You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.21 | পরৈকোড়া-পূর্বকন্যরা-বাথুয়াপাড়া গণহত্যা (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

পরৈকোড়া-পূর্বকন্যরা-বাথুয়াপাড়া গণহত্যা (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম)

পরৈকোড়া-পূর্বকন্যরা-বাথুয়াপাড়া গণহত্যা (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ২১শে মে। এতে ১৭৬ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার পর শহরের নানা প্রান্ত থেকে কয়েকশ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে পরৈকোড়া গ্রামে আশ্রয় নেয়। নিরাপদ ভেবে তারা হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামে আশ্রয় নেয়। ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ ২২টি জমিদার পরিবার এ গ্রামে বাস করত। নিকটেই পূর্বকন্যরা ও বাথুয়াপাড়া গ্রামও হিন্দু অধ্যুষিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় আনোয়ারা থানার সঙ্গে শহরের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল নৌপথ। লঞ্চ ও নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। শহরের চাক্তাই থেকে লঞ্চ ও সাম্পান যোগে যাতায়াত ছিল জোয়ার- ভাটা নির্ভর। সময় লাগত পুরো একদিন।
এলাকাটি নিরাপদ হলেও যেকোনো সময় পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক হামলার আশঙ্কা ছিল। তাই স্থানীয় একদল যুবক সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করার জন্য অল্পকিছু অস্ত্রসহ পাহারার ব্যবস্থা করে। পার্শ্ববর্তী ভিংরোল-মাহাতা-ওসখাইন গ্রামে ছিল স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থীদের আস্তানা। ফজলুল কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহচর মুসলিম লীগ-এর নেতা খায়ের আহমদ চৌধুরী ওরফে খয়রাতি মিয়া (ভিংরোল) ছিল থানা শান্তি কমিটি-র নেতা। চট্টগ্রাম জেলা শান্তি কমিটির নেতা মাহমুদুন্নবী চৌধুরীকে সে জানায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা পরৈকোড়া গ্রামে ট্রেনিং নিচ্ছে। খবর পেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঐ গ্রামের ওপর অপারেশন চালানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পাকবাহিনীর আক্রমণের খবর জানতে পেরে গ্রামবাসী অন্যত্র সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু তারা সরে যাওয়ার সময় আর পায়নি। ২১শে মে সকাল ৮টার দিকে মুসলিম লীগ নেতা খয়রাতি মিয়ার নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানপন্থী ফুলের তোরা নিয়ে ভিংরোল গ্রাম থেকে দল বেঁধে পরৈকোড়া গ্রামের ওপর দিয়ে কালিগঞ্জ ব্রিজের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। সকাল ৯টায় কালিগঞ্জ ব্রিজের কাছে আসে পাকিস্তানি হানাদারদের বিশাল গাড়িবহর। পাকবাহিনীকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেয় মুসলিম লীগ নেতা খয়রাতি মিয়া ও তার সহযোগীরা। ঐ সামরিক বহরে ছিল তিন শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও বিহারী জল্লাদ এবং ৩৭টি সাঁজোয়া গাড়ি। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের আরো প্রায় তিন শতাধিক রাজাকার, আলবদর-আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্য। কালিগঞ্জ ব্রিজ পার হয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা পরৈকোড়া, বাথুয়াপাড়া ও পূর্বকন্যরা এ তিনটি গ্রাম ঘেরাও করে। এরপর শুরু হয় পৈশাচিক ধ্বংসযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও নারীনির্যাতন। তখন গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা সুরজিৎ দাশ সুনু, ডা. শ্যামল সেন, ডা. অরুণ, প্রণব দাশ ও সুধন জলদাস সহযোদ্ধাদের নিয়ে শত্রুদের লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বুঝতে পেরে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল ঘটনাস্থলের দিকে এসে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে ১৭৬ জন মানুষ নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ১৩০ জনই ছিল আশ্রিত। সেদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বিরতিহীনভাবে পরৈকোড়া, বাথুয়াপাড়া ও পূর্বকন্যরা গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
গণহত্যায় নিহত যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- পরৈকোড়া গ্রামের সুখদা রঞ্জন চৌধুরী, অবিনাশ ভট্টাচার্য ও তার শ্যালক, চিন্তাহরণ সিংহ (পটিয়া জজকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী), নিকুঞ্জ বিহারী দেব, বেনু মাধব দেব, পুকুন দাস পুক্কা, কার্তিক দাস, সরোজ রুদ্র, অমর চক্রবর্তী, তপন দাশ, অমর কৃষ্ণ দে, অনিল শুক্লদাস, টুনু শুক্লদাস, তরুণ কান্তি চৌধুরী, সুধীর রঞ্জন দাশ, উপেন্দ্র লাল চক্রবর্তী, নৃপতি চক্রবর্তী, সুধীর দত্ত, বদন দে, অমর দাশ, শিবু প্রসাদ, হরিশংকর মুখার্জী ও বিকাশ ধর; বাথুয়াপাড়া গ্রামের ডা. রমণী মোহন দাশ ও তার আত্মীয় দ্বিজেন্দ্র লাল দত্ত, জামাতা নারায়ণ সাধন দাশ ও নাতি পুলক চৌধুরী, সুধীর রঞ্জন দাশ, ভবতোষ দাশ, বাদল বৈদ্য, রূপন দাশ ও মৃদুল দাশ এবং পূর্বকন্যরা গ্রামের হরিশঙ্কর মুখার্জী, গোপাল দে বড়া, সুধীর দে, অমর ভট্টাচার্য, মাস্টার হরিশংকর ভট্টাচার্য ও তার নাতজামাই হরি চৌধুরী (ফিরিঙ্গি বাজার) এবং মিলন বিশ্বাস (শাকপুরা)। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল আশ্রিত, যে কারণে অন্যদের নাম এবং পরিচয় জানা যায়নি। এ গণহত্যায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যে-সকল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস অংশগ্রহণ করে, তারা হলো- ওসখাইনের রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিম (যুদ্ধকালে নিহত), রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম, ইউনুছ, আবুদল খালেক, নুরুল ইসলাম, আবুল কালাম ওরফে আলম শাহ, নুরুল হক-১, আবুল ফজল, আবুল হোসেন, মো সিরাজ (যুদ্ধকালে নিহত), নুরুল হক-২, আবদুর রহমান, ইব্রাহিম, আসহাব মিয়া, ভেট্টা বড়ুয়া (যুদ্ধকালে নিহত), ফটিক বড়ুয়া (যুদ্ধকালে নিহত) ও আমির হোসেন, খাসখামা গ্রামের রাজাকার কমান্ডার নুরুল আবসার, রাজাকার ফজল হক ও আবদুল হাকিম পেচুমিয়া (যুদ্ধকালে নিহত), মামুর খাইনের রাজাকার মনির আহামদ (মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), আজিজুর রহমান ও আবদুল মালেক, মাহাতা গ্রামের রাজাকার মইত্যা, ছিদ্দিক আহমেদ, আবদুল জব্বার, আবু আলম ও মোহাং ইব্রাহিম, দেওতলা গ্রামের আবদুস ছোবান, কৈখাইনের রাজাকার আহামদ ছাফা, আবদুল কাদের, বাদশা মিয়া, মো. আবদুল্লাহ, আবদুল হাকিম, মোহাম্মদ শরীফ, তালসরার দুদুমিয়া প্রমুখ।
২১শে মে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর পরৈকোড়া, বাথুয়াপাড়া ও পূর্বকৈন্যরা গ্রামের সিংহভাগ মানুষ ভারতের শরণার্থী শিবিরে চলে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুকিছু পরিবার ফিরে এলেও বহু পরিবারই আর পৈতৃক ভূমিতে ফিরে আসেনি। [জামাল উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড