পাগলা দেওয়ান গণহত্যা (জয়পুরহাট সদর)
পাগলা দেওয়ান গণহত্যা (জয়পুরহাট সদর) ২৪শে এপ্রিল থেকে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ গণহত্যায় ১০ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়।
পাগলা দেওয়ান স্থানটি জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলার ধলাহার ইউনিয়নের অন্তর্গত। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার পর জীবন রক্ষার্থে বিভিন্ন সীমান্ত পথ দিয়ে মানুষ ভারতে যেতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে জয়পুরহাট, সিংড়া, গুরুদাসপুর, নন্দীগ্রাম, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষ দলে-দলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত পাগলা দেওয়ান ও এর আশপাশের সীমান্ত ব্যবহার করে ভারতের পিরোজপুর ও চিঙ্গিশপুর এলাকায় আশ্রয় নিতে থাকে। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর হানাদাররা জানতে পারে। তারা এ-সকল মানুষের ওপর আক্রমণ চালাতে ওঁৎ পেতে থাকে। শরণার্থীরা দল বেঁধে পাগলা দেওয়ানে পৌছলেই হানাদার বাহিনী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটপাট আর ধর্ষণের পর নির্বিচারে হত্যা করত। হানাদার বাহিনী কর্তৃক ২৪শে এপ্রিল জয়পুরহাট দখলের পর প্রায়শই তারা এখানে গণহত্যা চালাত। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী পাগলা দেওয়ানে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৪ই ডিসেম্বর জয়পুরহাট হানাদারমুক্ত হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তাদের এ গণহত্যায় ১০ হাজারের অধিক মানুষ নিহত হয়। শুধুমাত্র ১৪ই ডিসেম্বর তারা কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই ১২২ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। শরণার্থীদের ভেতর থেকে অল্প বয়সী নারীদের ধরে বাংকার কিংবা পরিত্যক্ত বাড়িতে রেখে দিনের পর দিন তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। নির্যাতনের পর হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের নিকটবর্তী কুয়ার মধ্যে নিক্ষেপ করে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় নরপশুরা পৈশাচিক উল্লাস করত। হানাদারদের নিষ্ঠুর গণহত্যার একটি পদ্ধতি ছিল ধানভাঙ্গা ঢেকির গর্তে মাথা রেখে খুলি ভেঙ্গে চুরমার করা। পাগলা দেওয়ানের মাটি সহস্রাধিক বহিরাগত শহীদের রক্তে সিক্ত হয়েছিল। তাদের নাম-পরিচয় অজানাই রয়ে গেছে। হানাদারমুক্ত হওয়ার পর ১৫ই ডিসেম্বর গ্রামবাসী ভারত থেকে ফিরে এলে গ্রামের মাঠে এবং বাড়ি-ঘরের ভেতরে ও বাইরে অসংখ্য মানুষের লাশ, মাথার খুলি ও হাড়গোড় পড়ে থাকতে দেখে। গ্রামের অনেকের বাড়িতে তখন মেয়েদের ভাঙ্গা চুড়ি, ছেঁড়া ব্লাউজ- পেটিকোট, মাথার চুল ও মদের বোতল পাওয়া যায়। এখানকার মাটি খুঁড়লে এখনো শহীদদের হাড়গোড় পাওয়া যায়। শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড