পশ্চিম আনোয়ারা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম)
পশ্চিম আনোয়ারা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ৯ই নভেম্বর। এতে ৬২ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
রাজাকার, আলবদর ও আলশামস অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে খ্যাত পশ্চিম আনোয়ারা উপজেলার পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত। থানা রাজাকার কমান্ডার জালাল চৌধুরী জৌল্যা, বারশত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান গণি চৌধুরী, আলবদর কমান্ডার মওলানা আবু তাহের, গহিরা গ্রামের আলবদর কমান্ডার হাফেজ মকবুল আহমদ, আলশামস কমান্ডার মৌলভী নূরুল আলম, রাজাকার কমান্ডার বাচা মিয়া মাঝি, রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিম টিক্কা খান, সরেঙ্গা গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আহমদ ছফা, রাজাকার কমান্ডার কাসেম মেম্বার, ছিরাবটতলী গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আবদুল মজিদ, গুন্দ্বীপ গ্রামের শান্তি কমিটি নেতা মমতাজ মেম্বার, আইরমঙ্গল গ্রামের রাজাকার কমান্ডার বজল আহমদ, বোয়ালিয়া গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আলী আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে পশ্চিম আনোয়ারার রায়পুর ও বারশত ইউনিয়ন রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। পাশাপাশি বটতলী ও বৈরাগ ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকাও তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অপরদিকে মেরিন একাডেমিতে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ক্যাম্প। এ কারণে পশ্চিম আনোয়ারায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে।
গহিরা থেকে পারকী হয়ে পশ্চিম পটিয়ার জুলধা পর্যন্ত এলাকা শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য বারখাইন গ্রামস্থ মহিউল আলম বাহিনীর প্রধান দক্ষিণ চট্টগ্রামের কমান্ডার সার্জেন্ট মহিউল আলমের কাছে কেন্দ্রীয় নির্দেশ আসে। সার্জেন্ট আলম পশ্চিম আনোয়ারার ৫টি রাজাকার ক্যাম্পে একসঙ্গে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। প্রথমেই তিনি আবদুল মোতালেব নামের একজন বয়স্ক লোককে দিয়ে পুরো উপকূলীয় এলাকা রেকি করান। আনোয়ারা, পটিয়া ও বোয়ালখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করে। পশ্চিম আনোয়ারার রাজাকার ক্যাম্পগুলোতে অপারেশনের জন্য সার্জেন্ট আলমের নেতৃতে বিশাল বাহিনী সংগঠিত হয়। তাঁর নির্দেশে বোয়ালখালী ও পটিয়া গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা গুজরার চৈতন্য মহাজনের বাড়িস্থ ক্যাম্প ও বারখাইনের লতিফ কমান্ডারের ক্যাম্পে অবস্থান নেন। ৬ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার বহর নিয়ে কমান্ডার মহিউল আলম বারখাইনস্থ ক্যাম্প থেকে পশ্চিম আনোয়ারায় রওনা হন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পৃথক-পৃথক গ্রুপ ঐদিন সন্ধ্যার পর থেকে বটতলী রুস্তমহাটে সমবেত হতে থাকে। উল্লেখ্য, ঐদিন থেকে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র উপকূলে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত প্রচার করে। এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও সন্ধ্যার পর থেকে দূর-দূরান্তের মুক্তিযোদ্ধারা রুস্তমহাটে জড়ো হতে থাকেন।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ১১টায় সার্জেন্ট আলম প্রত্যেক গ্রুপকে নিজ-নিজ লক্ষ্যস্থলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধারা রুস্তমহাট বাজার ছেড়ে যাওয়ার সময় বিপদ সংকেত বেড়ে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেতে উন্নীত হয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অঝোর বৃষ্টিপাত মাথায় নিয়ে তারা ছুটে যান নিজ-নিজ লক্ষ্যস্থলের উদ্দেশ্যে। সার্জেন্ট আলম ছুটে যান গহিরার সাগর উপকূলে দোভাষী বাজারে। যেখানে ছিল থানা রাজাকার কমান্ডার জৌল্যার প্রধান ক্যাম্প। ক্যাম্পের সামনে পৌঁছামাত্রই তিনি ক্যাম্প লক্ষ করে পরপর তিনটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ব্রাশফায়ার শুরু করেন। এতে ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। এরপর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আরো ২০ জনের মতো রাজাকার নিহত হয়। অপারেশনের কিছুক্ষণ আগে থানা রাজাকার কমান্ডার জৌল্যা ও শান্তি কমিটির নেতা গণি চৌধুরী শতাধিক রাজাকার নিয়ে কয়েকটি ট্রলারযোগে বঙ্গোপসাগর হয়ে শংখ নদীর মোহনার দিকে পালিয়ে যায়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ গোবাদিয়ায় গণি চৌধুরীর বাড়িস্থ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ ক্যাম্পের ১১ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি গ্রুপ গণি চৌধুরী পরিচালিত মিন্নত আলী হাটস্থ সাইক্লোন সেন্টার রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন চালায়। এ অপারেশনে ক্যাম্পের ১৮ জন রাজাকার নিহত হয়। অপর এক গ্রুপ মুক্তিযোদ্ধা বারশত কালীবাড়ি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এতে ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। পশ্চিম আনোয়ারা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনে সেদিন মোট ৬২ জন রাজাকার নিহত হয় এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। অপারেশন শেষে ফেরার পথে বারশত সুরমা পুকুরপাড়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী শহীদ হন।
আনোয়ারা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনে কমান্ডার কাজী ইদ্রিছ, কমান্ডার আবদুল লতিফ চৌধুরী, কমান্ডার কাজী আবদুল হক, কমান্ডার শামসুল আলম মাস্টার ও -কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড