পশুর নদীতে নৌকমান্ডো অভিযান (মংলা, বাগেরহাট)
পশুর নদীতে নৌকমান্ডো অভিযান (মংলা, বাগেরহাট) পরিচালিত হয় চারবার ১৫ই আগস্ট, ৮ই অক্টোবর, ৯ই অক্টোবর এবং ২৪শে নভেম্বর। এতে প্রতিদিন ৫টি করে মোট ২০টি জাহাজ ডুবে যায়, যা ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য এক বিরাট সাফল্য।
পাক সরকারকে অচল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন বন্দরে নোঙর করা পাকিস্তানি জাহাজ, এমনকি বিদেশী জাহাজগুলোও ডুবিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। এজন্য ১৪ই আগস্ট থেকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নদীবন্দর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত করা হয়। এ উদ্দেশ্যে সাবমেরিনার আহসান উল্লাহর নেতৃত্বে ৪৬ জনের একটি নৌকমান্ডো দল আগস্ট মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ দলের সদস্যরা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
প্রথম অভিযান
৫ই আগস্ট সকালে প্রয়োজনীয় যুদ্ধসরঞ্জাম ও শুকনো খাবারসহ দলটিকে ভারতের ক্যানিং বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য রওনা করেন। পলাশীর প্রশিক্ষক লে. কপিল তাঁদের বিদায় জানান। নৌকমান্ডোদের প্রত্যেকের কাছে দুটি করে গ্রেনেড ও একটি করে লিমপেড মাইন দেয়া হয়। দলটির সঙ্গে ছিল ৯টি এসএলআর, ১ ব্যান্ডের দুটি রেডিও, এক্সপ্লোসিভ কম্পাস, ঘড়ি, করটেক্স, ডেটনেটর, এন্টি পার্সেনাল মাইন, সেফটি ফিউজ ইত্যাদি অস্ত্র ও সরঞ্জাম।
দলটিকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তার মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর জন্য মেজর জলিল ইতঃপূর্বে ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর) জিয়াউদ্দীনের নেতৃত্বে আরো একটি বাহিনীকে সুসজ্জিত করে রেখেছিলেন, যার সদস্য সংখ্যা ছিল দুশতাধিক। কমান্ডোরা ৬টি নৌকায় এবং জিয়াউদ্দীনের বাহিনী ১০টি নৌকায় করে ৬ই আগস্ট সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। মোট ১৬টি নৌকার বিশাল বহরের গাইড ছিলেন পারেরহাটের রয়েজউদ্দিন পশারী।
যাত্রার পরপরই সামুদ্রিক ঝড়ের আশঙ্কা দেখা দিলে নৌকাগুলো ছোট-ছোট খালের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেলে পুনরায় সেগুলো চলতে শুরু করে এবং ৮ই আগস্ট কয়লা বেহালা বা পুটনি আইল্যান্ড নামক একটি দ্বীপে পৌঁছায়। সেখানে কমান্ডোরা রাত্রিযাপন করেন। ত্রিকোন আইল্যান্ডের কাছে নীল কমলের নিকট দলটি দুভাগে ভাগ হয়ে ৩৪ জন কমান্ডো এবং তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষীসহ একটি দল মংলার দিকে রওনা হয়ে যায়। বাকি ১২ জন জিয়াউদ্দীনের দলের সঙ্গে আড়াই বাকি ক্যাম্পে চলে যান। বড় দলটি ১৩ই আগস্ট বিকেলের মধ্যেই মংলার কাছাকাছি খুলনা জেলার দাকোপ থানার সুতারখালী গ্রামে পৌঁছায়। খিজির আলী, মো. আনোয়ার হোসেন খান এবং আফজাল হোসেন তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। পরের দিন তাঁরা মংলার আরো কাছে কৈলাশগঞ্জের একটি পরিত্যক্ত হিন্দুবাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলেন।
কমান্ডোদের আগে থেকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, ১৩ই আগস্ট থেকে ১৫ই আগস্টের মধ্যে আকাশবাণী কলকাতার খ কেন্দ্র থেকে প্রথমে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম গান’টি বাজানো হবে। এটি হবে প্রস্তুতি গ্রহণের সংকেত। এরপর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ ১৪ই আগস্ট সকালে বাজানো হবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আমার পুতুল আজকে যাবে প্রথম শ্বশুর বাড়ি’ গানটি। ১৪ই আগস্ট সকাল সাড়ে সাতটায় দ্বিতীয় গানটি বাজানো হয়। কমান্ডোরা ঐদিন রাত ১২টার দিকে মংলার পশুর নদী ও অপর পারে বানিশান্ত নামক গণিকা পল্লিকে অপারেশনের জন্য মনোনীত করেন এবং রাত দুটার দিকে অপারেশনের সময় নির্ধারণ করেন।
১৫ই আগস্ট প্রথম প্রহরে সুন্দরবনের পথে স্রোতের বিপরীতে নৌকা চালিয়ে আসার জন্য কমান্ডোরা কিছুটা বিলম্বে গণিকা পল্লিতে পৌঁছান। পল্লির মেয়েরা পোশাকহীন এ বাহিনীকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। তখন কমান্ডার খিজির আলী, আফজাল হোসেন এবং মো. আনোয়ার হোসেন তাদের আশ্বস্ত করেন। মংলা বন্দর মসজিদ থেকে যখন আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল ঠিক তখনই পায়ে ফিন পরে, গামছা দিয়ে মাইন ও এক্সপ্লোসিভ বুকের সঙ্গে বেঁধে এবং কোমরে ড্যাগার গুঁজে ৩৪ জন কমান্ডো ৮টি দলে ভাগ হয়ে ৮টি বাণিজ্যিক জাহাজে মাইন পেতে আসার জন্য পশুর নদীতে ঝাঁপ দেন। তারপর সকলে নিরাপদে তীরে এসে পৌঁছানোর পর সকাল ছটার দিকে একে-একে মাইনগুলো বিস্ফোরিত হয়। একই সঙ্গে গর্জে ওঠে বানিশান্তায় অবস্থানরত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের এলএমজি। প্রচণ্ড শব্দে নিকটবর্তী পাকবাহিনীর গানবোটগুলো ভয় পেয়ে সুন্দরবনের দিকে ছুটে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলো গতি পরিবর্তন করে ফিরে এসে বানিশান্তার দিকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এর আগেই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে পাকবাহিনীর আওতার বাইরে চলে যান। মাইনের আঘাতে ঐদিন পাঁচটি জাহাজ নদীতে ডুবে যায়। মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজ S S Lightning আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খুলনার শিপইয়ার্ডে এটি মেরামত করা হলেও পরবর্তীকালে আবার তা কমান্ডোদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। কমান্ডোদের গেরিলা আক্রমণের পর পাকবাহিনী বানিশান্তা গ্রামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। গণিকা পল্লিকে সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়। কয়েকজন বৃদ্ধা ও শিশুকে হত্যা করে এবং কয়েকজন তরুণী যৌনকর্মীকে গানবোটে তুলে নিয়ে যায়।
দ্বিতীয় অভিযান
১৫ই আগস্টের অভিযানের পর পাকবাহিনী মংলা বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। রাতে মাল খালাস নিষিদ্ধ করা হয় এবং সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এছাড়া পশুর নদীর পশ্চিম তীর থেকে যাতে কমান্ডোরা আসতে না পারে সেজন্য এপি মাইন ও রুবি ট্রাপ পেতে রাখা হয় এবং নদীর কিনার বরাবর পানির নিচে বাঁশ পুঁতে তার আগা কলমের মতো ধারালো করে কেটে রাখা হয়। এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ১২ই সেপ্টেম্বর কমান্ডোদের আরেকটি দল মংলা বন্দর আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ২৪ জন কমান্ডো নিয়ে বদিউল আলম এদিন পশ্চিমবঙ্গের পলাশী থেকে রওনা হয়ে বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে আসেন। সেখানে তিনদিন অবস্থানের পর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় বশিরহাট শহরের অদূরে বাগুনদিয়ায়। সামছুল আরেফিনের নেতৃত্বে ৪০ জন গেরিলার আরেকটি দলকে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত করে হাসনাবাদ ও হিঙ্গলগঞ্জের পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। তাঁরা ইছামতি নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং বিভিন্ন পথ ঘুরে কৈলাশগঞ্জে এসে ক্যাম্প স্থাপন করেন।
৮ই অক্টোবর বদিউল আলম, শামছুল আরেফিন এবং খিজির আলী কৈলাশগঞ্জ ক্যাম্প থেকে মংলা বন্দর রেকি করতে যান। রেকি করে তাঁরা জানতে পারেন যে, বন্দরের ১নং বয়া থেকে ১০নং পর্যন্ত মোট ৮টি জাহাজ অবস্থান করছে। তার মধ্যে ৬টিকে টার্গেট করে কমান্ডোবাহিনী নিরাপত্তাবাহিনীসহ মংলার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কমান্ডোগণ যাতে নদীর কিনারে পাতা মাইনফিল্ডের আওতার মধ্যে না পড়েন, সেজন্য তাঁদের লাউডোব নদী দিয়ে পশুর নদীতে নামিয়ে দেয়া হয়। যথাসময়ে জাহাজে মাইন লাগিয়ে তাঁরা একই পথে ফিরে আসতে থাকেন। যথাস্থানে ফেরার আগেই মাইনগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। এ-সময় সামছুল আরেফিন ও খিজির আলীর বাহিনী পশুর নদীর পশ্চিম তীরে বাঁধের আড়ালে অবস্থান করছিল। মাইন বিস্ফোরণের পরপরই পাকবাহিনী গুলি ছোড়া শুরু করলে সামছুল আরেফিন ও খিজির আলীদের পক্ষ থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। এদিন ৫টি জাহাজ ডুবে যায় এবং ‘কলম্বিয়া ট্রেডার’ নামে ৭৫০০ টনের আমেরিকান জাহাজটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘মস্তে আলী’ ও ‘সপ্তডিঙা’ নামে পাকিস্তানি দুটি গানবোটও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিন যাঁরা জীবন বাজি রেখে মাইন পেতে আসেন তাঁরা হলেন বদিউল আলম, আলী আসরাফ, আব্দুল হক, জি এম এ রহিম, রামপ্রসাদ, দিলীপ কুমার, মোস্তফা, আব্দুস সাত্তার, আব্দুস সেলিম, আব্দুল কাদের, রুহুল আমীন, আব্দুল গফুর, শাহ আলম, আব্দুল মালেক, সুশীল, আকরাম, রবীন্দ্রনাথ, শমসের আলী, সুবোধ বিশ্বাস, রমেশচন্দ্র, সামছুল হক, আব্দুর রহিম, শামছুল আলম এবং ওয়াহেদ আলী।
তৃতীয় অভিযান
মংলা বন্দরে দ্বিতীয় অভিযানের মাত্র একদিন পরেই ৯ই অক্টোবর (২২শে আশ্বিন ১৩৭৮) তৃতীয়বার আক্রমণ করা হয়। এদিন যে জাহাজগুলোকে টার্গেট করা হয়, সেগুলোর অবস্থান ছিল মংলা বন্দরের একেবারে সন্নিকটে পশুর নদীতে। কমান্ডোরা ৯ তারিখ দুটি ছোট নৌকায় করে কৈলাশগঞ্জ থেকে বাজুয়ার বিলের মধ্য দিয়ে পশুর নদীর নিকট এসে পৌঁছান। পাকসেনাদের কঠোর পাহারা ফাঁকি দিয়ে নৌকাগুলো রাত দেড়টার দিকে বানিশান্তা গ্রামের উত্তর প্রান্তে এসে থামে। তখন নদীতে ভাটা থাকায় পানির স্তর ছিল কিছুটা নিচে। বদিউল আলমের নির্দেশে কমান্ডোরা কিছুটা কাদা ভেঙ্গে পানির কাছে এসে পানিতে ঝাঁপ দেন। তাঁরা চারটি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম দলে ছিলেন আলী আশরাফ, খলিলুল্লাহ, এমদাদ ও রামপ্রসাদ, দ্বিতীয় দলে ছিলেন আব্দুল মালেক, জি এম এ রহিম, মোস্তফা ও ওয়াজেদ আলী, তৃতীয় দলে ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস, আকরাম, শাহ আলম ও বশির আহমেদ এবং চতুর্থ দলে ছিলেন রফিকুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার, আব্দুল হাকিম ও আরজ আলী। গতদিনের মতো এদিনও এসএলআর ও এলএমজি নিয়ে বাঁধের পাশে অপেক্ষা করছিলেন বদিউল আলমসহ সামছুল আরেফিন ও খিজির আলী।
নদীতে জোয়ার আসার ঠিক আগ মুহূর্তে মাইন পাতার কাজ শেষ হয়। একবার পাকবাহিনীর চৌকি থেকে সার্চ লাইটের আলো নিকটবর্তী হতে না হতেই কয়েকজন কমান্ডো ডুব দিয়ে আত্মরক্ষা করেন। গতদিনের মতো এদিনও কমান্ডোরা তীরে পৌঁছার আগেই মাইনগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। পাকবাহিনী তীব্র আলো ফেলে কমান্ডোদের খোঁজার চেষ্টা করে। ততক্ষণে তাঁরা নদীর জোয়ারে গা ভাসিয়ে পৌঁছে যান পশুর নদীর পশ্চিম তীর বরাবর প্রায় তিন কিলোমিটার উত্তরে। ভোর না হতেই সকলে মিলিত হন কৈলাশগঞ্জে। এদিনের আক্রমণে যে ৫টি জাহাজ বিধ্বস্ত হয়, তার মধ্যে একটির নাম ছিল ‘শের আফগান’।
১২ই অক্টোবর ৩০জন কমান্ডোসহ ৫০জন মুক্তিযোদ্ধা কৈলাশগঞ্জ ত্যাগ করে আশাশুনি থানার হেতালবুনিয়ায় নতুন ক্যাম্প স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁরা ‘নালশিরা’ জাহাজ আক্রমণ করেন। এটি ছিল পাকবাহিনীর চিকিৎসা জাহাজ। নালশিরা আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা ভীষণ সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং নিমজ্জমান জাহাজ থেকে নানা ধরনের ঔষধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উদ্ধার করেন।
চতুৰ্থ অভিযান
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ৫টি খাদ্যবাহী জাহাজ মংলা বন্দর থেকে কিছুটা উত্তরে বাজুয়া বাজারের পাশে পশুর নদীতে নোঙর করে। এর পরপরই দুটি জাহাজের মাল খালাস শুরু হয়। ঐ জাহাজগুলোতে চিনা এবং পাকিস্তানি পতাকা ছিল। ১৭ই নভেম্বর হেতালবুনিয়া ক্যাম্প থেকে এসে সামছুল আরেফিন, বদিউল আলম এবং খিজির আলী জাহাজগুলোর অবস্থান রেকি করেন। এরপর ২০ জন কমান্ডো এবং ২০ জন নিরাপত্তা যোদ্ধাকে নিয়ে ১৯শে নভেম্বর সকাল ১০টার মধ্যে সামছুল আরেফিন, বদিউল আলম ও খিজির আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দলটি নৌকাযোগে হেতালবুনিয়া ক্যাম্প থেকে সুন্দরবনের কাছাকাছি সুতারখালী ক্যাম্পে পৌঁছান। ২২শে নভেম্বর দ্বিতীয়বার রেকি করার পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনে হয় পাকবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আক্রমণ চালানো সম্ভব নয়। ২৩শে নভেম্বর গাজী মো. রহমতউল্লাহ তাঁর দল নিয়ে সুতারখালী ক্যাম্পে এসে পৌঁছান। তিনি ২৪শে নভেম্বর পাঁচটি জাহাজে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাকিরা তাঁর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। অতঃপর ৪টি নৌকায় করে তাঁরা বাজুয়ার নিকট শ্মশানঘাটে এসে পৌঁছান। নৌকাগুলো সেখানে বেঁধে রেখে কমান্ডোরা মাইলখানেক দক্ষিণে গিয়ে ৪ জনের একেকটি গ্রুপ করে নদীতে নেমে যান। তাঁদের নিরাপত্তা বাহিনী বাঁধের পশ্চিম দিকে অবস্থান করে। রহমতউল্লাহ, বদিউল আলম এবং শামছুল আরেফিন গভীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করতে থাকেন।
কমান্ডোগণ পানিতে নামার দুঘণ্টা পর মাইনগুলো একে- একে বিস্ফোরিত হতে থাকে। সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা গোলাবর্ষণ শুরু করে। মংলা বন্দরে অবস্থিত কামান থেকেও মর্টার নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। এদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে কভারিং ফায়ার চলতে থাকে। তাঁরা এক নাগাড়ে আধঘণ্টা গুলি চালিয়ে পাকবাহিনীকে দমিয়ে রাখেন। এদিকে খিজির আলীসহ সকলে ভোর হতে-হতে সুতারখালী ক্যাম্পে পৌঁছে যান। ২৪শে নভেম্বরের এ অপারেশনে পাঁচটি জাহাজই ডুবে যায়। এর মধ্যে একটির নাম ছিল “মাস্টার স্টাইলো’ (আমেরিকান), অপর একটির নাম ‘মাকরাম’। এ খবর ২৮শে নভেম্বর রাতে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা থেকে প্রচারতি হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বিনা উস্কানিতে পাকিস্তানের আক্রমণের ফলে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ৪ঠা ডিসেম্বর ‘লিমপেড’ নামের একটি পণ্যবাহী জাহাজ ধ্বংস করে দেয়। ভারতীয় বিমান বাহিনী ৫ই ডিসেম্বর রাতে মংলা বন্দরে আঘাত করে। ৮ই ডিসেম্বর মংলা বন্দর শত্রুমুক্ত হয়। [মনোজ কান্তি বিশ্বাস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড