You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.10 | পাঁচদোনা যুদ্ধ (নরসিংদী সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

পাঁচদোনা যুদ্ধ (নরসিংদী সদর)

পাঁচদোনা যুদ্ধ (নরসিংদী সদর) সংঘটিত হয় তিনবার – ১০ই এপ্রিল, ১৬ই আগস্ট এবং ১০ই অক্টোবর। প্রথমবার যুদ্ধের পর পাকসেনারা নরসিংদী সদরে প্রবেশ করে। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে ৭-৮ জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কয়েক জন আহত হয় এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন আহত হন। তৃতীয়বারের যুদ্ধে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন আহত হন।
২৫শে মার্চ ঢাকায় আকস্মিক হামলায় বিপর্যস্ত কয়েকজন বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক কোনোরকমে আত্মরক্ষা করে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (পরে ব্রিগেডিয়ার)-এর নেতৃত্বে সামান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৩১শে মার্চ নরসিংদী পৌঁছান এবং মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম- (পরে মেজর জেনারেল ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান)-এর নির্দেশে তাঁরা নরসিংদী সদরে আসেন। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ৮ই এপ্রিল ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বাগবাড়ি-কড়ইতলা নামক স্থানে প্রতিরোধব্যূহ রচনা করেন। পরের দিন হানাদার বাহিনী নরসিংদীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করলে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মেশিনগান গর্জে ওঠে। এদিন দুপুরের আগে যুদ্ধ শুরু হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে পাল বাড়িতে গিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেন। অন্যদিকে বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় পাকবাহিনীও রাতের অন্ধকারে পশ্চাদপসরণ করে। পরের দিন ১০ই এপ্রিল দুপুরের দিকে পাকবাহিনী মর্টার, রকেট শেল ও মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৫-১৬টি ট্রাক নিয়ে মাধবদী-বাবুরহাট পার হয়ে পাঁচদোনা মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছলে পাল বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অগ্রবর্তী দল তাদের ওপর অতর্কিতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। বিকেল অবধি মরণপণ যুদ্ধ করেও পাকবাহিনী সামনে এগুতে ব্যর্থ হয়ে বাবুরহাটের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। পরে ঢাকা থেকে আরো সৈন্য এনে শক্তি বৃদ্ধি করে তারা পুনরায় নরসিংদী অভিমুখে অগ্রসর হয়। সীমিত শক্তি নিয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর ইপিআর বাহিনীর গোলাগুলি শেষ হয়ে যায়। ফলে রাতের অন্ধকারে বাধ্য হয়ে মুক্তিবাহিনীকে অবস্থান ত্যাগ করতে হয় এবং পাকবাহিনী নরসিংদী দখল করে নেয়। নরসিংদীতে প্রবেশ করে তারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে তাদের প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে। এই প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ছুটিতে আসা নৌসৈনিক নেহাব গ্রামের সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ওরফে ন্যাভাল সিরাজ এবং ১২ জন ইপিআর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের সঙ্গে ছিল মাত্র ১টি মর্টার, ২টি মেশিনগান এবং কিছু রাইফেল ও ট গোলাগুলি। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর বেশকিছু সৈনিক হতাহত হয় এবং তাদের ট্রাক বহরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর ১ জন সৈন্য আহত হয়। এ-যুদ্ধের খবর আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ফলাও করে প্রচার করা হয়।

দ্বিতীয় যুদ্ধ
নেহাব গ্রামের মালেক মেম্বারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টারর্স ছিল। ১৬ই আগস্ট সোমবার সকাল ১১টার দিকে হঠাৎ সিরাজ উদ্দিন আহমেদ থানা কমান্ডার মুহম্মদ ইমাম উদ্দিনকে বললেন সবাইকে ফল ইন করাতে। নির্দেশ পেয়ে ক্যাম্পের সবাই ফল ইনে দাঁড়িয়ে যান। এরপর সিরাজ উদ্দিন বলেন এখনই যুদ্ধে যেতে হবে এবং যুদ্ধ পরিচালনা করবেন ইমাম উদ্দিন। যুদ্ধের স্থান পাঁচদোনা ব্রিজ। কমান্ডার ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রথম গ্রুপ অবস্থান নেয় পাঁচদোনা মোড়ের পশ্চিম পাশের বটতলায়। এ গ্রুপে ছিলেন কালাম, তাজু, হান্নান, নূরে আলম, আজিজ ও নুরুল ইসলাম। এঁদের কাছে ছিল জিনারদীর যুদ্ধ থেকে সংগৃহীত এলএমজি ও রাইফেল। দ্বিতীয় গ্রুপ ছিল ব্রিজের পূর্বপাশে শীলমান্দি বাস স্ট্যান্ডের দক্ষিণে বাঁশঝাড়ের নিচে। এ গ্রুপে ছিলেন সুলতান, জামাল, মান্নান, সমর কষ্টা, অলি উল্লাহ, বাদশা ও সাজাহান। এঁদের কাছে ছিল একটি স্টেনগান ও রাইফেল।
তৃতীয় অর্থাৎ কমান্ডার ইমামের গ্রুপটি ছিল ব্রিজের কাছাকাছি ঠিক উত্তর পাশে শ্মশানখোলায়। এ গ্রুপে ছিলেন তোরাব, কবির, লতিফ ও আতাউর রহমান। কমান্ডার ইমামের কাছে একটি স্টেনগান এবং অন্যদের কাছে ছিল রাইফেল। এ গ্রুপের কিছু পেছনে মর্টার শেল নিক্ষেপের জন্য হাকিম ও ইব্রাহিমকে নিয়োগ করা হয়।
সিদ্ধান্ত হয় দুপুর ১টায় যুদ্ধ শুরু হবে। পশ্চিম দিকের গ্রুপ প্রথমে গুলি ছুড়বে। ১০ মিনিট পর পূর্ব দিকের গ্রুপ এবং ঐ দুই গ্রুপের গুলি ছোড়ার ফলে হানাদারদের অবস্থান পর্যবেক্ষণের পর কমান্ডারের গ্রুপ যুদ্ধ শুরু করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক ১টায় ত্রিমুখী যুদ্ধ শুরু হয়। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকবাহিনী আর্তচিৎকার করতে থাকে। এমতাবস্থায় তাদের প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ব্রিজের নিচে ফেলতে শুরু করে। ঠিক তখনই নরসিংদী ও মাধবদী থেকে হানাদারদের অতিরিক্ত সৈন্য ও অস্ত্রভর্তি দুটি গাড়ি এসে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে থাকে। ফলে এ-যুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ সফলতা লাভ করা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৭-৮ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন সৈন্য আহত হয়। গুলিতে আহত হন কমান্ডার ইমামের সহকারী আতাউর রহমান ও সুলতান।
মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসছিলেন, তখন পথিমধ্যে সিরাজ উদ্দিন আহমেদ আবার যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয় এবং যুদ্ধ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিন্তু এতে কোনো ফললাভ হয়নি। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কিছুটা মূল্য দিতে হয়। মৈশাসুরার হারুন ও কান্দাপাড়ার মোতালেব শহীদ হন এবং তোরাব মাস্টার ও বৈলাইনের নুরুল ইসলাম আহত হন। এ-যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী পাঁচদোনা বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বাজারটি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে যায়।

তৃতীয় যুদ্ধ
পাঁচদোনা ব্রিজে সংঘটিত তৃতীয় যুদ্ধ ছিল সিরাজ উদ্দিন আহমেদের এক দুঃসাহসিক অভিযান। তিনি মাত্র কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে অতর্কিতে পাকবাহিনীর পাঁচদোনা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। ১০ই অক্টোবর সন্ধ্যায় তিনি সঙ্গীদের নিয়ে অতি সন্তর্পণে ক্যাম্পের প্রায় কাছে গিয়ে প্রথমে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন এবং পরে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। পাকবাহিনী প্রথমে কিছুটা হতচকিত হলেও পরক্ষণেই পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে সিরাজ উদ্দিন ও তাঁর সঙ্গীরা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ-যুদ্ধে নেহাব গ্রামের আঞ্জত আলী শহীদ এবং বেলাবর আশ্রব আলী বুইট্রা, নেহাবের লতিফ, আসমান্দির চরের ওসমান ও মৈশাসুরার তোফাজ্জল আহত হন। [মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড