You dont have javascript enabled! Please enable it! গেরিলা সংগঠন পলাশডাঙ্গা যুবশিবির (উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

পলাশডাঙ্গা যুবশিবির (উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ)

পলাশডাঙ্গা যুবশিবির (উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ) একটি গেরিলা সংগঠন। মে মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জা (পিতা মীর্জা মিনহাজউদ্দিন)-র নেতৃত্বে বঙ্কিরাট গ্রামে এটি গড়ে ওঠে। আব্দুল লতিফ মির্জা ১৯৪৭ সালের ২৫শে জুন জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি সিরাজগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র এবং ছাত্রলীগ এর নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এবং তাঁর কয়েকজন সহপাঠী এই বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাভূত করে পলাশী যুদ্ধের (১৭৫৭) কলঙ্ক মোচন করবেন। এ লক্ষ্য ও আদর্শ থেকেই সংগঠনের নামকরণ করা হয় পলাশডাঙ্গা যুবশিবির। উত্তরবঙ্গের ‘লাল সূর্য’ বলে খ্যাত আব্দুল লতিফ মির্জা বৃহত্তর পাবনার চাটমোহর, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ ও শাহজাদপুর থানার প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যেতে ব্যর্থ যুবকদের নিয়ে দেশের ভেতরই পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিহত করার শপথ নেন। এছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ছুটিতে ও পালিয়ে আসা, অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, জেল থেকে পালিয়ে আসা কয়েদি এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত তরুণদের নিয়ে এ গেরিলা সংগঠন গড়ে ওঠে। পুরানো হাতিয়ার এবং শত্রুর কাছ থেকে হস্তগত অস্ত্রের সাহায্যে প্রতিরোধ যোদ্ধা থেকে এ বাহিনী ধীরে-ধীরে গেরিলা যোদ্ধায় পরিণত হয়। আব্দুল লতিফ মির্জা সর্বাধিনায়ক, এ কে এম খায়রুজ্জামান গেদু মিয়া (হান্ডিয়াল, চাটমোহর) ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সেনা সদস্য লুৎফর রহমান অরুণ (রংপুর) যুদ্ধ-বিষয়ক উপদেষ্টা, আব্দুল আজিজ মির্জা অর্থ-উপদেষ্টা, আব্দুল বাকী মির্জা সহকারী অর্থ- উপদেষ্টা, আসাদুর রহমান (মাদার বাড়িয়া, ভাঙ্গুড়া) শেল্টার কমান্ডার, মো. গোলজার হোসেন (হান্ডিয়াল) পরিচালক মণ্ডলীর সদস্য হিসেবে এ বাহিনীর দায়িত্ব পালন করেন। অধিনায়ক আব্দুল লতিফ মির্জা বাহিনীকে ৬টি প্লাটুন ও ১৯টি সেকশনে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্লাটুনে প্রায় একশ জন গেরিলা ছিলেন। প্রতিটি প্লাটুন একজন প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) দ্বারা পরিচালিত হতো। সাধারণত প্রাক্তন সেনা সদস্যরা প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন। একজন প্লাটুন কমান্ডারের অধীনে একাধিক সেকশন ছিল। ২৫-৩০ জন গেরিলা নিয়ে একটি করে সেকশন গড়ে উঠেছিল। সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব ছিল তার নিজ এলাকার রাজাকার ও পাকসেনাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা এবং সুযোগ বুঝে রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করা।
আব্দুল লতিফ মির্জার যুদ্ধকালীন সময়ে ছদ্মনাম ছিল স্বপন বাবু। তাড়াশ থানার মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের মো. আমজাদ হোসেন এবং চাটমোহর থানার হান্ডিয়াল ইউনিয়নের খায়রুজ্জামান গেদু মিয়া (এফএফ) ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে ২৮ জনের গেরিলা দল নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরে যোগ দেন। ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হান্ডিয়াল ইউনিয়নের আরেকজন গেরিলা কমান্ডার মো. গোলজার হোসেনও এ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। খায়রুজ্জামান গেদু মিয়া এবং গোলজার হোসেন নওগাঁ, হান্ডিয়াল ও শীতলাই জমিদারের পরিত্যক্ত বাড়িতে গেরিলাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। গেদু মিয়া এ বাহিনীর উপ-অধিনায়কের পদ গ্রহণ করেন। লুৎফর রহমান অরুণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি পলাশডাঙ্গা বাহিনীর গেরিলা সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতেন এবং গেরিলা আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরি করতেন। আব্দুল আজিজ মির্জা ও আব্দুল বাকী মির্জা ছিলেন সহোদর এবং অধিনায়ক আব্দুল লতিফ মির্জার চাচা। তাঁরা জনগণের কাছ থেকে অর্থ ও রসদ সংগ্রহ করতেন। স্থানীয় জনগণ সেচ্ছায় তাঁদের খাবার সরবরাহ করত। তবে মুসলিম লীগ-এর নেতাদের নিকট থেকে অনেক সময় বল প্রয়োগ করে অর্থ সংগ্রহ করা হতো। আসাদুর রহমান নতুন গেরিলা ভর্তি এবং ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতেন।
পলাশডাঙ্গা গেরিলা সংগঠনের স্থায়ী কোনো প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল না। এ বাহিনীর কর্মকাণ্ড ছিল বৃহত্তর পাবনার তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও চাটমোহর থানার দুর্গম এলাকায়। সংগঠনটি এসব এলাকায় অসংখ্য অস্থায়ী প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলে। ব্যাপক জনসমর্থন থাকায় জুন মাসের মধ্যেই এ বাহিনী এশটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত হয় এবং আগস্ট মাসে এসে এ বাহিনীর গেরিলা সংখ্যা ৩৭৫ জনে উন্নীত হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পলাশডাঙ্গা গেরিলা সংগঠনের সদস্য সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে যায়।
প্রথমদিকে পলাশডাঙ্গা বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল রাজাকারদের ক্যাম্পগুলো। জুলাই মাস থেকে তাঁরা রাজাকার ও পাকবাহিনীর ওপর সর্বাত্মক গেরিলা আক্রমণ শুরু করেন। এ বাহিনী সর্বপ্রথম সিরাজগঞ্জের নিকট বাওয়ানজানি রেল ব্রিজে পাহারারত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করে। আক্রমণে রাজাকাররা ভয়ে পালিয়ে যায় এবং ৭-৮টি রাইফেল ও কিছু গুলি তাঁদের হস্তগত হয়। অধিনায়ক আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের শতাধিক সদস্য কামারখন্দ থানার ভদ্রঘাট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধে সংগঠনের একজন সদস্য শহীদ হন। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি আনসার এডজুট্যান্ট আব্দুর রহমান এবং মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে এ বাহিনীর প্রায় দুশতাধিক গেরিলা যোদ্ধা তাড়াশ থানা আক্রমণ করেন। আক্রমণে থানায় অবস্থানরত পুলিশরা পলায়ন করে এবং ১০-১২টি অস্ত্র ও বেশকিছু গোলাবারুদ গেরিলাদের হস্তগত হয়। আগস্ট মাসের শেষদিকে পলাশডাঙ্গা বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা গুরুদাসপুর থানার কাছিকাটা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে ৫-৬ জন রাজাকার প্রাণ হারায় এবং ৫-৬টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এ সংগঠনের প্রায় দেড়শ গেরিলা গুরুদাসপুর থানা আক্রমণ করেন। থানায় অবস্থানরত পুলিশ বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে থানায় রক্ষিত ১০-১২টি রাইফেল ও গোলাবারুদ নিয়ে তাঁরা নিরাপদে ফিরে আসেন।
পলাশডাঙ্গা বাহিনীর একের পর এক সাফল্য রাজাকার ও পাকবাহিনীকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। তারা পলাশডাঙ্গা বাহিনীকে নির্মূল করার সংকল্প গ্রহণ করে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে পাকসেনারা রাজাকারদের সহায়তায় ব্রহ্মগাছায় (সিরাজগঞ্জ সদর থানা) অবস্থানরত পলাশডাঙ্গা বাহিনীর গেরিলাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। কিন্তু এলাকার লোকদের সার্বিক সহযোগিতায় গেরিলারা অতি সহজেই আত্মগোপন করতে সক্ষম হন।
অক্টেবরের শেষদিকে পলাশডাঙ্গা বাহিনীর ৮-১০ জন গেরিলা কামারখন্দ থানার বেইলি ব্রিজ আক্রমণ করেন। মাত্র পাঁচ মিনিটের যুদ্ধে ৫-৬ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭-৮ টি রাইফেল গেরিলাদের হস্তগত হয়।
নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে পলাশডাঙ্গা বাহিনী রাত ১২টার দিকে সলঙ্গা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান আলী (পিতা বরাত আলী সরকার, বনবাড়িয়া)-সহ ৫-৭ জন রাজাকার নিহত হয়।
ক্যাম্পের অপর শীর্ষ রাজাকার চৌপাকীয়া গ্রামের খোকা পালিয়ে প্রতাপ হাটে আশ্রয় নেয়। কিন্তু যুবশিবিরের গেরিলারা তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে। পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের সাফল্যে উল্লাপাড়া, তাড়াশ ও চাটমোহর থানার রাজাকাররা ভীত হয়ে পড়ে। ৮ই নভেম্বর অধিনায়ক আব্দুল লতিফ মির্জার নিকট প্রাণ বাঁচানোর জন্য পলাশডাঙ্গা বাহিনীর প্রধান কেন্দ্র নওগাঁয় ১৪৭ জন রাজাকার ১৪৪টি অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। ১১ই নভেম্বর পাকসেনাদের সঙ্গে এ বাহিনীর নওগাঁ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নওগাঁ যুদ্ধে ১৩০ জন পাকসেনা, শতাধিক মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয় এবং ক্যাপ্টেন সেলিম মাহমুদসহ ৯ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। কমান্ডার গোলজার হোসেনের নেতৃত্বে এ বাহিনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ১৩ থেকে ২০শে ডিসেম্বর চাটমোহর থানা আক্রমণ করেন। আক্রমণে ১৪ই ডিসেম্বর থানায় অবস্থানরত পাকসেনা অফিসার শের আফগানসহ ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২০শে ডিসেম্বর থানায় অবস্থানরত ২২ জন মিলিশিয়া আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে চাটমোহর থানা শত্রুমুক্ত হয়।
দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পলাশডাঙ্গা গেরিলা সংগঠনের সদস্যরা ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ত্র সমর্পণ করে স্ব-স্ব এলাকায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। অধিনায়ক আবদুল লতিফ মির্জা সিরাজগঞ্জেই থেকে যান। তিনি ১৯৭৯ এবং ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৭ সালের ৫ই নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নামে উল্লাপাড়া বিজ্ঞান কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশন থেকে মাছুমপুর পর্যন্ত সড়কের করা হয়েছে আবদুল লতিফ মির্জা সরণি। মুক্তিযুদ্ধে তাড়াশ উপজেলায় পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের অবদান এবং উত্তরবঙ্গের অন্যতম গেরিলা যুদ্ধের (নওগাঁ যুদ্ধ) স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নওগাঁয় ‘পলাশডাঙ্গা যুবশিবির নওগাঁ’, ‘তাড়াশ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ’ এবং উল্লাপাড়ায় আবদুল লতিফ মির্জা ও গাজী ম. ম. আমজাদ হোসেন মিলনের প্রতিকৃতিসহ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [মো. ছাবেদ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড