পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় <মিত্রবাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর নিকট পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ যুদ্ধের ইতিহাসে এক বড় ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে। বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের। সংক্ষেপে এর পটভূমি ছিল নিম্নরূপ-
দীর্ঘ এক ইতিহাস পথপরিক্রমা শেষে বাঙালি জাতিকে ৭১- এ পৌছাতে হয়েছে। তাদের জন্য ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ছিল ঐ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পথিমধ্যে সংঘটিত একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনামাত্র, যা মোকাবিলা করে বাঙালিদের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর রাষ্ট্রভাবনায় ছিল না। তাঁর ভাবনায় ছিল বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রে শুরু থেকেই বাঙালিদের ওপর এক ধরনের ঔপনিবেশিক ধাঁচের শাসন-শোষণ ও জাতি-নিপীড়ন শুরু হয়। ৪৮ ও ৫২-র ভাষা-আন্দোলন-এর মধ্য দিয়ে ঐ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম বিদ্রোহ দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন যে, পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর নিগড় থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এক কথায় সার্বিক জাতীয় মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। সে লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি পেশ করেন, যা বাঙালির জাতীয় ‘মুক্তিসনদ’ বা ‘ম্যাগনাকার্টা’ নামে পরিচিত। ৬- দফার ভিত্তিতে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ- ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালিদের চিরতরে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালিদের সতর্ক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ (১৯৭১)-এ স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে চূড়ান্ত লড়াইয়ের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লে এবং মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে তাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া’র নির্দেশ দেন। এর পরপর দেশের সর্বত্র পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ।
১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদ-কে প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়, যা মুজিবনগর সরকার নামে সর্বমহলে পরিচিত ছিল। একই দিন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিবৃন্দ ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ধারাবাহিকতায় এক বৈঠকে মিলিত হয়ে স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেন। ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা)-র বৈদ্যনাথতলায় বহু বিদেশী সাংবাদিক ও কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১০ই এপ্রিল সরকার গঠনের পরপর কর্নেল এম এ জি ওসমানী-কে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় বাংলাদেশের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ। এ-যুদ্ধ ছিল গণযুদ্ধ। পেশাদার/নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, নারী, পুরুষ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সর্বস্তরের মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিত ও সমন্বিতরূপে পরিচালনার লক্ষ্যে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রত্যেক সেক্টর একজন কমান্ডারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। প্রত্যেক সেক্টর (১০ নম্বর ব্যতীত)-কে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এক পর্যায়ে ‘জেড’ ফোর্স, ‘এস’ ফোর্স ও ‘কে ’ ফোর্স নামে ৩টি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয়। সীমিত আকারে হলেও যুদ্ধকালে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২৯ হাজারের মতো নিয়মিত/পেশাদার বাহিনীর সদস্য এবং ১ লক্ষ ৫৭ হাজার গণবাহিনীর সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এম্বুশ, গেরিলা অপারেশন ও সম্মুখ যুদ্ধে ক্রমান্বয়ে বীরত্বের পরিচয় দিতে থাকেন। হাজার-হাজার তরুণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে এগিয়ে আসে। ভারতীয় বিএসএফ ও নিয়মিত বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বহু এলাকা হানাদারমুক্ত রাখতে সক্ষম হন। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে, হানাদার বাহিনী ততই শহর ও তাদের অন্যান্য ঘাঁটির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনি অবস্থায় ২১শে নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান ভারতের পশ্চিম সীমান্তবর্তী বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালালে ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকার- ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। এর অধিনায়ক নিযুক্ত হন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। মুক্তিবাহিনীর ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগ্রেড এবং ভারতীয় বাহিনীর ৩টি কোর, ১টি কমিউনিকেশন জোন, ১টি প্যারা ব্রিগেড, ৩টি ব্রিগেড গ্রুপ ও ৫টি প্রশাসনিক সেক্টর মিলে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড গঠিত হয়।
৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান পশ্চিম ফ্রন্টে সীমান্তবর্তী একাধিক ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। সঙ্গে-সঙ্গে ভারত প্রতিআক্রমণ করে। এভাবে বাংলাদেশের প্রশ্নে দুদেশ সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য একই দিন ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ভারত প্রথমেই বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তান দখলকৃত পূর্বাঞ্চলে তাদের সকল বিমান ঘাঁটির রানওয়েসহ প্রায় সম্পূর্ণ বিমান শক্তি ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশ তিন দিক ভারতীয় সীমান্ত দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ায় ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনী বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে বিমান ও আর্টিলারি সাপোর্টসহ দ্রুত লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। একটি কলাম পঞ্চগড় থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া অভিমুখে, একটি দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া, পাবনা, যশোর, ফরিদপুর, অপর দুটি কলাম কানাইঘাট ও কুলাউড়ার দিক থেকে সিলেট ও মৌলভীবাজার, একটি ত্রিপুরার আগরতলা থেকে আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, নরসিংদী হয়ে ঢাকা অভিমুখে, এরই একটি অংশ কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী থেকে চট্টগ্রাম এবং অপর একটি কলাম রাঙ্গামাটির দিক থেকে চট্টগ্রাম এবং বড় দুটি মিত্রবাহিনীর কলামের একটি জামালপুরের কামালপুর থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ও অপরটি হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হয়।
৬ই ডিসেম্বর যশোর শহরের পতন ঘটে। এভাবে একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটি ও তাদের দখলকৃত শহরের পতন ঘটতে থাকে। কোথাও-কোথাও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়, কোথাও সাদা পতাকা উড়িয়ে দুহাত তুলে আত্মসমর্পণ করে, কোথাও হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করে, আবার কোথাও মিত্রবাহিনী প্রবেশের পূর্বেই তারা দখল ত্যাগ করে অন্যত্র সরে যায়। মুক্তিবাহিনীও অপ্রতিরোধ্য গতিতে সর্বত্র এগিয়ে যেতে থাকে। ১৫ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কোনো-কোনো অংশ ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। এদিকে ১৬ই ডিসেম্বর খুব ভোরে মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিং নাগরা-র নেতৃত্বে ভারতীয় কমান্ডো বাহিনী ঢাকার প্রবেশ পথে মিরপুর ব্রিজের অপর পাড়ে এসে উপস্থিত হয়। সংক্ষেপে এ ছিল ১৩ দিনের যুদ্ধ পরিস্থিতি। এদিকে পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে একাধিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ভেটো’ প্রয়োগে তা অকার্যকর হয়ে যায়। মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমনি অবস্থায় ৯ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক জরুরিভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির আবশ্যকতা তুলে ধরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এক বার্তা পাঠান। তিনি বিষয়টি গভর্নর ও ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর ওপর ছেড়ে দেন। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পাকিস্তানি প্রধান কর্মকর্তাগণ, যেমন জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল রহিম, মেজর জেনারেল জামসেদ, ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল শরিফ, এয়ার কমোডর ইমাম-উল হক সকলেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দ্রুত যুদ্ধবিরতিই একমাত্র উপায় হিসেবে নিজেদের মধ্যে একমত পোষণ করেন। তারা যুদ্ধ বিরতির একটি খসড়া 5 প্রস্তাব প্রস্তুত করে তা জাতিসংঘের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক হেনরী এবং ঢাকায় মার্কিন দুতাবাসের কনসাল জেনারেল স্পাইভাককে দেন। খসড়া প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক যুদ্ধ বিরতি, পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিরাপত্তাসহ পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা, পাকিস্তানের স্থানীয় দোসরদের নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে পাকিস্তানের এসব সেনাকর্মকর্তা স্পাইভাককে মধ্যস্থতা করারও অনুরোধ জানায়। তিনি এ ধরনের ভূমিকা পালনে তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করে বরং খসড়া প্রস্তাবটি ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দেন। এদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল শ্যাম মানেক শ’ পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তানি কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজীকে দ্রুত আত্মসমর্পণের জন্য রেডিওসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। ১২ই ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানি কর্মকর্তারা যুদ্ধবিরতির খসড়া প্রস্তাব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিবেচনার্থে প্রেরণ করে। প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে ত্বরিত কোনো সাড়া না পেয়ে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রেসিডেন্টের মতামত জানার জন্য তাকে অনুরোধ করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই, সামরিক জান্তার সহযোগী ও ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশিলব পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখ মনে করত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন শেষ মুহূর্তে সামরিক শক্তি নিয়ে পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়াবে। কার্যত তাদের এ আশা পূরণ হয়নি। এর মধ্যে ১৪ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক তার সরকারের সদস্য, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে গভর্নর হাউজ (বর্তমান বঙ্গভবন)-এ উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক করছিল। ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ এ খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেখানে বিমান হামলা চালানো হয়। সভা পণ্ড হয়ে যায়। ভীত-সন্ত্রস্ত ডা. মালিক তৎক্ষণাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে পদত্যাগপত্র লিখে তার সরকারের সকল সদস্য ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে রেডক্রস কর্তৃক ঘোষিত নিরপেক্ষ জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরবর্তী দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আলোচনা করে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
এদিকে জেনারেল মানেক শ’র পক্ষ থেকে পাকিস্তানের ইন্টার্ন কমান্ডের ওপর আত্মসমর্পণের জন্য ক্রমাগত চাপ অব্যাহত রাখা হয়। ভারতীয় কমান্ডো বাহিনী নিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর খুব ভোরে মেজর জেনারেল নাগরা ঢাকার সন্নিকটস্থ মিরপুর ব্রিজের অপর পাড়ে এসে উপস্থিত হওয়ার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি নিয়াজীর উদ্দেশে এক টুকরো চিরকুটে লেখেন, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি মিরপুর ব্রিজের কাছে আছি। তুমি তোমার প্রতিনিধি পাঠাও।’ অপরদিকে, একই দিন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব টাইপ করা আত্মসমর্পণের কপি নিয়ে ঢাকার তেজগাঁও পুরাতন এয়ারপোর্টে হেলিকপ্টারে করে এসে নেমে ক্যান্টনমেন্টে নিয়াজী ও অন্যান্য উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। মেজর জেনারেল নাগরা ও ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্নেল খেরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। নিয়াজীর পক্ষ থেকে সেনানিবাসে তাঁদেরকে মধ্যাহ্ন খাবারে আপ্যায়ন করা হয়।
উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনাকালে দেখা যায় যে, পাকিস্তানি সেনাকর্তৃপক্ষ আত্মসমর্পণের পরিবর্তে যুদ্ধবিরতির পক্ষে। কিন্তু এ নিয়ে দর কষাকষির কোনো অবস্থান তাদের জন্য অবশিষ্ট ছিল না। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গ্রুপ বিশেষ করে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বহিনীর একটি বড় অংশ ঢাকা শহরে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের দ্বারা ঢাকা চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ। পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ বড়-বড় শহর তাঁরা দখল করে নিয়েছেন। নিয়াজী ও তার সহকর্মীরা আত্মসমর্পণের ব্যাপারে ইতস্ততা দেখাবার চেষ্টা করলে ভারতীয় সেনাদলের পক্ষ থেকে সাফ বলে দেয়া হয় যে, বিলম্ব হলে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তাদের কচুকাটা করবে। গত্যন্তর না থাকায় আত্মসমর্পণে সম্মত হলেও তারা সেনানিবাসের মধ্যে তা সম্পন্ন করার কথা বলে। ভারতীয় দল রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ প্রকাশ্যে তা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড় থাকে। এসব যখন চলছিল, তখন জেনারেল মানেক শ’র পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির সময় বিকেল ৩টা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
একই দিন বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশ সময়) ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা- বিমান ও হেলিকপ্টার বহর নিয়ে অন্যান্য উচ্চ পদস্থ ভারতীয় সেনাকর্মকর্তাসহ ঢাকার পুরাতন এয়ারপোর্টে অবতরণ করেন। লে. জেনারেল নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, ভারতের মেজর জেনারেল জ্যাকব প্রমুখ জেনারেল আরোরা ও তাঁর দলকে অভ্যর্থনা জানাতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে চলে আসেন। মেজর জেনারেল নাগরা (ভারত)-র ওপর পূর্বেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই অনাড়ম্বর। একটি ছোট টেবিল এবং আরোরা ও নিয়াজীর বসার জন্য দুটি চেয়ার প্রথমে ভারতীয় ও পাকিস্তানি যৌথ একটি সেনাদল লে. জেনারেল আরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এরপর ‘আত্মসমর্পণের দলিল’ (Instrument of Surrender)-এ উভয় স্বাক্ষর করেন। নিয়াজী অশ্রুসিক্ত অবস্থায় তার ব্যাজ ও অন্যান্য সামগ্রী এবং কোমরের রিভলবার আরোরার হাতে তুলে দেয়। এভাবে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল আরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করে। অনুষ্ঠানস্থলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি উইং কমান্ডার ও মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। কর্নেল ওসমানী মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে অন্যত্র ছিলেন। তখন বিকেল ৪:৩০টা (ভারতীয় সময়)। অনুষ্ঠানকে ঘিরে রেসকোর্স ময়দানে বহু বিদেশী সাংবাদিক ও বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত কয়েক লক্ষ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। বাঙালি জাতির জীবনে এ এক ঐতিহাসিক ক্ষণ। ‘আত্মসমর্পণ দলিল’ বা (Instrument of Surrender)-এ যা বলা হয়-…
লক্ষণীয় যে, আত্মসমর্পণ দলিলে (এক) ভারতীয় ও বাংলাদেশ ফোর্সের যৌথ কমান্ডের কমান্ডারদের নিকট পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ, (দুই) ঢাকার বাইরে অন্যান্য স্থানে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী অনুরূপভাবে আত্মসমর্পণ করবে, (তিন) নির্দেশ অমান্য করলে আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ, (চার) আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেয়া, (পাঁচ) সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা বিধান, (ছয়) বিদেশী নাগরিক, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দেয়া ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৬-২২শে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের সর্বত্র পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ কার্যকর হয়। আত্মসমর্পণ দলিলে উল্লেখ না থাকলেও মুক্তিবাহিনীর আক্রোশ থেকে নিজেদের রক্ষার্থে ১৯শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা সেনানিবাসের পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্র রাখার অনুমতি লাভ করে। এরপর যুদ্ধবন্দি হিসেবে সকল পাকিস্তানি সৈন্য ও সরকারি উচ্চ পদস্থ বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। [হারুন- অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: Lt Gen JFR Jacob, Surrender at Dacca : Birth of a Nation, Dhaka, UPL 1997; Siddiq Saliq, Witness to Surrender, Dhaka, UPL 1997
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড