পাকিস্তানি সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তণ
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে (৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন)। বঙ্গবন্ধু হন মেজরিটি পার্টির নেতা। নতুন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচনোত্তর বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে তা ছিল লোক দেখানো। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আসল উদ্দেশ্য ছিল কোনো অবস্থায়ই বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা।
নির্বাচনের ফলাফল নস্যাৎ করতে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা তাদের পূর্বসুরিদের মতো ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নাম করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় সৈন্য ও অস্ত্র আনতে থাকে। অতঃপর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী <অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালিদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু ইপিআর-এর ওয়ারলেস মেসেজের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এদিকে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু-কে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদ-কে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ই এপ্রিল ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি সরকার গঠন করা হয়, যা মুজিবনগর সরকার- নামে সর্বমহলে পরিচিতি। দেশের প্রায় সর্বত্র পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং এপ্রিল মাসের ৩য় সপ্তাহ পর্যন্ত সীমান্তবর্তী এলাকা ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ অনেক এলাকা শত্রুমুক্ত রাখা সম্ভব হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঐসব এলাকায় অনুপ্রবেশ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। জুলাই মাস পর্যন্ত কমবেশি এ অবস্থা বহাল থাকে।
মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ, তাঁদের ট্রেনিং এবং মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিত করে শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের সময়। এমনি অবস্থায় জুলাই মাসের শেষের দিকে ইয়াহিয়ার জান্তা সরকার সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ, এরপর মিয়ানওয়ালী জেলে বন্দি করে রাখা হয়। অতঃপর ১১ই আগস্ট পাঞ্জাবের লায়ালপুরের একটি সার্কিট হাউজে একজন ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে গঠিত ৩ সদস্যের সামরিক আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর কিছু পূর্বে ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান এবং ২৬শে মার্চ পাকিস্তানিদের উদ্দেশে রেডিও ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর বিচার সম্পর্কে তার ঐ ভাষণে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। তিনি অভিযোগ করেন যে, মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে পাল্টা সরকার পরিচালনা, পাকিস্তানের পতাকা ও পাকিস্তানের জাতির জনকের প্রতি চরম অবমাননা এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার করে পাকিস্তানের দুই অংশের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে মুজিব ও তাঁর দল কার্যত পাকিস্তানের অখণ্ডত্বের মূলে আঘাত হানে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণা করে ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘মুজিব এবং তাঁর দল পাকিস্তানের শত্রু এবং এই অপরাধ বিনাবিচারে যাবে না৷
৫ই আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগ এনে বলা হয় যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় তারা সশস্ত্র পন্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার একটি গোপন পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সে লক্ষ্যে ২৫শে মার্চ মুজিব কর্নেল ওসমানীকে ‘বিপ্লবী সেনাবাহিনীর কমান্ডার’ হিসেবে নিয়োগ দান করেন। শ্বেতপত্রে এও অভিযোগ করা হয় যে, মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার টিমের সঙ্গে আলোচনাকালে মুজিব ও তার দল ‘প্রকারান্তরে স্বাধীনতা আদায়ের চেষ্টা করে।’
প্রায় কাছাকাছি সময়ে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে নিজস্ব উদ্যোগে তার সচিব মাহবুবুল আলম চাষী, কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী, আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমএনএ কাজী জহিরুল কাইয়ুম প্রমুখের গোপনে আমেরিকান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল, আমেরিকার সহযোগিতায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ সংকটের ফেডারেল বা কনফেডারেল জাতীয় সমাধান, বিনিময়ে পাকিস্তানে বন্দি অবস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি। তাদের পক্ষ থেকে এসময় প্রচার করা হয়েছিল, ‘তোমরা বঙ্গবন্ধুকে চাও, না স্বাধীনতা চাও?’ একই মহল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে এক প্রকার সমঝোতার গুজব ছড়ানো হয়। বিষয়টি অবহিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার-এর অন্যান্য সদস্য বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়।
পাকিস্তানের সামারিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচারের আয়োজনের খবর পূর্বেই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ফলে বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসী বাঙালি, বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, পার্লামেন্ট সদস্য, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, গণমাধ্যম সর্বত্র প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের উচ্ছেদ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দুটিই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য এবং সে লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চলবে। যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের স্থায়ী প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরী ঘোষণা করেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তাহানি কিংবা কোনও প্রকার ক্ষতি হলে বাঙালী জাতি কোনও দিন পাকিস্তানকে ক্ষমা করতে পারবে না। ক্ষমা শব্দটি বাঙালী চিরদিনের মতো ভুলে যাবে।’
১লা আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগর স্কোয়ারে পল কনেট-এর নেতৃত্বাধীন Action Bangladesh-এর উদ্যোগে ২০ হাজার লোকের যে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যসহ সকল বক্তা পাকিস্তানের প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিচারের আয়োজন অনতিবিলম্বে বন্ধ করে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান। ১১ই আগস্ট লন্ডনের হাইডপার্কে অপর একটি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্রিটেনের সর্বত্র থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি যোগ দেয়। সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আঞ্চলিক একশন কমিটি ও এর স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যবৃন্দ বক্তৃতা করেন। বক্তারা বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। সমাবেশ শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের স্লোগান ছিল ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘বিচার প্রহসন বন্ধ কর’, ‘গণহত্যা বন্ধ কর’ ইত্যাদি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী ও এমপি জন স্টোনহাউজ, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শোর, মাইকেল বার্নস, ব্রুস ডগলাস-ম্যান প্রমুখ শোভাযাত্রার অগ্রভাগে ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের সিদ্ধান্তক্রমে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তানে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকার্যে তাঁর পক্ষে আইনি সহায়তা দানের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইরিশ আইনজীবী শন ম্যাকব্রাইড-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সম্মতি গ্রহণ করেন। লন্ডনের বার্নার্ড শেরিডান সলিসিটার্স প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ আইনজীবী লেবার পার্টির এমপি স্যার ও টমাস উইলিয়াম কিউসি-ও তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকতে সম্মত হন। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে তাঁরা পাকিস্তানের ইসলামাবাদ গিয়ে পৌঁছান। তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎকারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও তাঁদের সাক্ষাৎকার দানে অসম্মতি জানান। সামরিক কর্তৃপক্ষ থেকে এও বলা হয় যে, কোনো বিদেশী আইনজীবীকে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়া হবে না। সামরিক কর্তৃপক্ষের এ আচরণ গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এসময় বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কতিপয় বক্তব্য-মন্তব্য বাঙালিদের প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ করে। ৭ই আগস্ট The Sunday Times (London) পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘শেখ মুজিব সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। কিন্তু আগামীকাল তিনি বেঁচে থাকবেন কী না তা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। তার মানে এই নয় যে, আমি তাকে আগামীকাল গুলি করে হত্যা করবো।’ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। রাজধানী ঢাকা শহরে পর্যন্ত শত্রু অবস্থানের ওপর গেরিলারা একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যান। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত The Sunday Times, The Guardian, The Times, The Financial Times, The Observer, The Daily Telegraph, Morning Star এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত The New York Times, International Herald Tribune, The Washington Post, Newsweek ইত্যাদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী পত্র-পত্রিকায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারের তীব্র সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লেখা হয়। প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় বিবিসি-র মতো শক্তিশালী গণমাধ্যম। এসময় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখা ছাড়াও তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য, আমেরিকার কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্ট সদস্য, সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচারে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান।
৬ই আগস্ট ভারতীয় পার্লামেন্টের ৪৬৭ জন সদস্য জাতিসংঘ মহাসচিবের নিকট আশু হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটির ডেমোক্রেটিক দলীয় চেয়ারম্যান ফুলব্রাইটসহ ১১ জন সিনেটর তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট একটি তারবার্তা পাঠান। প্রায় একই সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দুশ জনেরও অধিক সদস্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
যেসব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর বিচারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকারের নিকট বার্তা পৌঁছান, সেসব দেশের মধ্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া ও ভিয়েতনাম উল্লেখযোগ্য। ১১ই আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী – বিশ্বের ২৪টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট বঙ্গবন্ধুর প্ৰাণ রক্ষার আবেদন জানিয়ে বার্তা প্রেরণ করেন। জাতিসংঘের মহাসচিব ইউ থান্টও
বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্ৰকাশ করেন। বিচারের রায় কার্যকর না করার জন্য এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি অনুরোধ জানায়
প্রহসনমূলক বিচারে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ সেদেশের আইনজীবী এ কে ব্রোহী-কে একতরফাভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থনে নিয়োগ দান করে। ন্যায় বিচার পাবেন না জেনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি জান্তা সরকারের দেয়া আইনি সহায়তা গ্রহণে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। সামরিক আদালত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের ২০ জন তথাকথিত সাক্ষীর বক্তব্য গ্রহণ করে। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে প্রহসনমূলক বিচারকার্য সম্পন্ন হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে দোষী সাব্যস্থ করে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ঐ রায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট প্রেরণ করা হয়। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে কবর খনন করা হয়। কিন্তু দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে।
অক্টোবর মাস থেকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচার অনুষ্ঠান ও বিচারের রায়ের ব্যাপারে বিশ্বজনমতের তীব্র প্রতিক্রিয়া, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় কার্যকর না করার অনুরোধ, ৩রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, মাত্র ১৩ দিনের ব্যবধানে জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণ, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়, ভারত কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানের বহু এলাকা দখল, ২০শে ডিসেম্বর পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সেদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে শপথ গ্রহণ ইত্যাদি কারণে ইয়াহিয়ার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ভুট্টো দায়িত্ব গ্রহণের পরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন না হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কোনোরূপ বন্ধন টিকিয়ে রাখা যায় কিনা সে বিষয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন। ভুট্টোর সামনে তখন প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বন্দি ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে দেশে ফেরত আনা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এলাকাসমূহ ভারতের দখলমুক্ত করে নিজের অবস্থান সুসংহত করা। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদান ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ৮ই জানুয়ারি (রাতের প্রথম প্রহরে) ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার ক্লারিজেস হোটেলে তাঁর অবস্থানের ব্যবস্থা করে। একই দিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। লন্ডনে একটি দিন তাঁর সংবাদ সম্মেলন সহ বিভিন্ন কর্মব্যস্থতায় কাটে। ৯ই জানুয়ারি সকালে (স্থানীয় সময়) তিনি ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের বিমানে লন্ডন থেকে যাত্রা করে সাইপ্রাসে কয়েক ঘন্টার জন্য যাত্রাবিরতি শেষে ১০ই জানুয়ারি সকালে দিল্লি পৌঁছেন। সেখানে বিমান বন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকারের মন্ত্রিবর্গ তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দ্বি- পাক্ষিক একান্ত বৈঠক শেষে পুনরায় একই বিমানযোগে যাত্রা করে দুপুরের কিছু পর তিনি তাঁর প্রিয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তণ করেন। তেজগাঁও বিমান বন্দরে তাঁকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়। এরপর তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে অশ্রুসিক্ত নয়নে এক মর্মস্পর্শী ভাষণ রাখেন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, লন্ডন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৮৯; আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০; শেখ আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান, ঢাকা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স ১৯৯৮; Bangladesh Documents, Ministry of Foreign Affairs, India; The Times (London), 6 August 1971; The Guardian, 6 August 1971; Henry Kissinger, The White House Years, Boston, Little Brown and Company 1979; ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার, ধানমন্ডি (ঢাকা), ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু : রাজনীতি ও প্রশাসন, ঢাকা ১৯৯৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড