি সেনারা যখন গানবোটে ফিরে যাচ্ছিল, তখন স্থানীয় বলাবুনিয়া পি কে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনন্ত কুমার রায়কে সপরিবার বিলের একটি ঝোপের আড়ালে দেখতে পায়। সেখান থেকে তারা অনন্ত রায়কে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকারদের একটি দল এ-সময় সাহস ইউনিয়নের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জবেদ আলী কাজি (নোয়াকাঠি)-কে আটক করে। পঞ্চাশোর্ধ জবেদ আলী হিন্দু অধ্যুষিত পাতিবুনিয়া গ্রামে আশ্রয় নিয়ে সেখানকার মানুষদের সাহস যোগাতেন। বিশেষত চুকনগর গণহত্যার পর তিনি এ অঞ্চলের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে আসছিলেন। আটক করা এ দুজনকে গানবোটে নিয়ে যাওয়া হয়। অনন্ত রায়কে পরে বোট থেকে নদীর চরে নামিয়ে পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার মৃতদেহ সেখানেই পড়ে ছিল, জোয়ারের স্রোতে পরে সেটি ভেসে যায়। জবেদ আলী কাজিকেও পাকসেনারা নির্যাতন করে পরে হত্যা করে।
এ গণহত্যায় পাতিবুনিয়ার মোট ৯ জন শহীদ হন। তারা হলেন— অনুমতি রায় (স্বামী গয়ারাম রায়), মলিনা রায় (পিতা গুরুপদ রায়), মহেন্দ্র সরকার (পিতা পুটিরাম সরকার), গুরুপদ সরকার (পিতা বাদল সরকার), মন্টু ক্রমার রায়, বিনোদ বিহারী সরকার (পিতা রাসবিহারী সরকার), অনন্ত কুমার রায় (পিতা নকুল রায়), জবেদ আলী কাজী (নোয়াকাঠি, সাহস) ও মন্টু কুমার (মজিদ বাহিনী)। [দিব্যদ্যুতি সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড