পাগলা দেওয়ান মসজিদ গণহত্যা (জয়পুরহাট সদর)
পাগলা দেওয়ান মসজিদ গণহত্যা (জয়পুরহাট সদর) ১৮ই জুন শুক্রবার জুমার নামাজের সময় সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ নৃশংস গণহত্যায় ৪০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর জয়পুরহাটের সীমান্ত এলাকা পাগলা দেওয়ান এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এলাকার ছাত্র-যুবকরা দলে-দলে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করেন। পাগলা দেওয়ানের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছে – রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে হানাদাররা এলাকার মানুষজনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। তারা এখানে আক্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকে। সে মেতাবেক ১৮ই জুন হানাদার বাহিনী রাজাকারদের দেখানো পথে পাগলা দেওয়ানে আসে। সেদিন শুক্রবার হওয়ায় এলাকার কয়েকটি মসজিদে স্থানীয় লোকজন জুমার নামাজ আদায়ে ব্যস্ত ছিল। নামাজের সময় মসজিদে মুসল্লিরা খুতবা শুনছিলেন। এমন সময় হানাদারদের কতগুলো গাড়ি মসজিদগুলো ঘিরে ফেলে। রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে তারা মসজিদের ভেতরে ঢুকে পড়ে। অকথ্য ভাষায় মুসল্লিদের গালিগালাজ করতে থাকে এবং টেনে-হিঁচড়ে মসজিদের বাইরে নিয়ে আসে। নামাজ শেষ করার অনুরোধ পর্যন্ত তারা শোনেনি। তারা চিরলা, ভুটিয়াপাড়া, নওপাড়া, পাহনন্দা, খাসপাহনন্দা চকবরকতের সবগুলো মসজিদ থেকে প্রায় তিন শতজনকে রশি দিয়ে বেঁধে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের নিকট নিয়ে আসে। তাদের কয়েকজনকে দিয়ে জঙ্গল থেকে কাঁটা এনে মাটিতে বিছিয়ে তার ওপর দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করে। এভাবে তাদের ওপর চলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা।
এক পর্যায়ে আটককৃতদের হত্যার উদ্দেশ্যে বাংকারের পাশে ৪ লাইনে দাঁড় করানো হয়। হত্যার মুহূর্তে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য এসে বলে, সকলকে একযোগে হত্যা করলে বাংকার নির্মাণ, পরিখা খনন, রসদ বহন প্রভৃতি কাজে লোক পাওয়া যাবে না। তাই তারা বেছে-বেছে ৪০ জনকে আলাদা করে। অন্যদের পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করতে হবে বলে অঙ্গীকার করায়। এ-সময় শিক্ষক বাহার উদ্দিন কিছু বলতে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। তারা বাকি ৩৯ জনের দ্বারা বুক সমান গভীর পরিখা খনন করায়। এরপর তাদের একেকজনকে পরিখার কাছে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করতে থাকে। এদিন গণহত্যা থেকে আহত অবস্থায় বেঁচে যান আবেদ আলী (পাগলা দেওয়ান), সোলায়মান আলী দেওয়ান (নিধি, ধলাহার), মোজাম্মেল (চকবরকত), মোজাফফর (চিরলা), খোকা (চিরলা) প্রমুখ। পাগলা দেওয়ান মসজিদ গণহত্যায় ৪০ জন মানুষ শহীদ হলেও, সকলের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। যাদের নাম-পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- আনেস আলী মণ্ডল (চকবরকত), দুই সহোদর মফিজউদ্দিন ও গইমুদ্দিন (চিরলা), নাজির উদ্দিন (পাহনন্দা), বাহার উদ্দিন মাস্টার (ধলাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়), কসিম উদ্দিন (পাহনন্দা), গানা সরদার (পাহনন্দা), আহমেদ (চিরলা), মোহাম্মদ আলী (চিরলা), সিরাজুল (নিধি), মমতাজ (চকবরকত), বাহার উদ্দিন সরদার (চকবরকত), নিঝুম সরদার (চকবরকত) ও মমতাজ (জগদীশপুর)। [রেহানা পারভীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড