পটিয়া পিটিআই বধ্যভূমি ও গণকবর (পটিয়া, চট্টগ্রাম)
পটিয়া পিটিআই বধ্যভূমি ও গণকবর (পটিয়া, চট্টগ্রাম) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী ক্যাম্প ছিল। এপ্রিলের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এখানে কত লোককে হত্যা, কত লোককে আহত এবং কত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া অসম্ভব, কারণ এখানে এসব চলত গোপনে। হত্যার পরপরই লাশ মাটিচাপা দেয়া হতো। পটিয়া শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খায়ের আহমদ চৌধুরী (পূর্ব চন্দনাইশ চৌধুরীপাড়া), কনভেনশন মুসলিম লীগ দক্ষিণ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক এডভোকেট আহমেদুর রহমান চৌধুরী (চন্দনাইশ হাজিপাড়া) প্রমুখের ইশারায় এসব কর্মকাণ্ড চলত।
জুলাই মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার আবু মোহাম্মদ ইসলাম (পিতা হামিদ হোসেন, বরকল) ও আবুল বশর (পিতা মাওলানা মো. ইছহাক, উত্তর হাশিমপুর)-এর নেতৃত্বে খায়ের আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে একদল মুক্তিযোদ্ধার অপারেশনে শান্তি কমিটির নেতা রশিদুজ্জামান (পিতা সালেহ আহমদ ভেন্ডার; খায়ের আহমদ চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র) নিহত হয়। এ ঘটনার রেশ ধরে পরদিন সকালে পাকবাহিনী চৌধুরীপাড়া থেকে ৬ জন নিরীহ লোককে গ্রেপ্তার করে পিটিআই ক্যাম্পে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন: ফয়েজ আহমদ (চৌধুরীপাড়া, চন্দনাইশ), আবদুল মালেক (পিতা খুইল্যা মিয়া, চৌধুরীপাড়া), বদর রহমান (পিতা এনু মিয়া, চৌধুরীপাড়া), আলতাজ মিয়া (পিতা আলী মিয়া, চৌধুরীপাড়া), কমল মিয়া সওদাগর (পিতা ওয়াহেদ আলী, চৌধুরীপাড়া) এবং আলাউদ্দিন (চৌধুরীপাড়া)। পিটিআই- এর বর্তমান লাইব্রেরি ছিল নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে নির্মম নির্যাতনের পর তাদের পটিয়া থানায় সোপর্দ করা হয়। ২২শে আগস্ট (৫ই ভাদ্র) গাছবাড়িয়ার টাকখাইয়ার পাড়া নিবাসী মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুল হক ওরফে কালা ভাইকে আবদুস সবুর (জামিজুরী), আবুল কাসেম (জামিজুরী), এবাদুর আলী (জামিজুরী), আহমদ শফি ওরফে চেইঙ্গা কইর (দোহাজারী), লাল মিয়া কেরানি (চৌধুরীপাড়া), আলী হোসেন (ঐ), আবদুল চৌকিদার (ঐ), আমজাদ হোসেন (চাগারস্থ পুকুরভাঙ্গা), আবদুল মজিদ (দোহাজারীস্থ সরকারবাড়ি) এবং আহমদ হোসেন (জামিজুরী)-সহ একদল রাজাকার পূর্ব চন্দনাইশের ওপর দিয়ে ধাওয়া করে ধরতে ব্যর্থ হয়ে পূর্ব চন্দনাইশ থেকে দুজন, টাকখাইয়ার পাড়া থেকে দুজন এবং দক্ষিণ গাছবাড়িয়ার বাইন্যাপাড়া থেকে ১৪ জন, মোট ১৮ জন নিরীহ লোককে ধরে পিটিআই ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাঁরা হলেন: ফোরক আহমদ (পিতা আলী আহমদ, টাকখাইয়ার পাড়া), নূরুল হক (পিতা আবদুল মজিদ, টাকখাইয়ার পাড়া), শামসুল আলম চৌধুরী (পিতা আহমদ কবির চৌধুরী, পূর্ব চন্দনাইশ), খুইল্যা মিয়া (পূর্ব চন্দনাইশ), ব্রজবাঁশি ধর (পিতা হরিকৃষ্ণ ধর, বাইন্যাপাড়া, দক্ষিণ গাছবাড়িয়া), রামকানাই ধর (পিতা হরিকৃষ্ণ ধর, বাইন্যাপাড়া), রজনীকান্ত ধর (পিতা হরিকৃষ্ণ ধর, ঐ), নারায়ণ চন্দ্র ধর (পিতা জগবন্ধু ধর, ঐ), কালিপদ ধর (পিতা মোহনবাঁশি ধর, ঐ), নির্মল ধর (পিতা মোহনবাঁশি ধর, ঐ), সাধন চন্দ্র ধর (পিতা পেয়ারী মোহন ধর, ঐ), সুবাস চন্দ্র ধর (পিতা ডা. নরেন্দ্র লাল ধর, ঐ), অমিত ধর (পিতা মধুসূদন ধর, ঐ), কৃষ্ণপদ আচার্য (পিতা মনোমোহন আচার্য, ঐ), বিনোদ বিহারী নাথ (পিতা নবকুমার নাথ, ঐ), বিপিন চন্দ্ৰ নাথ (পিতা গোবিন্দ চন্দ্র নাথ, ঐ), রণধীর নাথ (পিতা বিপিন চন্দ্র নাথ, ঐ) এবং কৃষ্ট ঘোষ (পিতা সদারাম ঘোষ, ঐ)। এদের মধ্যে খুইল্যা মিয়া ছিল রাজাকার। শ্যালক শামসুল আলম চৌধুরীকে বাঁচাতে গিয়ে সে ধরা পড়ে। এই ১৮ জনের ওপর ভয়ানক শারীরিক নির্যাতন চালানোর পর ফোরক আহমদ ও নূরুল হককে মুক্তি দেয়া হয়। বাকি ১৬ জনের মধ্যে ১৫ জনকে পিটিআই প্রাঙ্গণে এবং একজনকে (কৃষ্ণপদ আচার্য) আরাকান সড়কের দোহাজারী ব্রিজে গুলি করে হত্যা করা হয়। কৃষ্ণপদ আচার্যের লাশ দোহাজারী ব্রিজের নিচে শংখ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। স্বাধীনতার পরে এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কৃষ্ণপদ আচার্যের মাতা শিশুবালা দেবী (স্বামী মনোমোহন আচার্য) ১৯৭২ সালের ১৪ই মে পটিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার নং ৩১, ধারা US/346/302 / 34 BPC R/W 11 BDCO/72 |
এ ঘটনার পরে একদিন ছাত্রলীগ কর্মী এবং পটিয়াস্থ কচুয়াই গ্রাম সংগ্রাম পরিষদের মহিলা সম্পাদক আছিয়া বেগম-কে পাকবাহিনী ও তাদের দালালরা তাঁর বাড়িতে মারধর করে পিটিআই ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সঙ্গে তাঁর পিতাকেও নিয়ে যায়। পাকবাহিনীর কাছে পাকিস্তানবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত পটিয়ার আওয়ামী লীগ- ও ছাত্রলীগ-এর ৩৬ জন নেতাকর্মীর মধ্যে আছিয়া বেগম ছিলেন অন্যতম। এছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার খবরও পাকবাহিনীর কাছে ছিল। কিন্তু পাকবাহিনী আছিয়া বেগমকে হত্যা না করে ধর্ষণ করার পর ছেড়ে দেয়। তাঁর পিতাকেও ছেড়ে দেয়। ছাড়া পাওয়ার পর ডুলাহাজরা হাসপাতালে আছিয়া বেগমের চিকিৎসা চলে। পিটিআই ক্যাম্পে পাকবাহিনী কর্তৃক এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার খবর পাওয়া যায় পটিয়ার ডাক্তার প্রিয়দর্শন চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। ঘটনার দিন রাতে চোখবাঁকা অবস্থায় একজনের পেছনে আরেকজনকে দাঁড় করিয়ে কিছু লোককে এক সারিতে সাজানো হয়। তারপর সারির শেষ ব্যক্তির পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে একজন পাকসেনা একটিমাত্র গুলি করে সকলকে হত্যা করে। উল্লেখ্য যে, পাকসেনাদের চিকিৎসার জন্য ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরীকে বাধ্যতামূলকভাবে এ ক্যাম্পে যেতে হতো। সেদিন রাতে মেজর আরিফের গল ব্লাডার পেইনের চিকিৎসার জন্য তাঁর ডাক পড়লে তিনি নিজের মোটর সাইকেল চালিয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করতেই মোটর সাইকেলের হেডলাইটের আলোয় এ হত্যাকাণ্ড দেখতে পান। পটিয়া পিটিআই মাঠের বধ্যভূমিতে ‘গণহত্যা ও গণকবর’ স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘মুক্তি ভাস্কর্য’ [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড